লাল ছাতা/ভাস্বতী শ্যাম চৌধূরী
লাল ছাতা
ভাস্বতী শ্যাম চৌধূরী
দার্জিলিং আমার জন্মভূমি ওটা আমার ভালোবাসার শহর, ওখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা। একবার ওখান থেকে নেপালের বর্ডার পশুপতিতে গিয়েছিলাম সেখান থেকে একটা লাল ছাতা এনেছিলাম ছাতাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি ওটাকে কখনো কাছছাড়া করতাম না, আমি তখন দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ি।
একদিন আমি আমার বন্ধু দেবুর সাথে কলেজ থেকে ফিরছিলাম বাজারে এসে ভাবলাম একটু চা খাই,
গোল ঘরের ওপরে গিয়ে আমরা চা খেলাম। কিছুটা দূর এসে দেখি আমার ছাতাটা নেই। আমি বললাম দেবু আমার ছাতাটা? ও বলল তুই নিশ্চয়ই গোল ঘরে ফেলে এসেছিস। দৌড়ে গেলাম। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম আমার ছাতাটা দেখেছ? ও বলল ওটা তোমার ছাতা? ওটা তো একটা লোক নিয়ে গেল।
আমি বললাম কোন লোক? দোকানদার বলল সে চেনে না তবে আমি যে মাছওয়ালার সাথে কথা বলেছিলাম ঐ মাছওয়ালা? চেনে। ও লোকটাকে বলেছিল কোষ মামা (মামা কেমন আছ)! আমরা মাছওয়ালার কাছে গেলাম বললাম তুই কাকে কোষ মামা বলেছিলি।
ও তো মনেই করতে পারছে না, কিছুক্ষণ পরে বলে উঠল ওটা একটা ধোবি, ঘুমে থাকে।
আমি বললাম আমাকে নিয়ে যেতে পারবি। ও বলল পারব। এদিকে বাজারে সবাই জেনে গেছে আমার ছাতা হারিয়েছে! সবাই জিজ্ঞাসা করছে বইনি ছাতা পাইও? আমি তো কাদোঁ কাঁদো হয়ে বলছি পাকোছুইনা, ওরা দুঃখ প্রকাশ করে বলছে বিচারা, যেন কোন অমূল্য রতন হারিয়ে গেছে ।
পরের দিন সকালেই আমি আমার আরেক বন্ধু কল্যাণকে বললাম আমার সাথে ঘুমে যাবি? ও বলল আমার তো ক্লাস আছে, তবে ঠিক আছে যাব।
সবার কাছে তখন আমার ছাতা খোঁজাটাই বেশি ইম্পর্টেন্ট, আমরা দুজনে মাছওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে সকালবেলা টয় ট্রেন ধরে ঘুমে গেলাম ধোবির খোঁজে।
ধোবির বাড়ি মাছওয়ালা চিনত। আমরা যথাসময়ে ধোবির বাড়ি পৌঁছলাম ।
গিয়ে দেখি ও ইস্ত্রিরি করছে, আমি ওকে দেখে চিনতে পারলাম । ও আগে আমাদের পাড়ায় থাকত। ওর বাবা হীরালাল আমাদের কাপড় কাঁচত। ও আমাকে দেখে চিনতে পারল।
আমি বললাম কাল তুমি আমার ছাতা নিয়ে এসেছ গোল ঘর থেকে? ও বলল ওটা তোর ছাতা? ওটা তো আমি একজনকে দিয়েছি। ঠিক আছে তুই ওটা কাল পেয়ে যাবি আমি তোর বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব। আমি বললাম দুদিন সময় দিলাম এর মধ্যে যদি না দাও আমি আবার আসব।
তারপর দুদিন কেটে গেল ধোবির পাত্তা নেই!
আমি বন্ধুদের বললাম ওকে ছাড়া যাবে না। ঠিক হল দলবল নিয়ে গিয়ে ধরব। দলবল বলতে আমি সুদীপ্তা দেবু কল্যাণ আরও অনেকে গিয়ে ধোবির উপর চড়াও হলাম। বললাম আমার ছাতা কোথায়? স্বীকার করল ওটা একজনের কাছে কুড়ি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে, আমি তখন ভীষণ রেগে গিয়ে দারুণ ধমকালাম এমনকি চোরও বললাম। বেশ ভিড় জমে গেছে সবাই বলছে এই লোকটা তো ভালোই জানতাম চোর হল কবে থেকে?
চোর বলাটা আমার একদম উচিত হয়নি, আমি ফেলে এসেছিলাম বলেই তো ও ছাতাটা নিয়েছিল। তখন বয়স কম ছিল মাথার ঠিক ছিল না। যাক ওকে বললাম কাকে বিক্রি করেছ? আমরা যাব তার কাছে। ও বলল ওটা একটা সবজি আলী। আমরা বললাম কোথায় থাকে? ওকে বাজারে গেলে পাওয়া যাবে। আমরা বাজারে গিয়ে সবজিওয়ালিকে ধরলাম। বললাম ছাতা কোথায়? আকাশ থেকে পড়ল কোন ছাতা? আমরা বললাম ন্যাকামো হচ্ছে তুমি যেটা কুড়ি টাকা দিয়ে ধোবির কাছ থেকে কিনেছ। বলছে ওইটা? আমি একটা মেয়েকে দিয়েছি ও তো ওটা নিয়ে স্কুলে গেছে! আমি বললাম আমি কিছু শুনতে চাই না ওটা আমার ছাতা আমাকে দাও। আমি তখন মরিয়া হয়ে গেছি। তখন ধোবি আর সবজিওয়ালী কি কথা বলল তারপর আমাদের আশ্বাস দিল। ওটা তুই কাল অবশ্যই পাবি।
এদিকে আমি তো মাকে কিছুই বলিনি। মা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছে। তোর ছাতাটা কোথায়? আমি বলছি আছে, পরের দিন আমি আর মা বারান্দায় সকালবেলা দাঁড়িয়ে আছি। ধোবি উপর থেকে আমাকে ডাকছে - বইনি বইনি !
মা বলছে কে লোকটা তোকে ডাকছে। মাকে বললাম পরে তোমাকে বলছি ।
ধোবি আমার হাতে ছাতাটা দিল। ওর মুখে তখন প্রশান্তির ভাব ছাতা চুরির দায় থেকে মুক্ত, জীবনে কোনদিন কারো ছাতায় হাত দেবে না, আমি ওকে বললাম এসো ঘরে এসো মার সাথে দেখা করে যাও। ও বলল আজ থাক।
এই বলে চলে গেল । তারপর ঘরে এসে মাকে সব বললাম মা তো শুনে অবাক বলছে "কোষ মামার" সূত্র ধরে ছাতা উদ্ধার করলি?
পরের দিন আমি তো ছাতা নিয়ে কলেজে গেলাম সবাই তো লাফাচ্ছে ছাতাটা নিয়ে সবাই একবার করে নাচছে, আমার লাল ছাতা রাতারাতি ভিআইপি হয়ে গেল! নেপালি বন্ধুরা তো খুব মজা করছে। বলছে মিষ্টি খাওয়াতে হবে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালাম। আমার ছাতার দাম ছিল ২৩ টাকা। ওটা উদ্ধার করতে ৩০ টাকা খরচা হয়ে গেল। তবু ওকে তো ফিরে পেলাম। ধৈর্য আর বন্ধুদের সহযোগিতা থাকলে সবকিছুই জয় করা যায়। এই বয়সে এসেও আমার লাল ছাতাকে ভুলতে পারিনি। ও যে আমার ভিআইপি সন্তান!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴