রেতি বনে বিরুৎ (১)/বিমল দেবনাথ
রেতি বনে বিরুৎ (১)
বিমল দেবনাথ
বিরুৎ-এর কোয়ার্টারের দক্ষিণে একটা প্রশস্ত সবুজ মাঠ। মাঠের উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ধারে ছবির মতো আরও কিছু কোয়ার্টার। ঘরগুলোর চার পাশ বেশ ফাঁকা। মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে জারুল গাছ লাইন করে লাগানো। মাঝে মাঝে লাগানো আছে কৃষ্ণচূড়া। গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া বসন্ত দাগ ঢেকে সেজে ওঠে অসংখ্য লাল ফুলে। পাতা হীন গাছগুলোর ফুল হয়ে ওঠে পাতা। এই বিট অফিসের কৃষ্ণচৃড়া লাল হয়ে থাকে বর্ষা পর্যন্ত। মনে হয় বর্ষা লাল কার্পেটের উপর দিয়ে জারুল প্রেমে আসে। প্রেমে ফুল ফোটে। বেগুনি জারুল আর লাল কৃষ্ণচৃড়ার মিশ্রণ যেন গ্রীষ্ম ও বর্ষার আলিঙ্গন। ডুয়ার্সের এই এক অপূর্ব মায়া। ঘাম হলে ধুয়ে দেয় বৃষ্টি।
সারা রাত গেল গুমট গরমে। একদম বাগবাজারের এল দত্ত লেনের মতো। হাওয়া না থাকলে গুমট গরম দেওয়ার ব্যাপারে গঙ্গা আর বন এক। বিরুৎ-এর ঘুম হয়েছে ছাড়াছাড়া। সকালে প্রথম পাখির ডাকে ঘাম ভেজা বিছানা ছেড়ে দেয়। বারান্দা থেকে ডাক দেয় পাশের ঘরের গার্ড রতনকে। রতন বিটবাবুর খবর রিলে করে দেয় অন্য কোয়ার্টারে। স্টাফ রেডি হতে হতে বিরুৎও রেডি হয়ে নেয়। সূর্য উঁকি মারে জানালায়। বিরুৎ বারান্দা থেকে দেখে রেতি বনের সেন্ট্রাল রোড। এই রাস্তাটা বিরুতের প্রথম প্রেম। প্রেম মনের অভাব পুরনের রসদ? এতদিন কেন বুঝতে পারলনা সে।
সেদিন শেষ বিকালে যখন প্রথম রেতি বনের বুক চিরে এই ঘরটার বারান্দায় এসে কাঠের চেয়ারে বসেছিল, এক ঝাঁক পাখি সামনের বন থেকে উড়ে এসে ধনুকের মতো বেঁকে আবার বনের উপর দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল...
সারা রাত ঘুমাতে পারেনি বিরুৎ। গিরিশ মঞ্চের কনসার্টের মতো এক অজানা কনসার্ট মাঝে মাঝে বেজে ওঠে মনের ভেতরে। পাখিগুলো যেন যাদু জানে। পি সি সরকার সারকারিনাতে ইন্দ্রজাল করে যেমন মোহিত করত এই বনের মোহ যেন তার থেকে অনন্ত গুণ বেশি।
রেঞ্জের জিপে করে বনের ভিতর দিয়ে বিটে আসার সময় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। রোমাঞ্চ, বিস্ময় কি আগুন? বিরুৎ-এর 'পথের পাঁচালি'র অপুর কথা মনে পড়ে। আগুনে ফিঙে পাখির আকর্ষণের মতো কত বার দেখেছে সিনেমাটা! কোন কিছুর নাম-ডাকও মনে হয় আগুন। মানুষও পাখির মতো উড়ে যায় সেদিকে। সিনেমাটা যতবার দেখেছে ভালো লেগেছে বিরুৎ-এর। কিন্ত কেন অপু ট্রেন দেখতে উতলা হতো তার ভাব বুঝতো না। আজ যখন বনের গাছগুলো ঘুরতে ঘুরতে পেছনের দিকে চলে যাচ্ছিল, গাছগুলোকে ভালো করে দেখতে বিরুৎ-এর মন কেমন উতলা হয়ে উঠছিল। অপুরও কী রেল দেখার জন্য এই রকম মন উতলা হতো? উন্মুক্ত আকাশ, ঘনবন আর সবুজ গাছ দেখার এমন উত্তুঙ্গ বাসনা বিরুৎ-এর মনের ভেতর এতদিন কোথায় লুকিয়েছিল? ভালোই তো ছিল বাগবাজার, শোভাবাজার, এল দত্ত লেন এবং গোঁসাই লেনের গামছার মতো আকাশ দেখে ও সোনাগাছির সীমানা ছাড়িয়ে ধুসর বাড়িগুলোর মাঝের অলিগলিতে সোনামনাদের রং বাহারি আনাগোনা আর ধূসর গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া দেখে। বাস, লরি, অটো আর অটোমেটিক মানুষগুলোর হই হট্টগোলের মধ্যে কেন এই মনের খবর পায়নি? তাহলে কি মনের বয়স হয়না। পঁয়তিরিশ বছরে মানুষটার মন সেই ছোট্ট অপুর মনের মতো। বিরুৎ-এর এই মনের খবর কি বনের বড় সাহেবরা পেয়েছিল? তারজন্য জীবনের শেষ সুযোগের মৌখিক পরীক্ষায় অন্য অনেক কে টপকে বিট অফিসারের চাকরিটা পেয়েছিল। পুলিশের খাতায় সাদা কাগজ মানুষটা নিয়োগ পত্র পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিল। ভয় পেয়েছিল বাড়ি আর পাড়ার লোকজন। বন্ধুরা বলেছিল বিরুৎ ফুরুৎ...হয় হাতির পয়ের তলায় যাবে না হয় বাঘের পেটে। আজকাল খবরের কাগজে যা সব খবর বের হয়! বিরুৎ-এর ভেতরে কিন্তু কেমন একটা আনন্দ। অচেনা অজানাকে জানার জন্য একটা মন যে ওর আছে সেটা বুঝতে পেরে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। সে রোমাঞ্চকে সাথী করে ডিঙ্গিয়ে যায় বাড়ি ও বন্ধুদের বাধা।
রতনরা নিজেরা কথা বলে নেয়, স্যার কে আজ ভাল জায়গাগুলো দেখাবে। প্রথম দিন তো...
রতন বলে স্যার চলুন, পেট্রোলিংয়ে যাই। ওরা পাঁচ জন সবুজ মাঠের উপর দিয়ে এগিয়ে যায় বনের দিকে। বিরুৎ যত পেছনে হাঁটতে চায় স্টাফরা বিরুৎ-এর পেছনে চলে যায়। বিরুৎ না বুঝেই আগে আগে হাঁটে। সেন্ট্রাল রোডে উঠতেই গা ছমছম করে। ডাইনে বায়ে শালের বন। রাস্তার মাঝে ও দু'পাশে সবুজ ঘাসের লাইন। জীবনে প্রথম বন ও বনের ভেতরে রাস্তার ওপর ঘাসের লাইন দেখে বিস্মৃত বিরুৎ ঘাসের উপর বসে পড়ে। একটা ঘাসের ব্লেড তুলে বলে, দেখ বিরুৎও ছায়া দেয়। বিরুৎ-এর মনে হয় ও আজ নিজের নামের সঠিক অর্থ বোঝে। রতনরা বোঝেনা স্যার কেন এত সকালে ধূমায়িত হাতির পটির পাশে বসে আছে...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴