রূপসার সাথে একটি রাত /সুকান্ত নাহা
রূপসার সাথে একটি রাত
সুকান্ত নাহা
**********************
শহুরে কোলাহল ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে আমাকে 'দু-দণ্ড শান্তি' দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে আমার 'বনলতা'। যদিও আমি তাকে রূপসা-ই বলি। কখনও মোহময়ী, কখনও চাঁদসোহাগী কখনও বা জাদুকরী যখন যা মনে হয় ডাকি। সে আমার শীতল সবুজ প্রাণের আরাম, অনাবিল শান্তির আলিঙ্গন। সে আমার দিগন্ত ছোঁয়া নিবিড় সবুজ ভালবাসা। সেখানে আর আছে একটি ছোট্ট বাসা। আমার বড় প্রিয় এক নিভৃত পরিসর। সেই বাসাটিও আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মাঝে মাঝে যখন ভীষণ একলা হতে ইচ্ছে করে তখন সেখানে চলে যাই। শহর ছাড়িয়ে হাইওয়ে ধরে অনেকটা পথ পেরোলে বাঁ হাতে একটি মেঠো পথের দেখা মেলে। সে-ও আমার মনকেমনের খবর পেয়ে চুপটি করে প্রতীক্ষায় থাকে আমার। কোনও একদিন সে-ও যে আমার মতোই হঠাৎ করে রাজপথ ছেড়ে ধানক্ষেতের শরীর ছুঁয়ে সেই মোহময়ীর টানেই ছুটে গেছিল। আমার জীবনের বিপন্ন কোনও একদিনে সেই পথই আমায় ডেকে নিয়ে গেছিল রূপসার কাছে। সেই রূপসাকে প্রথম দেখা এবং প্রেমে পড়ে যাওয়া। ঐ পথ ধরে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে বনকুল আর কাশঝোপের আড়ালে ঘুমন্ত একটি রেললাইন। লাইন পেরোলেই রূপসাকে ছুঁয়ে ফেলা যায়। দূরে বুড়ো পাহাড়টার পায়ে ঝুঁকে থাকা আমার সবুজ প্রেয়সী, যে আমার চোখে পৃথিবীর সুন্দরীতমা বনভূমি।
জাদুকরীর সৌন্দর্য কিন্তু ভীষণ রহস্যময়। তার কুহকমোড়া তীব্র হাতছানি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারি না আমি। ওখানে গেলে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা তার দিকেই চেয়ে বসে থাকি। যে দিকে তাকাই আদিগন্ত শুধু অপার সবুজ স্নিগ্ধতা যা আমার অনুভূতিকে অবশ করে ফেলে। সবুজ মোহময়ী তখন আমার চোখে যেন এক লাস্যময়ী নারী। কত যে রূপ তার। কত না লাস্যে, বিচিত্র বিভঙ্গে, নানান রূপে সে আশরীর উন্মুক্ত করে আমাকে ভোলায়। যখন তার মনে সুখের আবেশ থাকে হেমন্তের লুকোচুরি আলোয় সে বুকের আঁচল সরিয়ে আমাকে কাছে ডাকে। হেমন্তদিনে তার বুকের ভেতর আমি শক্তির কবিতা হয়ে 'পোস্টম্যান' সাজি। বসন্তের ঝরা পাতার বিছানায় আমি সারাটা দিন কাটাই । অথচ আশ্চর্য কি জানেন, আজ অবধি দু-তিনটে ময়ুর, কিছু বানর আর রঙবেরঙের পাখি ছাড়া কোনও হিংস্র বন্যপ্রাণী আমায় বিরক্ত করেনি। হয়ত তারা আড়াল থেকে আমায় জরিপ করে ভেবেছে মানুষটা নেহাৎ মন্দ নয়। অন্তত তাদের কোনও ক্ষতি যে করব না এটুকু বুঝতে পেরে হয়ত সে কারণেই আমায় উপেক্ষা করে তারা। ঝরা পাতার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শূন্য ডালপালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে যখন আমার চোখে তন্দ্রা নেমে আসে তখন চুপিসাড়ে আমার বুকের ওপর কান্না হয়ে ঝরে পড়তে থাকে দিন ফুরোনো বিবর্ণ পাতারা। আমি সেই পাতাগুলোকে হাতে তুলে সযত্নে শুইয়ে দিই মাটির ওপর। তারপর বিষন্ন মনে চোখ মেলতেই দেখি শূন্য ডালপালা গুলোয় ছোট ছোট সবুজ কচি পাতারা ভোরের পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা শিশুর মতো আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলছে । মনের ভেতর তখন কোনও এক অচেনা পাখি মিষ্টি সুরে শিস দিয়ে বলে যায় 'আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে,কত পাখি গায়।' 'চৈত্র- বৈশাখে আবার আমার প্রেয়সীর বাতাসের সাথে ভীষণ রেষারেষি চলে। আমায় তখন সে তার রাগ দেখায় । তুমুল রূদ্ররোষে ফুঁসে উঠে বাতাসের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে সে নিজের শরীর তছনছ করে ফেলে। রাগে উপড়ে পড়তে চায় শেকড় ছিঁড়ে। আমার তখন ভয় হয়। আমি তখন তাকে প্রাণপণে শান্ত হতে বলি। পৌষের কাঁচামিঠে রোদে আবার আদুরে রূপসা রূপ বড় শান্ত। তখন যেন আলস্য পেয়ে বসে তাকে। ছায়াদীঘল চুল ছড়িয়ে রেললাইনের ওপর শুয়ে সে তখন রোদ পোহায় । আবার কখনও পূর্ণিমার রাতে...আহা, সে রূপ তোমাদের বোঝানোর ভাষা নেই গো আমার। জোৎস্নারাতে আমার চাঁদসোহাগী তখন গোপন অভিসারিকা। সারা শরীর জুড়ে তার রূপের প্লাবন। সেই রূপে মুগ্ধ আমি চন্দ্রাহত হয়ে বসে থাকি নির্জন বারান্দায়। ভোররাত পর্যন্ত চাঁদের সাথে তার উদ্দাম সহবাস প্রত্যক্ষ করে আমি শিহরিত হতে থাকি। আমার চোখের সামনে তার এই চাঁদগামীতা আমার অসহ্য লাগে। তবু ওদের এই স্বর্গীয় মিলন থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। সেই অনুভূতির আস্বাদ যে পায় একমাত্র সে-ই বোঝে।
অদূরে বাঁকের মুখে যেখানে নির্জন ছোট্ট স্টেশনটাকে ছুঁয়ে রেললাইনটা আরো গহীন সবুজের ভেতর হারিয়ে গেছে তার বেশ কিছুটা আগেই আমার একচিলতে বাসা।রেললাইনের ধার ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার পাপড়ি ঝরা কাঁকুরে পথ পেরিয়ে উঠে আসতে হয় কংক্রিট পিলারের ওপর কাঠের তৈরী আমার একলা ঘর 'বনের-কুটির'এ।
'বনের-কুটির' এর কথা আমি আগেও বলেছি। বলেছি বৃষ্টির কথা। বৃষ্টি, একমাত্র যে আমার এই ঠিকানার কথা জানে। তার সাথে বনের-কুটির এ কিছু নিভৃত যাপনের কথা আপনাদের না বলে থাকতে পারিনি। বৃষ্টি কে? বৃষ্টির সাথে আমার সম্পর্কই বা কী? বৃষ্টি কি সত্যিই আসে? বৃষ্টি কি রক্তমাংসের মানবী, নাকি....? এসব প্রশ্ন অনেকেই আমায় করেছেন। আমি স্পষ্ট করে কিছুই বলিনি। কিছু সম্পর্ক থাক না বরং কুয়াশায় মোড়া। বৃষ্টির কথা মনে পড়লেই ও যেন কীভাবে টের পেয়ে যায়। বনের-কুটির' এ আছি সে কথাও। টের পেলেই সে চলে আসে। আসলে আমাকে সে একা পেতে যায়। মুখোমুখি বসে শুধু সে আমার কথা শোনে। নানান প্রশ্ন করে আমায় জেরবার করে তোলে। কত কী যে জানবার আছে তার আমার কাছে কে জানে? অথচ নিজের কথা সে কিন্তু কিছুই বলে না । এ বিষয়টা হয়ত আপনারাও লক্ষ্য করে থাকবেন। সে যখন আমার কথা শোনে আমি তাকে দেখি। বৃষ্টি অপরূপা। কিন্তু তার চাইতেও যে অপরূপা আমার রূপসা। তার প্রেমে যে আমি পাগল একথা কাউকে বলতে পারি না। অথচ আমি বেশ বুঝতে পারি বৃষ্টি সে কথা জানে। ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমি বারবার যখন মুখ ফেরাই রূপসার দিকে ও সেটা লক্ষ্য করে। আর লক্ষ্য করেও সে চুপ করে থাকে, আমায় বিরক্ত করে না বলেই বুঝি সে আমার মনের কথা জানে। বৃষ্টি শুধু অপেক্ষা করে কখন আমি ওর দিকে মনোযোগ দেব। রূপসার কাছে এলেই বৃষ্টি আসবে। তবু সে আমার কাছ থেকে রূপসার প্রতি মনোযোগ কেড়ে নেয় না।
'বনের-কুটির'-এ কাঠের রেলিং দেয়া নির্জন বারান্দায় কাঠের মেঝের ওপর মুখোমুখি দুটো চেয়ার পাতা। মাঝে একটা নিচু চায়ের টেবিল। এক কোণে অযত্নে বেড়ে ওঠা মাধবীলতার ঝাড়। বৃষ্টি এলে আমরা ওখানে বসে গল্প করি। ঐ দুটি মাত্রই চেয়ার আমার। আসলে এই জায়গার কথা আমি তো কাউকে বলি না। তাই কেউ আসেও না এখানে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তো নয়ই। ওরা এলে যে জায়গাটাকে নরক করে তুলবে তা বিলক্ষণ জানি।
বসন্ত ফিরে গেছে। এবারে নানান ব্যস্ততায় আসা হয়নি প্রেয়সীর কাছে। জানি সে আমার ঝরাপাতার বিছানায় শাল ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে পথ চেয়ে বসেছিল। আসতে পারিনি বলে কত না অভিমান জমে আছে কে জানে। একটু দুরুদুরু বুকে যখন এই বৈশাখী দিনে এগিয়ে চলেছি মেঠো পথ ধরে তখন পথ তার ধূলোর আবিরগুলাল মাখিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকে, " এবারে ফাগুন দিনে তো এলে না ভাই। এলে আচ্ছা করে বসন্তের ফাগ লাগাতে পারতাম। দেরি করে এলেও কি নিস্তার পাবে ভেবেছ? ওদিকে যাও... তোমার অভিমানিনী কেমন মুখ ফুলিয়ে বসে আছে দেখো গে। এ যাত্রায় কত যে দুর্ভোগ লেখা রয়েছে তোমার কপালে কে জানে। "
'বনের-কুটির'-এ ঢোকার মুখে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি আমার মাথায় ঝরে পড়ে অভ্যর্থনা জানালো। অদূরের স্টেশন চত্বর থেকে স্মিত হেসে হাত নাড়লো জারুল আর অমলতাস।
অথচ অন্যবারের মতো এক ঝলক তাজা বাতাস কিন্তু ছুটে এলো না মোহময়ীর দিক থেকে। আড় চোখে চেয়ে দেখি রূপসার মুখ যেন থমথমে। আমি দেখেও না দেখার ভাণ করে ঘরের ভেতরে ঢুকি। সব কিছু ঠিকঠাক আছে। আমার লেখার টেবিল, বইপত্তর, ছবি আঁকার সরঞ্জাম,দেয়ালে টাঙানো আমার ভায়োলিন, চায়ের কেটলি, কাপ ডিস। পেছনের খোলা জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ধানের ক্ষেতে এক হাল চাষও হয়ে গেছে। আর কদিন বাদেই বীজ বোনা হবে সেখানে। এমনকি সেই শালিক পাখিটাও, কি আশ্চর্য যাকে আমি রোজ সকালে বিস্কুট খেতে দিই সে-ও জানালায় এসে দেখা করে গেল। আমায় দেখে প্রতিবারের মতো আহ্লাদে লেজ নাড়তে নাড়তে কেলোটাও বাসা অবধি এসে লেজ গুটিয়ে বসে পড়েছে সিঁড়ির নিচে। সব কিছু যেমনটা হওয়ার কথা তেমনটাই হয়ে চলেছে। কেবল যেখানে তালটা কেটেছে সেটাই শুধু সুরে বাজছে না যেন মোটেই।
শেষ বিকেলে বায়ু কোণে বিস্তর কালো মেঘ জমলো। দেখতে দেখতে লালাভ হয়ে উঠলো আকাশ। আশংকা জাগে মনে। তবে কি সত্যিই আজ কপালে দুর্ভোগ আছে? অভিমানিনী কী রূপ দেখাবে আজ কে জানে। কিন্তু আজ রাতেই যে পূর্ণিমা। সন্ধে হতেই পাহাড়ের ওপার থেকে রূপোর থালা জেগে উঠে ভাসিয়ে দেবে রূপসাকে। মুহুর্তে বদলে যাবে চাঁদসোহাগীর রূপ। থেকে থেকে রূপ বদলাবে তার। আমি স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকব সেই রূপের সামনে। আমি যে সেই রাত টুকুর লোভেই তোমার কাছে এসেছি রূপসা। অভিমান করে থেকো না। মুখ ফেরাও আমার দিকে।
আমার সমস্ত অনুনয় নস্যাৎ করে প্রবল রাগে হঠাৎ ফুঁসে উন্মত্ত হয়ে ওঠে জাদুকরী। বুঝতে পারি রাগ আমার ওপর নয়। বাতাসের সাথে তার তুমুল বোঝাপড়া আছে আজ। নিজেকে আড়াল করতে ঢুকে পড়ি 'বনের-কুটির'এর ভেতর। ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পাই বাতাসের সাথে রূপসার প্রবল যুদ্ধের শব্দ। আহত রূপসার আর্তনাদে বুক কেঁপে ওঠে আমার। মাথার ওপর আকাশটাও আজ যেন বিরূপ হয়ে উঠেছে। মুহুর্মুহু শব্দে কাঁপিয়ে তুলছে চারধার।
এভাবে কতক্ষণ কেটেছিল জানি না। আশংকা বুকে চেপে রূপসার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো খুব কাছেই রাতচরা কোনও পাখির ডাকে। মনে হল রূপসাই আমাকে ডাক দিয়ে বলে গেল, " কী গো, ভয় পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যে। ওঠো, বাইরে এসো। যুদ্ধ থেমে গেছে। ঝড় আমার কিচ্ছুটি করতে পারেনি। বাইরে এসে দ্যাখো, তোমার জন্য কেমন সেজেছি আজ। "
ধড়মড় করে উঠে বাইরে আসতেই দেখি বুড়ো পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে প্রায় মাঝ আকাশে উঠে এসেছে চাঁদ। সাদা খোলের শাড়িতে জোনাকির ঝলমলে চুমকির সাজে মোহময়ী রূপসাকে আজও অপূর্ব দেখাচ্ছে। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না কিছুতেই। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আমি বসে পড়ি বারান্দার বেতের চেয়ারটায়। আজ একবারও বৃষ্টির কথা মনে করিনি। সে-ও আসে নি আজ আমার কাছে। সামনের চেয়ারটা তাই ফাঁকা। আকাশে মেঘ রয়েছে বেশ। একটু বাদেই নির্ঘাত চাঁদটা হারিয়ে যাবে মেঘের আড়ালে। অপরূপা রূপসা ঢেকে যাবে অন্ধকারে। সে হোক গে। চাঁদসোহাগীর অত চোখ জ্বালানো রূপ এক এক সময় আমার অসহ্য মনে হয়। অন্ধকারের ভেতর আজ আমি রূপসার শরীরের প্রতিটি খাঁজের রহস্য খুঁজব আতিপাতি করে। অনুভব করব রূপসার বুকের স্পন্দন। বুক ভরে গন্ধ নেব নরম বুকের।
চাপা উল্লাসে আমি একটি সিগারেট ধরিয়ে ফেলি। বাকি রাতটুকু আজ রূপসা শুধুই আমার। দূরে কোথাও রাতজাগা কোকিলটা হঠাৎ শিস দিয়ে ওঠে অসভ্যের মতো।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴