রূপন সরকার-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-র বই 'খুনিয়া এবং'
রূপন সরকার-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-র বই 'খুনিয়া এবং'
বইটি হাতে নিয়েছিলাম "খুনিয়া" নামটি যুক্ত থাকায়। আমার অন্যতম ভালোলাগার জায়গা পূর্ব ডুয়ার্সের এই খুনিয়া মোড়। বিন্নাগুড়ি থেকে শিলিগুড়িগামী ৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে জলঢাকা নদী পেরিয়ে কিলোমিটার খানেক এগোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় 'খুনিয়া মোড়ে'। অথবা শিলিগুড়ি থেকে সেবকের রাস্তা ধরে চালসা পার করে ৩/৪ কিলোমিটার পথ চললে 'খুনিয়া মোড়ে'র দেখা মেলে। এই সমকোণ চৌরাস্তা মোড় থেকে হাতের বাঁ দিকে চলে গেছে কুমাই-ঝালং-বিন্দু-র রাস্তা। ডানদিক ধরে জঙ্গলপথে পৌঁছে যাওয়া যায় মূর্তি হয়ে লাটাগুড়ি। এক কথায় খুনিয়া মোড়কে পূর্ব ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি কেন্দ্রিক ট্যুরিস্ট সার্কিট বলা যায়। কালো পিচের চৌরাস্তার চারপাশে শুধুই সবুজের সমারোহ। বারো মাসে ছটি ঋতুতে ধরা পড়ে ভিন্ন ভিন্ন মুগ্ধ করা প্রাকৃতিক পরিবেশ। তবে হ্যাঁ, এখানে কোনো লজ বা হোমস্টে নেই, নেই কোনো রেস্টুরেন্ট। রাস্তার পাশে আছে দুটি একচালা চায়ের দোকান, যেখানে কাঠের উনুনে গরম গরম মোমো, ঘুগনি, অমলেট সহ চা পাওয়া যায়। টুপটাপ বৃষ্টি হোক বা বসন্তের পাতাঝড়া এই খুনিয়া মোড় চৌরাস্তার এক অদ্ভুত আবেদন অনুভব করি। শিলিগুড়ি প্ল্যানেট হলে অনুষ্ঠিত 'এখন ডুয়ার্সে'র দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মেলনে লেখক অমিত কুমার দে তার বইয়ের সাথে পরিচয় পর্বেও একই কথা জানিয়েছিলেন। তখনই ভেবে রাখি বইটি পড়তেই হবে। পরদিন জলপাইগুড়ি ফিরে 'পত্র ভারতী' বই দোকান থেকে বইটি কিনে নি।
লেখক খুনিয়া মোড় থেকে যাত্রা শুরু করে কত যে পরিচিত জায়গা, চরিত্র ছুঁয়ে গেলেন, স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে গেলেন, পাঠক হিসেবে যার আনাচে কানাচে আমিও কোথাও কোথাও লেখকের সৃষ্টির চরিত্র হয়ে উঠলাম। লেখকের গল্পের চরিত্র অন্তরীক্ষ যখন চা-বাগানের দৈন্যদশা তুলে ধরে, তখন আমার চোখে পরিষ্কার ভেসে ওঠে পূর্ব ডুয়ার্সের মধু থেকে রায়মাটাং একের পর এক বন্ধ চা-বাগান, পরিত্যক্ত কোয়াটার্স, শ্রমিক মহল্লা, অপুষ্টিতে ভোগা চা শ্রমিক পরিবারগুলি। অথচ আমার শৈশব যাপনে ফিরে গেলে দেখা যায় চা-বাগানগুলির এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। চা-বাগান অধ্যুষিত কালচিনি ব্লকের ইউনিয়ন একাডেমিতে পড়ার সময় আশেপাশের বহু বাগান থেকে ট্রাক, ট্রাক্টরে করে বাগানের সহপাঠীরা স্কুলে পড়তে আসত। সেই সূত্রে একাধিক বাগানের ছেলে-মেয়েদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে গড়ে ওঠে। মধু, আটিয়াবাড়ি, মেচপাড়া, রাধারানী, রায়মাটাং, চিনচুলা, ডিমা, গাড়োপাড়া প্রায় সমস্ত চা-বাগানে যাতায়াত শুরু হয়। বাগানের ম্যানেজার, বাবু স্টাফ, শ্রমিক মহল্লা, খেলার মাঠ, পুজো মন্ডপ, ফ্যাক্টরি, সাপ্তাহিক হাট, হেল্থ সেন্টার সব মিলিয়ে এক আলাদা জমজমাট জগত ছিল তখনকার চা-বাগানে। সাপ্তাহিক তলবি (বেতনের দিন যে হাট বসত) হাটের দিন হ্যামিল্টনগঞ্জ, আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রাকে ট্রাকে ব্যবসায়ীরা গিয়ে পসার সাজিয়ে বসতেন বাগানের হাটগুলোতে। এক-দেড় ঘন্টার বাজারে একেক জন ব্যবসায়ী সারা সপ্তাহের রোজগার করে ঘরে ফিরতেন। এক অন্য মেজাজের ছিল বাগানের হাটগুলি। কিছু হাটে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। চা ফ্যাক্টরি সন্নিহিত খেলার মাঠে অথবা কোনো ফাঁকা জায়গায় হাট বসত। হাড়িয়া (দেশি মদ) থেকে তেলেভাজা, মুদিখানা থেকে জামাকাপড় গৃহস্থলির সব প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী পাওয়া যেতে বাগানগুলোর সাপ্তাহিক হাট বাজারে। শ্রমিকরা সাপ্তাহিক বেতন পেয়ে প্রাণ খুলে খরচ করতেন। দুর্গা পুজো হোক বা বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফুটবল বা ক্রিকেট সবেতেই বাগানের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। এমন সাজানো গোছানো বাগান একটু একটু করে ধ্বংস হতে শুরু করে। সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের আগে ঘুণ ধরেছিল হয়তো বহু আগে থেকেই। ৯০- এর দশকের পর থেকে আস্তে আস্তে তা চোখে পড়তে শুরু করে। বাগান ধ্বংসের বহু কারণ আছে, তবে আমার মতো সাধারণের চোখে যা ধরা পড়েছে তার প্রথমটাই হলো দৃষ্টিভঙ্গির বদল। প্রাক-স্বাধীনতা সময়কালে ঔপনিবেশিক চা ব্যবসায়ীরা, বাগানের মুনাফার স্বার্থেই বাগানগুলোকে বড় যত্ন করে লালন পালন করতেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, আবাসন, রাস্তাঘাট সব বাগান মালিকেরাই ব্যবস্থা করতেন। দেশীয় মালিকেরা তো বাগানগুলো নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে রেখেছিলেন। তাই তাদের কাছে বাগানগুলি ছিল সন্তানসম। যেমন তারিণী প্রসাদ রায় তাঁর সহকর্মী জয়গোবিন্দ গুহ ও পূর্ণচন্দ রায়ের সঙ্গে খোলেন মধু চা বাগান ১৯২৫ সালে। জানা যায় জয়গোবিন্দ গুহর পুত্র তরুন চিকিৎসক মধুর অকাল প্রয়াণে জয়গোবিন্দ বাবু হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারিণী বাবু তাকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য তাঁর পুত্র মধুর নামানুসারে মধু চা বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাগান প্রতিষ্ঠিত হলে জয়গোবিন্দ বাবু আবার নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পান। সুতরাং বাগান ছিল তাদের কাছে পরিবারের অংশ। স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ মালিকরা ধীরে ধীরে চলে যান এবং দেশীয় মালিকদের কাছে বাগানগুলো বারবার হাত বদল হতে থাকে। নতুন বাগান মালিকদের বাগানের প্রতি আবেগের জায়গা কমে যায়, বাগান হয়ে ওঠে শোষণের যন্ত্র।
দ্বিতীয়ত, বাগানের শ্রমিক আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগতির প্রশ্নে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে সেটা গবেষণা সাপেক্ষ। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই তা শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময়ের তারকেশ্বর লোহার থেকে বর্তমান শর্মা (নাম পরিবর্তিত) বরাবরই চা শ্রমিকেদের দুর্দশা তথা চা-বাগানের ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছর দুয়েক আগে নিজে গিয়ে দেখে এসেছি মধু চা বাগানের গাছ থেকে ফ্যাক্টরির পার্টস কিভাবে শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে বিক্রি হয়ে পকেটস্থ হয়েছে। তলবের দিন (সাপ্তাহিক মাইনের দিন) শ্রমিকদের বেতন থেকে চাঁদা আদায় সহ মালিকের সাথে শ্রমিক নেতাদের দহরম মহরম নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা। বর্তমানে কোলকাতা থেকে আগত শাসক দলের শ্রমিক নেতা বাগানের সম্পদ থেকে বাগান শ্রমিক পরিবারের মেয়েদের সম্ভ্রম, সবেতেই হাত বাড়াচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর যৌথ পরিণতি বাগান Closed down. বাগানের যে বাবু পরিবার স্বচ্ছল জীবন যাপন করতেন, যে শ্রমিকরা হাসি খুশি জীবন কাটাতেন, যে ম্যানেজার শ্রেণি মাছ বাজারে ঢুকলে মাছের দাম বেড়ে যেত, একের পর এক বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনেই অন্ধকার নেমে আসে। বাগান কোয়াটার্সগুলির ভগ্নদশা, জৌলুসহীন পুজো মন্ডপ, ক্লাব, খেলার মাঠ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিত্যক্ত ছবি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। যারা বাগানের অতীত বর্তমান দুই ছবির সাথে পরিচিত তাদের চোখেই বাগানের বর্তমানের এই শ্রীহীন চেহারা ধরা পড়বে। তাই উপন্যাসের চরিত্র অন্তরীক্ষ যখন বাগানের দারিদ্রের কথা তুলে ধরেন, তার দাদার পরিবারের কথা তুলে ধরেন তখন আমার মতো পাঠকের চোখে সব জীবন্ত হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, বাগান ধ্বংসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমার চোখে পরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রয়োগ। তরাই-ডুয়ার্সের বাগানগুলো গড়ে উঠেছিল এক একটি কম্পোজিট ইউনিট হিসেবে, যা আগেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ বাগান ও বাগানের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত পক্ষের সব রকম চাহিদা পূরণের দায়িত্ব ছিল বাগান মালিকের। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রয়োগ হবার পর বাগান মালিকের সাথে কর্মচারীদের সম্পর্ক শুধু শ্রম ও মুজুরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। বাকি দায়িত্ব থেকে বাগান মালিক হাত ধুয়ে নেয়। ধীরে ধীরে বাগান হয়ে ওঠে মালিক পক্ষের মুনাফা লাভের যন্ত্র। পূর্বেকার বাগানীয়া সম্পর্ক উবে যায়, শুধু শোষণ প্রাধান্য পায়। মালিক পক্ষ বাগানের কোনো রকম উন্নতির কথা না ভেবে যত বেশি সম্ভব মুনাফা অর্জন করতে করতে একসময় বন্ধ করে দিয়ে বাগান ছেড়ে চলে যায়।
চতুর্থত, চা-বাগানে সর্বশেষ আঘাত আসে নতুন গড়ে ওঠা ছোটো চা-বাগান থেকে। নিশ্চিত উপার্জনের আশায় বিঘার পর বিঘা চাষের জমিতে চা-বাগান গড়ে উঠেছে। পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠে বটলিফ ফ্যাক্টরি। ছোট ছোটো বাগানগুলো লেবার পার্চেস করে চায়ের পাতা তুলে বটলিফ ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করে দেয়। এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে যেখানে বাগান, ফ্যাক্টরি, শ্রমিক সব পক্ষ আলাদা আলাদা ইউনিটে পরিণত হয়। যার বাগান থাকে তার ফ্যাক্টরি থাকে না, যার ফ্যাক্টরি থাকে তার বাগান নেই। উভয় পক্ষই প্রয়োজনীয় শ্রম পার্চেস করে নেয়। অর্থাৎ বাগানের পূর্বেকার কম্পোজিট কন্সেপ্ট ভেঙে চূড়মার হয়ে যায়। পাশাপাশি এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত বাগানের উৎপাদনের চাহিদার ওপর ভাগ বসায় এবং বাগানকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
পঞ্চমত, চা-বাগানগুলো প্রতিষ্ঠার পর ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতির কোনো আধুনিকীকরণ না হওয়াও বাগান ধ্বংসের অন্যতম কারণ। বহু মালিক আছে বাগান দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে অন্যত্র ব্যবসায় খাটাচ্ছে এবং বাগানে এক টাকাও বিনিয়োগ করছে না। ফলে বাগান যখন মুনাফা দিতে পারছে না তখন মালিক বাগান ছেড়ে পালিয়েছে। শ্রমিক রোষের মুখে পড়েছে উপন্যাসের চরিত্র কৃৃষ্ণচূড়ার বাবার মতো সাধারণ বেতনভুক কর্মচারীরা।
উপন্যাসের পাতা যত উল্টেছে চা বাগানের মতোই বহু স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যেমন হয়ে উঠেছে সনৎ জেঠুর কথা। সময়টা নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক। সদ্য স্কুল উত্তীর্ণ আমি ভর্তি হলাম আলিপুরদুয়ার কলেজে। জড়িয়ে পড়লাম ছাত্র রাজনীতিতে। সহপাঠী হিসেবে পেলাম সনৎ জেঠুর ছেলেকে। ছাত্র রাজনীতির সম্পর্কের সূত্র ধরেই গাঙ্গুটীয়া চা বাগানে সনৎ জেঠুর কোয়াটার্সে আসা যাওয়া। সনৎ জেঠুর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে কখন যে পরিবারের একজন হয়ে উঠলাম টের পাইনি। সনৎ জেঠু যেভাবে চা বাগান, শ্রমিক, তাদের দুর্দশাকে দেখেছেন সেভাবে আর কজন দেখেছেন তা বলা মুশকিল। এই মানুষটিই যদি রাজধানী শহরে থাকতেন তাহলে তার লেখালেখি, সঙ্গীত সাধনার জন্য নিশ্চই রাজ্যবাসীর নজর কাড়তেন। নায়কের মতো চেহারা নিয়ে শ্রমিকের মাঝে নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন সারাজীন। একেই তো বলে 'ডি-ক্লাস' হওয়া।
দিগদার (দিগন্ত সান্যাল) সাথে চামেলির সম্পর্কের উষ্ণতা বোঝাতে গিয়ে লেখক যে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন তাতেও রয়েছে পাঠকের একরাশ মুগ্ধতা। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাতের ভয়ঙ্কর রূপ লেখকের কলম থেকে বেড়িয়ে এসেছে। পাঠক যখন উপন্যাস ও ব্যাক্তিগত অতীতে মাখামাখি, উপন্যাসের পাতা যখন সযত্নে উল্টোচ্ছেন আর বার বার দেখে নিচ্ছেন আরো কত পাতা বাকি আছে, আরো কতশত ফেলে আসা অতীতে লেখক পাঠককে নিয়ে যাবেন ঠিক তখনই হঠাৎ কান্নার শব্দে অন্তরীক্ষের ঘুম ভেঙে যায়, চামেলি মাটিতে গড়াগড়ি খায়, অন্তরীক্ষ খুনিয়া মোড়ে ফিরে আসে, পাঠককে হতাশ করে এবং সে নিজেও বিড় বিড় শুরু করে আর কটা পাতা লেখা যেত না!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴