রিসর্টের সাদা চাদর/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
রিসর্টের সাদা চাদর
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কাদম্বিনী রিসর্টের ছয় নম্বর ঘরের জানলা দিয়ে মূর্তি নদীর রিভারবেডের একটা অংশ দেখা যায়। বেশ কিছুদিন ধরে এই অঞ্চলে নদীর বালিপাথর তোলা নিয়ে অশান্তি চলছে। বিকেলে নদীর জলে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে একজন স্থানীয় মানুষ বলল, " এর পরের বার এসে এই পাথরটা নাও পেতে পারেন। এটাও বিক্রি হয়ে যাবে। "
সব জানলায় মশারীর নেট লাগানো থাকলেও, জানলা দিয়ে নদীটা সম্পূর্ণ দেখা যায়। সারা দিনই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও গাছের থেকে টুপটাপ করে জল পড়তে থাকে। মাথায় টুপি থাকলে অবশ্য এই সমস্যা হয় না। এবার বের হওয়ার সময় টুপি নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম। গতকাল রাতে যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছিল বলে সেটাকে ভেজিয়ে দিয়েছিলাম। একটু বেশি রাতে বৃষ্টি কমলে দুটো পাল্লাই হাট করে খুলে দিয়ে পূর্ণিমা চাঁদের অপরুপ শোভা দেখছিলাম। নদীর জলের ওপর চাঁদের আলোর ছটা এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। জলের স্রোতের ওপর পড়া আলো ভেঙে দিচ্ছিল দেবদারু গাছের কেঁপে ওঠা পাতার ছায়া গুলো। রিসর্টের কর্মী সুকুমার বার বার সতর্ক করে দিয়েছিল যাতে আমি জানলা খুলে রেখে না ঘুমিয়ে পড়ি। সারা রাত এপাশ ওপাশ করাই সার হল। গোটা দুই কবিতা লিখলাম। কয়েকটা ফটোয় লাইক দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। বাইরের কাঠের পাটাতনে হঠাৎ অসতর্ক পায়ের আওয়াজ পেলাম।একটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ এবং বিলিতি মদের গন্ধ পেলাম। খালি থাকা পাঁচ নম্বর ঘরের সাহেব বোধ করি চেক ইন করলেন। সাথে তার মহিলা সঙ্গীটি একটু বেশিই পান করে ফেলেছেন। তার পায়ের তোড়ার শব্দের মধ্যেও একটা অসংলগ্ন ভাব। কথাবার্তা বিশেষ কিছু শোনা গেল না। কিছু ক্ষণ তাদের ঘন ঘন নি:শ্বাস পেলাম। তারপর কখন যেন আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
এখানে সি সি ক্যামেরা আছে, এখানে আপনার খাম নেওয়া যাবে না। আপনি একটু সোফায় বসুন।
রিসেপশনিস্ট এর কথাটা সরাসরি যেন আমার কানে এসে পৌঁছল। আমি আড়ামোড়া কেটে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখান থেকে রিসর্টের সামনের বাগানটা পরিস্কার দেখা যায়।
"আপনিই তো কমলিকা ম্যাম? এই খামের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। মিস্টার সরকার এটা পাঠিয়েছেন। " ছেলেটি বলল।
আমি ব্রাশ করতে করতে একটু সামনের বাগানে নেমে গেলাম। এখনও পাঁচ নম্বর রুমের গেষ্ট বিকট শব্দে নাক ডাকাচ্ছেন। দরজার বাইরে অবশ্য শ্রী লেদার্সের একজোড়া জুতোই খোলা রয়েছে। এখান থেকে কিচেনটা খুব কাছে। মালতি একগামলা সেদ্ধ আলু নিয়ে খোসা ছাড়াচ্ছে। মনে হয় ব্রেকফাস্টে আলুর দমের ব্যবস্থা হচ্ছে।
আমি একটু দূরে চলে গেলে একটু গলার স্বর নামিয়ে মালতি সুকুমারকে বলল, " আমার সন্দেহ এতদিনে সত্যি হল। এই কমলিকা ম্যাম আসলে....
হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি ব্রাশ করে ঘরে ঢুকতেই মালতী প্লেটে করে আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে এল। লুচি আলুর দম আর একটা পেল্লাই সাইজের চমচম। সেটা দেখতে অনেকটা বেলাকোবার চমচমের মতোই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সাত সকালে টাকার খাম নিয়ে যে যুবকটি এসেছিল তার নাম দীনবন্ধু।
সেবার তেল কোম্পানির এক অফিসার হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। গায়ে জ্বর নিয়ে ফোন করল কোথায় ডাক্তার পাওয়া যায় বলুন তো? আসলে গরুমারা ন্যাশনাল পার্কে ৭৮ টা রিসর্ট থাকলেও ডাক্তার বা ওষুধ সেভাবে পাওয়া যায় না। ডাক্তার থাকলেও সেভাবে প্রচার না থাকায় টুরিস্টরা তাদের ওপর ভরসা করতে পারে না। আমি যতই বলি ময়নাগুড়িতে আপনাকে ডাক্তার দেখিয়ে দিচ্ছি কিন্তু তিনি শিলিগুড়িতে ই যাবেন। সঙ্গে করে কিছু অষুধ নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই গুলোতেই তার অনেকটা অসুখ কমে গেল। তিনি বলেই ফেললেন, " জঙ্গলে কখনো একলা আসতে নেই। সেবার আপনার বৌদিদের নিয়ে এসেছিলাম। সবাই মিলে আমরা যেখানে সেলফি নিয়েছিলাম এবার সেখানে একটা হনুমান লেজ দুলিয়ে বসে আছে আর কয়েকটি কুকুর তাকে ঘিরে ঘেউঘেউ করছে। "
এই অঞ্চলটায় একটু বেশি ঘন সবুজ অরণ্য । সন্ধ্যায় এখানে আদিবাসী নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। একবার একটা চিতাবাঘ একটা বাছুর মেরে ফেলেছিল। আমি অন্য সব বন্ধুদের নিয়ে এগিয়ে চললাম আমাদের কোম্পানির সভাকক্ষের দিকে।
আমি জঙ্গল ঘুরে যখন দুপুরের খাওয়ার জন্য রিসর্টে এলাম তখন হাউজ কিপিং এর ছেলেটা ঘর পরিস্কার করছে। পাঁচ নম্বর ঘর থেকে জোরে বলে উঠলো, এই রুমের বিছানার চাদরটা না পাল্টালেও হবে। বম্বে ডাইং এর ধবধবে সাদা চাদরটার ইস্তিরির দাগ আগের মতোই আছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴