রিকিসুম/উত্তম চৌধুরী
রিকিসুম
উত্তম চৌধুরী
পাহাড়,জঙ্গল, ঝরনা, নদী, ঝোরা, খোলা ভীষণ টানে। এক অদ্ভুত নিশিডাকের মতো। মাঝে মাঝে বেরিয়ে না পড়লে বেশ হাঁপিয়ে উঠি কংক্রিটের কয়েদখানায় বা শব্দের শৃঙ্খলে। একদিন সদলবলে বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য রিকিসুম। নামটি আমার কাছে নতুন। মূল উদ্যোক্তা পরিবেশ প্রেমী শিবুন। নির্দিষ্ট সময়ে পাহাড়ি রিকিসুমে পৌঁছানোর পর স্বর্ণ শিখর হোম স্টেতে থাকার ব্যবস্থা হল। পাহাড়ের ধাপে ধাপে অনেক সুসজ্জিত ঘর। ধূপি কাঠের বেড়া, দরজা, জানালা, শৌখিন আসবাব। পাহাড়ি অজস্র ফুলে সাজানো বারান্দা। পিটোনিয়া ও প্যানজি ফুল স্বাগত জানায়। প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি। সামনেই পাহাড়ের পর পাহাড়।মেঘের খেলা নিরন্তর। ছবির মতো সব। নীচে রাস্তা দিয়ে পাহাড় কাঁপিয়ে সশব্দে ছুটে যাচ্ছে আধুনিক যান।
বিকেলের দিকে কয়েকজন হাঁটতে বেরিয়েছি। পথেই সিদ্ধান্ত হল রিকিসুম ভিউ পয়েন্টে যাওয়া হবে। সেভাবেই হাঁটছি। বেশ চড়াই পথ।এবড়ো খেবড়ো। দু'পাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগোচ্ছি।ধূপিবনের ধার দিয়ে রাস্তা। অনির্বচনীয়। আমরা গল্পে গল্পে অনেক দূর এসেছি, কিন্ত কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছোতে আরও অনেক সময় লাগবে। এক জায়গায় এসে থেমে যেতে হল যেহেতু সন্ধ্যা নামছে। আমরা ফিরছি। এবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষে জঙ্গলের আঁকাবাঁকা সঙ্গিন ও সংক্ষিপ্ত পথ ধরে। সাবধানে নামছে সবাই। কেউ কেউ গাছের শুকনো ডাল হাতে তুলে নিয়েছে শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য। কেউ আবার হাত ধরে অন্যকে নামিয়ে দিচ্ছে।যেন আমরা সবাই ট্রেকিঙে। ভিডিও করছে দু'একজন।একদম নীচে নামার আগে দুটো কবর দেখা গেল। কেউ কেউ বলল যে এগুলো রিকি এবং সুমের। কাছে গিয়ে কবরে উৎকীর্ণ লেখা পড়ে বোঝা গেল--- না, অন্যদের।
পরের দিন সকালেই গাড়ি চেপে বেরিয়ে পড়েছি রিকিসুমে যাওয়ার জন্য। দুটি ইউ টার্নিং-এর পর পৌঁছে গেলাম সেখানে। এই পাহাড়ের উঁচুতে একটি সমতল জায়গা।অসামান্য। এখানে বৃটিশ আমলের তৈরি বাংলোবাড়ি ছিল। ঘিসিং-এর আমলে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্বংসাবশেষ। মোজাইক করা পাথরখণ্ড দেখা গেল অনেক। পাশেই ন্যাওড়া ভ্যালি।যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজের অকৃপণ হাতছানি। দূরে নদী।এখানে প্রচুর ছবি তোলা হল। পাহাড়ের এমন শীর্ষে এসে নিজেদের মুক্ত পাখির মতোই ভাবল কেউ কেউ। কেউ গুনগুনিয়ে দু'এক কলি গেয়েও উঠল।কিন্ত সেই আনন্দের মধ্যেও বিষাদের সুর একারণেই যে এখানে ৭০ বছর আগে রিকি ও সুম নামে ভাই এবং বোন দুজন আগুনে পুড়ে মারা যায়। সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম রিকিসুম। ধূপি গাছের মুকুট পরা এই পাহাড়ের স্মৃতি এবং পাহাড়ের নামকরণের পেছনে যে মর্মন্তুদ কাহিনি তা আমৃত্যু মনে থাকবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴