সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী/ভাস্বতী শ‍্যাম চৌধূরী

রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী
ভাস্বতী শ‍্যাম চৌধূরী 

বিগত  আন্তর্জাতিক নারী  দিবসের পর বাংলার মহীয়সী নারীদের  কথা    বলতে ইচ্ছে হলো। বাংলায় এমন অনেক নারী আছেন যাদের কথা কেউ জানে না, ইতিহাসের পাতায় ওনাদের নাম  নেই ।কিন্তু একসময় এই বীরাঙ্গনা নারীরা বহিঃশক্তির  হাত থেকে  বাংলাকে  রক্ষা করেছেন ।ইতিহাসে উপেক্ষিতা হলেও তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এরকমই একজন নারীর কথা আজকে বলবো, তিনি ছিলেন রাণী  ভবশঙ্করী, অধুনা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে অপরিচিতা কিন্তু অবিভক্ত বাংলায়  আফগান, পাঠান এবং মুঘলদের কাছে এই নামটা ছিল আতঙ্কের।

১৫৫৬ সাল থেকে১৬০৫ সাল পর্যন্ত      আকবর  ছিলেন দিল্লির সম্রাট। তখন  বঙ্গভূমিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন‍্য মুঘল, পাঠান, আফগানদের মধ্যে  দ্বন্দ্ব চলছে, তারা লুটতরাজ  চালিয়ে বঙ্গভূমির মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল।

ওই সময়  বর্তমান হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর, বর্দ্ধমান  - এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে  গড়ে উঠেছিল "ভূরশুট" রাজ্য। এই রাজ্যের রাণী ছিলেন  ভবশঙ্করী। "ভূরিশ্রেষ্ঠ" থেকেই এই ভূরশুট নামটা এসেছে। এক সময় এলাকাটা ছিল শ্রেষ্ঠ বণিকদের বা ভূরিদের, তখন এই অঞ্চলে প্রবাহিত ছিল দামোদর আর রণ নদী, যার তীরেই গড়ে উঠেছিল বিশাল  বাণিজ্য। ভূরশুট রাজ্যেই রাণী ভবশঙ্করী  রাজত্ব করেন।তার পিতা দীননাথ চৌধুরী ছিলেন, পেঁড়োর জমিদারের অধীনস্থ  সেনাপতি ।লম্বা চওড়া মানুষ  দীননাথ ছিলেন রণকৌশলে  অত্যন্ত দক্ষ।এই পেড়োতেই ভবশঙ্করীর জন্ম।  ছেলেবেলায় তিনি মাকে হারান। তাই  শৈশব ও বাল্যকালে পিতার কাছথেকে তিনি অস্ত্রবিদ্যা, ঘোড়ায় চড়া  ও ধনুর্বিদ‍্যা শিক্ষা লাভ করে পারদর্শী হন।  রাজনীতি,কূটনীতি,সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের পাঠও নেন।

কথিত আছে একদিন যুবতী ভবশঙ্করী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে শিকারে যান। হঠাৎই হরিণ তাড়া করতে গিয়ে, বুনো মহিষের দল তাকে আক্রমণ করে, ভবশঙ্করী একা হাতে মহিষদের বধ করতে সক্ষম হন। ওই সময় ভূরশুটের রাজা রুদ্র নারায়ন নদীপথে  নৌকো করে যাচ্ছিলেন, এই কন‍্যার  শৌর্য ও বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি মনস্থির করেন, এই মেয়েটিকেই  বিবাহ করবেন। রাজা রুদ্র নারায়ণ ভবশঙ্করীর পিতাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন।তারপর রাজা রুদ্রনারায়নের সাথে ভবশঙ্করী বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের  পর তিনি রাণী ভবশঙ্করী হন। তিনি রাজকার্যে তার স্বামী রাজা রুদ্রনারায়নকে সাহায্য  করতেন।

বিবাহের পর দামোদর নদীর তীরে গড় ভবানীপুরে নতুন  রাজবাড়ী  তৈরি হয়। ভূরশ্রেষ্ঠ রাজবংশের কূলদেবী ছিলেন রাজবল্লভী,যা মাতা চণ্ডীর আর একটি রূপ। দেবী রাজবল্লভীর নাম অনুসারেই ভূরশ্রেষ্ঠ রাজ্যের  পুরনো রাজধানী "রাজবলহাটের" নামকরণ হয়।ধার্মিক রাণী রাজবল্লভীর অষ্টধাতুর মূর্তি নির্মাণ করে, মায়ের কাছে মানত করে, তিন দিন উপবাসে থেকে  ভবানীপুরের একটি পুকুরে স্নান করতে গিয়ে, সেখানেই তিনি লাভ করেন  মায়ের স্বপ্নাদিষ্ট তরবারি, যে তরবারি হাতে থাকলে  কোথাও কখনো তিনি পরাস্ত হবেন না, এই ছিল মায়ের বর। তাই রাণী ভবশঙ্করী শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন অপরাজিতা।

পরবর্তীকালে  ভবশঙ্করী জন্ম দেন রাজকুমার প্রতাপ নারায়নকে,যখন তার  বয়স পাঁচবছর, তখন মহারাজ রুদ্র নারায়ণের জীবন অবসান হয়। শোনা যায়  স্বামীর মৃত্যুর পর  ভবশঙ্করী তিন মাস ব্রহ্মচারিণী হয়ে শৈব সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন।রাজ পুরহিত রাণীকে অনুরোধ করেন প্রতাপনারায়ন প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত   রাজ‍্যশাসন ভার গ্রহণ করতে ।  
       
এরপর রানী ভবশঙ্করী রাজ‍্যশাসন ভারগ্রহন  করেন। সিংহাসনে বসে প্রথমেই রাজ‍্যের নিরাপত্তার দিকে নজর দেন। শক্তিশালী  করে তোলেন সামরিক  বাহিনী  ও নৌবাহিনীকে। মহিলা সামরিক বাহিনী  তৈরী করেন। জায়গায় জায়গায় দূর্গ স্থাপন করেন। তার সাহসিকতা ও শক্তির কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পরে। তখন পাঠান, মুঘল ও আফগানরা সারা ভারতবর্ষে নিজেদের প্রাধান্য  বিস্তার  করছিল কিন্তু  মহারাণী  ভবশঙ্করীর ভয়ে বাংলায়  আধিপত্য  বিস্তার  করা সম্ভব হচ্ছিল না।
                       
মহারাণী  ভবশঙ্করী রাজ‍্য বিস্তারের দিকেও মন দিলেন তখন হাওড়া হুগলী নিয়ে ছিল ভূরশুট রাজ‍্য। মহারাণী   বর্দ্ধমান ও  মেদিনীপুর নিয়ে এক বিস্তীর্ণ এলাকা  জুড়ে   সামরাজ‍্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।এইভাবে  মহারাণী ভবশঙ্করীর রাজত্ব কালে শৌর্যে, বীর্যে, বানিজ‍্যে, তাঁতশিল্প ও ধাতুশিল্পেত্র সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সমস্ত দিক থেকে ভুরশুট  রাজ‍্য ছিল  বাংলার শ্রেষ্ঠ রাজ‍‍্য।

মহারাণীর  দেওয়ান ছিলেন দূর্লভ দত্ত আর চতুর্ভূজ চক্রবর্তীকে মহারানী  প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত   করেন।  ঐ সময়  বাংলায় আধিপত্য  কায়েম নিয়ে মুঘল ও পাঠানদের মধ‍্যে দ্বন্দ্ব চলছিল।মুঘলদের তাড়া খেয়ে  পাঠানরা উড়িশায় আশ্রয় নিতে বাধ‍্য হয়। সেখান  থেকে আবার  বাংলায় আধিপত‍্য বিস্তারে সচেষ্ট হন পাঠান সর্দার ওসমান  খান। রাণী ভবশঙ্করী পাঠান_ মুঘল দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ ছিলেন।কিন্তু পাঠান সেনাপতি মুঘলদের বিরুদ্ধে রাণীর সাহায্য  চাইলে, রাণী ভবশঙ্করী তা নাকচ করে দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওসমান  খান রাণীর প্রধান সেনাপতি চতুর্ভূজ চক্রবর্তীকে  প্রচুর অর্থ দিয়ে হাত করেন।

গড় ভবানীপুর ছিল ভুরশুটের তদনীন্তন রাজধানী। সেখান থেকে ১৪ মাইল দূরে বাসডিঙাগড়ের কালীমন্দিরে   সন্ধ‍্যাবেলায় কয়েকজন দেহ রক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে   রানী ভবশঙ্করী পুজো দিতে যান। এই খবর  বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি  চতুরর্ভূজ চক্রবর্তী  ওসমান  খানকে দিয়ে দেন।ওসমানখান বিপুল সেনাবাহিনী  নিয়ে,রাণী ভবশঙ্করীকে আক্রমণ করেন। কয়েকজন দেহরক্ষী   নিয়ে রাণী সারারাত পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাঠানদের পরাজিত  করেন ও ওসমান  খানকে নিহত করেন। এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, মুঘলরা তখন বাংলায় ছিলেন।

মুঘল সম্রাট আকবর,এই ঘটনা জানতে পেরে তার সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় রাজ‍্য বিস্তার করতে নিষেধ করেন, এবং তাকে রাণী ভবশঙ্করীর কাছে পাঠান। দুপক্ষের মধ‍্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ  চুক্তি  হয়, ঠিক হয় কেউ কারোর রাজ‍্য আক্রমন করবে না। এইসময়ই সম্রাট আকবর বীরাঙ্গনা রাণী ভবশঙ্করীকে "বায়বাঘিনী" উপাধিতে ভুষিত করেন।
    
সারা জীবন বীরত্বের সঙ্গে রাজ‍্য শাসন     করে  শেষ বয়সে রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী রাজপুত্র  প্রতাপ নারায়নের হাতে রাজ‍্যভার দিয়ে কাশীতে গিয়ে সন্ন‍্যাস জীবন যাপন করেন।

 এই মহীয়সী নারী আমাদের সবার গর্ব  কিন্তু তার নাম বাংলার খুব কম মানুষ শুনেছেন, কারণ দীর্ঘদিন  উনি ইতিহাসে  উপেক্ষিতা ছিলেন। আমরা  ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের  কথা সবাই জানি তার বীরত্বের কাহিনী  আমাদের মুগ্ধ করে। অথচ আমাদের বাংলায় এমন একজন বীরাঙ্গনা নারী জন্মেছিলেন যাকে কোন  সম্মান  দেওয়া হয়নি।  তবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে  উদয়নারায়নপুরে অনুষ্ঠিত হয় "রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী" মেলা। সেখানে রায়বাঘিনী মন্দিরও  আছে।গড় ভবানীপুরকে এখন পর্যটকদের  জন‍্য সাজিয়ে  তোলা হচ্ছে। এত দিনে এই বীরাঙ্গনা রাণী রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী বাংলার মানুষের কাছে স্বীকৃতি  পাচ্ছেন।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri