রবি তুমি আর ঠাকুর থেকো না/বিমল দেবনাথ
রবি তুমি আর ঠাকুর থেকো না
বিমল দেবনাথ
রবি-মাসে আমার এক পাগলের কথা মনে পড়ে। সেকালের কথা একালে মনে ঝড় তোলে। এক পঁচিশে বৈশাখে, বাঁদরলাঠি গাছের হলুদ ফুলের মঞ্জরী নিয়ে যখন স্কুলে যাচ্ছিলাম, পাগলটা ছুটে এসে দুহাতের দশ আঙুল দেখিয়ে, মুখে এক অজানা আকৃতি এনে দাঁত কেলিয়ে ভয় দেখিয়ে বলেছিলো– ‘তোতা পাখি’। আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে গেছিলাম স্কুলে। দেখলাম ঠাকুরের ফটো, আমার থেকেও বড়। এক মাথা চুল আর এক গাল দাড়ি। গলা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা পোষাকে ঢাকা। ভুরু বরাবর সুন্দর করে দেওয়া চন্দনের ফোঁটা। ফটোর উপর থেকে গলার দুপাশ দিয়ে নেমে গেছে রজনীগন্ধার মালা। যেন গলায় মালা পরানো হয়েছে। বাড়ির কৃষ্ণ ঠাকুর, স্কুলের সরস্বতী ঠাকুরকে যে ভাবে প্রণাম করি ঠিক সেই ভাবে, হলুদ ফুলের মঞ্জরী পায়ের কাছে রেখে দুহাত জোড় করে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রণাম করেছিলাম। পাগলটার ছবি বার বার ভেসে উঠেছিলো বন্ধ চোখে। এক মাথা চুল, এক গাল দাড়ি। কবেকার মলিন লম্বা পাঞ্জাবি জোব্বার মতো সারা শরীর ঢেকে রেখেছে পা পর্যন্ত। ছোট পায়ের দৌড় কি আর বড়দের মতো! রাস্তা থেকে স্কুল বাড়িটা কত যোজন দূরে মনে হচ্ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম, পাগলটা হাসতে হাসতে উচ্চ স্বরে বলছে-
where the mind is without fear and head is held high;
where knowledge is free;
where the world has not been broken up into fragments, by narrow domestic wall; ….তারপর হাতের তালুর উপরে ভর দিয়ে ডিগবাজী খেতে গিয়ে জোব্বা জড়িয়ে উলটে পড়ে গেল। অকুতভয় পাগলটা উঠে আবার গান করতে করতে পূর্ব দিকের বাঁশঝাড়েহারিয়ে গেল। পাগলটা গাইছিলো-
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলরে।…
গত এক মাস ধরে রবীন্দ্র জয়ন্তীর মহড়ায় দাদা-দিদিদের শুনে শুনে আমারও অনেকগুলো কবিতা গান মুখস্থ হয়ে গেছিলো। ‘আমাদের ছোট নদী’ যখন আবৃত্তি করছিলাম তখনও প্রতিটা মুহুর্তে নদীর পাড়ে, নদীতে, কাশবনে পাগলটাকে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। সময়ের সঙ্গে –“আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। খেলে যায় রৌদ্র-ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত” …জীবন গান গাইতে গাইতে কখন যে শুরু আর শেষ কাছে চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। তবে সেই পাগলটা অস্পষ্ট হলেও মিলিয়ে যায়নি। বড় হয়ে জেনেছি অনেক মেধাবী ছাত্ররা সত্তরের দশকে আন্দোলন করতে গিয়ে পায়ুদ্বারে দেড় ফুটের রুলার নিয়ে একলা হয়ে গেছে, পাগল হয়ে গেছে! কিন্তু পাগল হয়ে স্কুলের ছাত্রকে কেন তোতা পাখি বলবে! কেন ঐ কবিতা ও গান গাইবে। কর্ম জীবনের ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্ত অবকাশ হাঙ্গরের মতো গিলতে চায়। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা পদ্ধতিকে ব্যঙ্গ করে ‘তোতা কাহিনী’ লিখেছিলেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। ততদিনে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে গেছেন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি পরিত্যাগও করেছেন। বিশ্বে শুধু কবি হিসাবে নয়, একজন সুচিন্তক ও দার্শনিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। এই রূপ একজন মহান মনীষী যখন কৌতুক রসের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা কী রূপ হবে তার ইঙ্গিত করে গেছেন, তখন এখনও কেন শিক্ষা ব্যবস্থার এই হাল। পাগলটা কী ঠিক বলেছিল! আমি কি মনের মরা তোতা নিয়ে বড় হয়েছি? তা না হলে এত ঘোলা জল, এত আবর্জনা, এত মিথ্যাচারের মধ্যে কী করে বেঁচে আছি। বেঁচে কি আছি?... মনের তোতা বেঁচে থাকলে তার স্বর কোথায়? প্রতিবাদ? এখন যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের মনের তোতাও কি মারা যাবে? তা হলে ভবিষৎ কি হবে? আচ্ছা মনের তোতা মরে গেলে কি মানুষ একা হয়ে যায়। আচ্ছা রবি তুমি যখন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ … শিখিয়ে বীর বানালে তখন কেন আবার একলা চলার মন্ত্র দিলে! রবি একলা কি চলা যায়? একলা কি থাকা যায়? একলা থাকতে থাকতে যে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কী করব রবি … কিছু বুঝতে পারছি না! তুমি কেন ঠাকুর হলে! ওরা তোমাকে ফটোতে, মন্দিরে বন্দী করে ফেলছে। মন্দির, মসজিদ ও গীর্জার কোন ঠাকুর কি মানুষের পাশে হাঁটে? জানিনা। কিন্তু মানুষ মানুষের পাশে হাঁটে। আচ্ছা মনের তোতা মরে গেলে কি মানুষ মানুষ থাকে? রবি তুমি মূর্তি ভেঙে মনে মূর্ত হও । আমরা আবার মানুষ হই! তা না হলে পৃথিবীটা পাগলের বাসভূমি হয়ে যাবে। রবি তুমি আর ঠাকুর থেকো না, ফিরে এসো মানুষ হয়ে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴