রবি ঠাকুর : আমার অনুভবে আমার একাত্মতায়/মমতা পাল চন্দ
রবি ঠাকুর : আমার অনুভবে আমার একাত্মতায়
মমতা পাল চন্দ
এ পৃথিবীর জীবন পরিক্রমায় কিছু অনাত্মীয় রক্তের সম্পর্কহীন মানুষের সাথে এমন আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে মনে হয় যেন সেই আমার পরমাত্মীয়। আবার সমাজে কিছু যুগমানব - যুগপুরুষ থাকেন যারা অনির্বাণ ধ্রুবতারা হয়ে মানব জাতিকে পথ দেখান - পদতলে আশ্রয় দেন। এমনই এক সত্যদ্রষ্টা ব্রহ্মজ্ঞানী মহামানব যার কাছে নাড়া বাঁধা যায় - আশ্রয় খোঁজা যায় - চরম কষ্টে এতটুকু শান্তির সন্ধান করা যায় - নির্দ্বিধায় নিজেকে সমর্পণ করা যায় - আনন্দে অনায়াস অবগাহন করা যায় - অনুশোচনায় যার পায়ে লুটিয়ে পড়া যায় - যার সৃষ্টির ভেতরে নিজের অস্তিত্ব খোঁজা যায় - যার সহনশীলতায় নিজেকে উদীপ্ত করা যায় - যাকে অনুভবে - বিশুদ্ধতায়- আঁকড়ে বাঁচা যায় সেই আমার রবি ঠাকুর আমার আত্মার আত্মীয় - আমার ইহকাল, আমার পরকালের পরমাত্মীয় - জীবনের শেষ পারানীর কড়ি।
ও রবি ঠাকুর তুমি তো আমাদের জন্মের কত আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছ অথচ এত কিছু রেখে গেছ যে অনায়াসে একটি মানুষ তার জীবনের cradle to grave তোমায় আঁকড়ে বাঁচতে পারে। শিশু যখন মাটির দলার মত মায়ের হাসিতে হাসতে শেখে তখন থেকেই সে মায়ের কাছ থেকে তোমার বাণী আওড়াতে শেখে। মা বাচ্চাকে হাত নাড়ানো শেখাচ্ছেন " হাত ঘোরালেই নাড়ু দেবো, নইলে নাড়ু কোথায় পাবো!" সেই সঙ্গেই "আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ,
হিরে দাদার মড় মড়ে থান ঠাকুর দাদার বউ।" কিংবা " আকাশ ঘিরে মেঘ সূর্যি গেছে পাঠে,
খুকু গেল জল আনতে পদ্মদিঘীর ঘাটে।
পদ্মদীঘির কালো জলে হরেক রকম ফুল,
হাঁটুর নিচে দুলছে খুকুর গোঁছা ভরা চুল।"
মায়ের সাথে হেসে কুটিপাটি
শিশুর হাততালির সেই যে শুরু গো রবি ঠাকুর তোমার অরুন আলোর কিরণ আশীষে। তারপর সহজ পাঠের বর্ণ চেনা। এ যেন দাদুর হাত ধরে নাতির একপা দুপা করে থপ থপ করে মাটিতে পা ফেলে জীবনের পথে চলার শুরু। তারপর যখন ঘরের দেওয়ালে তোমার ছবি - ইস্কুল ঘরের এককোনে তোমার ইয়া বড় কাটআউট। পঁচিশে বৈশাখে তোমার কবিতা আবৃত্তি, ছড়া নাচ গান । "ফুলে ফুলে ঢলী ঢলী" শৈশব মানে 'state of innocence'. শৈশব গড়িয়ে কৈশোর থেকে জীবনের 'state of experience' কেমন একটা ঘোরের মধ্যে তোমার প্রতি এক আশ্চর্য ভালোবাসা টানের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু হয় আমাদের জীবনের।
কেমন করে এই মনুষ্য প্রজাতিকে তুমি বয়ে নিয়ে চলছো গো ? কেমন করে এমন হলে তুমি ? অমন ঋষিতুল্য বাবা আর দেবী স্বরূপা রত্নগর্ভা মা পেয়েছিলে বলে ? নাকি জ্যোতি দাদার মত অমন পথ প্রদর্শক পেয়েছিলে বলে? কাদম্বরী বৌঠানের মত অমন বান্ধবী পেয়ে ছিলে বলে? মৃণালিনী দেবীর মত সঙ্গী হারিয়ে ছিলে বলে? মেয়ে জামাইয়ের থেকে অমন কষ্ট পেয়েছিলে বলে? অকালে পুত্র হারিয়েছিলে বলে? এত আপনজনের মৃত্যু দেখেছিলে বলে ? নাকি তোমার মত অমন প্রাজ্ঞ ঋষিতুল্য মানুষ দম বন্ধ করা কষ্ট চেপে নিজের আপনজনদের নিভে যেতে দেখেছিলে বলে? কত বিরোধিতা? বুর্জোয়া কবির তকমা? 'শনিবারের চিঠি কল্লোল যুগীদের কত সমালোচনা ? সব কিছু আত্মস্থ করে তুমি হয়ে উঠলে এক ব্রহ্মজ্ঞানী দার্শনিক? জীবন হয়ে উঠল এক পরম তপস্যা? কোথায় পেয়ে ছিলে গো এত ধৈর্য্য -এত ধীশক্তি? এত কর্মশক্তি? চাইলেই কি অমন করে সকলের প্রাণ ছোঁয়া যায় গো? যে তোমার কষ্টগুলো - বেদনার বিন্দুগুলো ফুলের পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়েছে তোমারই সৃষ্টিতে -তোমার গানে - কবিতায়। যা প্রত্যেকটি মানুষের বেদনার বালুচরে বাড়ি সিঞ্চন করে আমাদের মনকে আর্দ্র করে তোলে। আর তখনই আমরাও এক লহমায় তোমার স্নেহস্পর্শে একাত্ম হয়ে উঠি - পরম আত্মীয়তা অনুভব করি এক সহজিয়া সুমিষ্ঠ ভাষায় - ছন্দের জাদুতে। তোমার অপত্যস্নেহ আমাদের আত্মিকভাবে স্বাধীন হতে শেখায়- আত্মনির্ভর করে তোলে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। তাই যত দিন যাচ্ছে হে রবি ঠাকুর তুমি তোমার উত্তরসূরীদের কাছে এই digitization এর যুগেও আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছো। তোমার মণি মানিক্য খচিত সৃষ্টির বিভিন্ন বিচিত্র ধারা অমলিন আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের নিত্য দিনের জীবনাচরণে। নতুন করে তোমার সৃষ্টির মূল্যায়ন হচ্ছে নব প্রজন্মের হাত ধরে। যা মুছে দিচ্ছে আমাদের সব মলিনতা - মানসিক গ্লানি। হে গুরুদেব
"তোমাতে রয়েছে
কত শশী ভানু
হারায় না কভু অনু পরমাণু,
আমার ক্ষুদ্র হারাধনগুলি
রবে না কি তব পায় ?"
হে কবি আকাশে বাতাসে দুঃখ বেদনায় তুমি আনন্দ রূপে বিরাজ। ঈশ্বরকে তো দেখতে পাইনে। কিন্তু তোমার গানে কবিতায় যে দর্শন যে জীবনের দেবতাকে খুঁজে পাই - সে আশ্রয় তুমি তুলে নিও না। কেননা অনুভবে তোমাকে অনুসরণ করে তোমারই মত বলি -
"বিশ্বসাথে যোগে
যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার
সাথে আমারো।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴