রঙিন রূপকথার গল্প/শ্রুতি দত্তরায়
রঙিন রূপকথার গল্প
শ্রুতি দত্তরায়
প্রিয় বান্ধবী,
কত বছর পরে তোকে চিঠি লিখতে বসলাম। শেষ কবে যে তোর সঙ্গে এভাবে কাগজে কলমে পত্রালাপ করেছি, মনে পড়ে না। কিন্তু আজ হঠাৎ কি যে হল। শেষ বসন্তের কর্মহীন, অলস-উদাস দুপুরে বারান্দায় বসেছিলাম আপন খেয়ালে। সিঁড়ির কাছে, সামনের রাস্তায় তখন খেলা করছিল বেশ কিছু ঝরা বাদামী পাতা,,,,চৈত্র পবনে। ধুলো মাখা, ঘোলাটে, ঝিম ধরা আকাশ আর দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের তানে মনটা যেন কেমন করে উঠল। তোর-আমার ফেলে আসা মেয়েবেলার দিনগুলো চলচ্ছবির মত ভেসে উঠল দুই চোখের পাতায়। দেখতে পেলাম দুটি সরল কিশোরীকে। এমনই কত চৈত্র দুপুরে কোন এক সময় তারা তাদের মুহূর্তগুলো কাটিয়েছে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বার্তা লেখায় এবং আঁকায়। তোর মনে পড়ে,,,তখন নববর্ষের দিনটিতে পরস্পরকে কার্ড দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভাল লাগা মিলে মিশে থাকত। দোকানে দোকানে যদিও ঝুলত ছাপানো নতুন কার্ডের পশরা, কিন্তু সেই সব প্রলোভনকে উপেক্ষা করে আমরা কিন্তু তখন ব্যস্ত থাকতাম নিজেদের সৃজনশীলতার চর্চাটুকু নিয়েই। সদ্য কেনা ড্রইং শিট নিজেরাই কাঁচি দিয়ে সাইজ মত কেটে, পেন্সিলে স্কেচ করে, "প্যাস্টেল কালার", রঙীন "স্কেচ পেন" ইত্যাদি দিয়ে কখনও বা আঁকতাম ফুলের ঝাড়, কখনও বা গ্রামের দৃশ্য। আর আমাদের মধ্যে যারা শিল্পী হিসেবে একটু বেশিই হাত পাকিয়েছিল, তারা ক্যামলিনের জল রঙে তুলি বুলিয়ে ফুটিয়ে তুলত নানা কায়দার ফিগার সহ ছবি। তবে তোর-আমার মত কাঁচা হাতের শিল্পীরা কাগজ কেটে রাশিয়ান ব্যালে ডান্সারদের নাচের ফিগার কার্ডে বসিয়ে জল রঙের প্যালেটে পুরোনো দাঁতের ব্রাশ ডুবিয়ে সহজেই করে ফেলতাম স্প্রে পেন্টিং। কিন্তু কার্ডের ওপরের কারিকুরি যাই হোক না কেন, ভেতরের লেখার গত কিন্তু প্রায় একই ছিল। মনে পড়ে সেই চার লাইনের কবিতাখানা? প্রায় সব কার্ড খুললেই যেটা পড়া যেত?
"গাছে গাছে ফুল ফুটেছে,
নববর্ষের ডাক এসেছে
তুমি আমার বন্ধু হও,
নববর্ষের কার্ড নাও।।"
রঙ-বেরঙের অক্ষরে, দু একটি ভুল বানানে ভরা, এক-লা বৈশাখের সেই সাদামাটা কাগজ খন্ডটা তখন আর শুধুই একটুকরো কাগজ থাকত না। হয়ে উঠত ভালবাসা ও শুভেচ্ছা ভরা এক একটি রঙিন রূপকথার গল্প।
তোর-আমার মত পাড়াতুতো বন্ধুরাই যে পারস্পরিক এই শুভেচ্ছা বিনিময় করতাম তা তো নয়। স্কুলের বন্ধুরা, এমনকি দূরদূরান্তে থাকা তুতো ভাই বোনেদের তরফ থেকেও ডাকযোগে এই দিনগুলোতে সদর দরজায় এসে পৌঁছাতো লাল,নীল, গোলাপী খামে ভরা এমনই একঝাঁক খুশি। সেইসব খাম খুলে খুলে দেখার মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য ভাল লাগা ও রোমাঞ্চ। আর তারপর???? মনে পড়ে??? আমরা গুনতি করতে বসতাম __ সে বছর সর্বমোট কতগুলো কার্ড আমাদের প্রত্যেকের ভাগ্যে জুটল। যেন কার্ডের পরিসংখ্যানই প্রমাণ করবে ভালবাসার দাঁড়ি পাল্লায় কার কত ভারী ওজন। কি নিখাদ সরলতা মাখা দিনগুলো ছিল রে আমাদের!! আজকের এই বিশ্বায়নের বাজারে মানুষ যখন নিতান্তই গেজেট সর্বস্ব হয়ে পড়েছে, ছোট্ট ছোট্ট বোতামে চাপ দিলেই যখন অতি সহজেই পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই পৌঁছে যেতে পারে "রেডিমেড" ছবি ও শুভেচ্ছা বার্তা, তখন তোর-আমার সেই কবেকার ফেলে আসা মেয়েবেলার ওই বাসন্তী দিনগুলোকে যেন কালের নিয়মে গতজন্মের কথা বলে ভ্রম হয়।
আজ যখন একাকী বসে শেষ চৈত্রের তপ্ত বাতাসে অনুভব করছি বৈশাখের স্পর্শ,,,,, চেয়ে রয়েছি দূরের ছাই রঙা আকাশের দিকে,,,,দেখতে পাচ্ছি গাছেদের মাথার কচি সবুজ গম্বুজগুলোর মন্থর দোলন,,,,তখন এক অজানা স্বপ্ন স্বপ্ন আমেজ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে আমাকে। বসন্তের উদাসী হাওয়ায় ঝরে পড়া মুকুলের দল যেমন উড়ে যায়,,,তেমনই সামনের পথ দিয়ে যেন আজ দেখতে পাচ্ছি "টুকি" বলেই কোথায় লুকিয়ে পড়ছে তোর-আমার কিংবা আমাদের মতো কত কত জনের ফেলে আসা শৈশব,,,,কৈশোর।
আজ তবে এখানেই শেষ করছি। ভাল থাকিস তুই। আগামী বছরটা তোর আনন্দময় হয়ে উঠুক, বৎসরান্তে এই শুভেচ্ছাটুকু থাকল তোর জন্য।
ইতি,,,,,,
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴