যে যেখানে দাঁড়িয়ে/অনসূয়া সরকার বিশ্বাস
যে যেখানে দাঁড়িয়ে
অনসূয়া সরকার বিশ্বাস
১
সারাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। জানলার ধারে এসে দাঁড়ায় সহেলী। পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে একটা কাক ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে।আজ যে সহেলীর কি হল কে জানে! শুধু কী আজ? নাকি প্রতিদিন?
২
"মা! ও ও মা! আজ তো পঞ্চমী।
আজই ঠাকুর চলে আসবে! কাল বিকেল থেকে "নো এন্ট্রি "। তাহলে কিন্তু এগারোটার পর! বাবার স্কুটারে! তুমি তো ধ্যারধ্যারে স্কুটারে যেতে চাও না! উঁহু যেতে হবে কিন্তু!"
"আহ! তোমার পড়া নেই নাকি বিট্টু? পড়াশোনা না করলে বাবার তবু সেকেন্ডহ্যান্ড স্কুটার জুটেছে, তোমার ভাঙা সাইকেলও জুটবে না! যাও পড়তে বস!"
"ও মা তুমি যাবে না তোমার ফ্রেন্ডসদের সাথে রিইউনিয়নে?"
"যা _বো -না! পড়তে বস। (বেশ জোর গলায়)"।
পাশের ঘর থেকে সহেলীর শাশুড়ি বলে উঠলেন, "আহা বৌমা কতবার বলেছি না আমার দাদু ভাইকে সকাল সকাল উঠেই বকবে না! যাও না একটু ঘুরেই এসো! দুপুরে তো সব হয়েই যায়! আমি, নিরু আছি তো নাকি! বৌমার বিছানায় বসে নলিনীদেবী বলতে থাকেন "বৌমা ! 'ভাত - কাপড়ের' শাড়িটা পরে যেও! ওটা তোমায় খুব মানায়!"
সহেলী খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে "তাই তো আমার বন্ধুদের আর অত ভালো শাড়ি আছে নাকি? ওরা এত ভালো শাড়ি তো চোখেই দেখেনি"!
নলিনীদেবী খানিকটা সংকুচিত হয়ে বেরিয়ে যান।
৩
বর্তমানে সুনীলের ব্যাবসাটা পড়তির দিকেই। অভাবের সংসারে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় হাড় _ভাঙা খাটুনি। সন্ধ্যার দিকে আবার সহেলীর টিউশনব্যাচ আসতে শুরু করবে। অলসভাবে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা ঝাড়তে-ঝাড়তেই তোশকের তলা থেকে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট দুটো ডেয়ারী মিল্ক। একটা চিরকুটে জড়ানো। তাতে লেখা "একটা বিট্টুর আর আরেকটা বিট্টুর মায়ের জন্য। হ্যাপি বার্থডে!" চকোলেট দুটো নিস্পৃহ ভাবে টেবিলের পাশে তুলে রাখে। সেকেণ্ড হ্যান্ড স্মার্টফোনটাতে পিক-পিক করে এক এক করে নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। কালই সুনীল নেট প্যাক ভরে দিয়েছে। অভাবের সংসার হলেও সহেলীর জন্য এসব ছোটখাটো বিলাসিতা করেই ফেলে সুনীল।
৪
তৃণা: "সহেলী আর শ্রুতকীর্তি আসবে তো রে!"
মেঘনা: "শ্রুতি তো আসবে। আর সহেলীর বর সুনীলের দোকানটা আমাদের পাড়াতেই, ও বলেছে, বউ কে পাঠাবে!"
তৃণা: "এখান থেকে কিন্তু সোজা 'টক _ঝাল_ মিষ্টি' তে যাবো! তারপর সিনেম্যাক্স! ওই তো সহেলী আসছে! কী সুন্দর ছিল বল! আমাদের ফার্স্ট গার্ল। তেমন নাচ করত! গ্র্যাজুয়েশনটাও কমপ্লিট না করে মুদির দোকানদারকে বিয়ে করে নিজেই নিজের পায়ে কুড়োল মারল!"
মলি: "মুদির দোকান তো কী? আমার বর তো স্কুলটিচার ছিল! মার সহ্য করতে না পেরে তো মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।"
মেঘনা: "ওভাবে বলিস না! ওর বরকে আমি চিনি।খুব কেয়ারিং। খুব ভালো। আমার কর্তার থেকে তো শতগুণে ভালো।
আরে আয়! আয়! সহেলী ! কত্ত দিন পর দেখলাম।একই আছিস। আমরা তো মুটিয়ে গেছি। সেই যে কাকুর বাৎসরিকে দেখেছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কাকিমাও চলে গেলেন!"
সহেলী: "সবই আমার ভাগ্য! আমার উপর রাগ করেই… হয় তো!"
মেঘনা: "ছাড় তো! জানিস শ্রুতকীর্তি আসবে! কী যে সুন্দরী হয়েছে না! ওয়েল মেইনটেইন্ড। রেডিও জকি, নিউজ রিডার কত্ত কিছু যে করছে! অর্ঘ্যদা তো মাথায় করে রেখেছে! কাল বার্থডে পার্টির পিকগুলো দেখছিলাম! যা একটা ডায়মন্ড রিং দিয়েছে না ওর বর!"
তৃণা: "গতবার একটা ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট! আর আমার বর? চাকরী করি বলে একটা পুঁতির মালাও দেয়না! এই সহেলী কিছু বল। চুপ চাপ কেন? শরীর খারাপ নাকি?"
সহেলী: "মাথাটা খুব ধরেছে রে! আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না রে!"
৫
রাজস্থানী কারুকার্য মন্ডিত সদর দরজাটা খুলে যায়। সহেলী ঢুকে পরে ১৬০০ স্কয়ার ফিটের অন্দরমহলে। 'এল' আকৃতির বিশাল বৈঠকখানা। তার সঙ্গে লাগোয়া ড্রয়িং রুম, লিভিংরুম, কিচেন, বাথরুম আর ছোট্ট ব্যালকনি। পুরো ফ্ল্যাটটার ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের পরতে পরতে রয়েছে প্রাচুর্য্য আর শৌখিনতা। দুধ সাদা মার্বেল ফ্লোর, পার্শীকাজের কার্পেটে মোড়ানো। বেজ রঙের গা ডোবানো নরম গদি আঁটা সোফা। আর তাতে রয়েছে নানা রঙের কুশন। টেক্সচার ফিনিসড দেয়ালে কোথাও যামিনী রায় কোথাও বা রাজা রবিবর্মার পেইন্টিং। একটা বিশাল ওপেন ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। তাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক শো-পিস। ডাইনিং টেবিলটা অনেক বড়, সুদৃশ্য কাটলারি সেট সাজানো, মাঝখানে একটা সুদৃশ্য ঝুড়িতে রয়েছে অনেকগুলি সতেজ ফল। সহেলী একঘর থেকে অন্য ঘরে ছুটে বেড়ায়। শৌখিন মডিউলার কিচেন ক্যাবিনেটে সাজানো কিচেনটা দেখে নিজের স্যাঁত-স্যাঁতে রান্না ঘরটা মনে পড়ে সহেলীর। বেডশীট, পর্দা, কুশন কভার, পিলো কভার এমনকি সেন্টার টেবিলের সদ্য ধোঁয়া ওঠা টি-পট এর টি - কোজি .... সমগ্র আপহলোস্ট্রি জুড়ে রয়েছে নানা রঙের সমাহার। লাল, নীল, ফুশিয়া, গ্রাসগ্রিন, লেমন - ইয়েলো।এক একটা রং যেন মনের সব মেঘ কাটিয়ে, একরাশ রোদ্দুর নিয়ে এসেছে। বাথরুম থেকে শাওয়ার -এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গুনগুন করে ভেসে আসছে মেয়েলি কণ্ঠের গান। সহেলী ধীরে ধীরে বেডরুমের দিকে এগোয়। বিশাল খাট, ওয়ার্ড্রব, ড্রেসিং টেবিল সাজানো।খাটের পাশে ছোট্ট বেড সাইড টেবিল। তাতে একটা ফটোস্ট্যান্ড -এ ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। সুখী-সুখী আদুরে ছবি। সহেলী এগিয়ে আসে। ফটোর মেয়েটা খুব চেনা চেনা। তারই প্রিয় বান্ধবী
শ্রুতি, ওর ছেলে ও বর। ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘড়ি ঢং ঢং করে ওঠে। হয়ত এক্ষুনি শ্রুতি বেরিয়ে আসবে! আর নিশ্চই ভীষণ অবাক হবে! কোথা থেকে শুরু করবে কে জানে! আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে যায়। একি! এই মলিন বেশে সে কীভাবে ওর সামনে দাঁড়াবে! কী বলবে নিজের কথা সে। না! না! সে এক্ষুনি চলে যাবে, ছুটে বেরিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। হঠাৎ কে যেন পিঠে এসে হাত রাখে...
৬
"একি! এত বেলা অব্দি শুয়ে আছো যে! তোমার শরীর কী খারাপ"? সহেলী চোখ খুলে সুনীলকে দেখতে পায়। চারদিকে একবার চোখ বোলাতেই বুঝতে পারে সে শ্রুতকীর্তির লেকটাউনের ফ্ল্যাটে নয়, নিজের ইন্দিরা কলোনির জীর্ণ ঘরে শুয়ে আছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে সহেলী। সুনীল বলে, "শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে থাকো। আমি ম্যানেজ করছি। সারাদিন তো অনেক পরিশ্রম হয়।" সহেলী সুনীলের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, "ঠিক আছে শরীর"। সুনীল উজ্জ্বল মুখে বলে যায়, "আজ পাঁঠার মাংস আনলাম বহুদিন পরে। জমিয়ে রান্না কর তো"। সহেলী মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে চলে যায়। সুনীল একটু দমে যায়। মনে মনে তার সহেলীকে নিয়ে ভীষণ গর্ব। কোথায় রাজরানী হয়ে থাকবে তা নয়! সুনীল ওর মুখে হাসি দেখার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে কিন্তু সামর্থ্যই বা কতটুকু? সহেলীর ফেলে যাওয়া স্মার্ট ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়ে শ্রুতকীর্তি সেনের ঝাঁ_চকচকে প্রোফাইল।
৭
আজ বারোটার থেকে "আড্ডা উইথ শ্রুতকীর্তি" র সম্প্রচার।
"রেডিও মিষ্টির" অন্যতম সঞ্চালিকা সে। স্বামী অর্ঘ্য সেন একটা বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের উচ্চপদে আসীন। আয়নায় নিজেকে দেখে শ্রুতকীর্তি। তার গলা শুনেই কত মানুষের দিন শুরু হয়। টিভির চ্যানেলে যখন "আজ সকালের আমন্ত্রণে" সঞ্চালনা করে তখন অগুনতি মানুষের কাছে ফ্যাশন ডিভা হয়ে ওঠে। বান্ধবীরা তার মতো কেরিয়ার আর সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে। চোখ দুটো এখনো ফোলা! তাতেই বা কি! এখনই চড়া আইলাইনার আর চড়া কাজল দিয়ে নিপুনভাবে ঢেকে ফেলবে, কাল রাতের সব যন্ত্রনার, সব অশ্রুর ইতিহাস। বালিশের কভারে কেউ এক ফোঁটা চোখের জলের দাগ পাবে না। কালকের প্রবল যন্ত্রণাময় মুহূর্তেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনকি ছোট্ট রনিকেও না। ছুটে গেছে ওয়াশ রুমে। চোখের জল আর শাওয়ারের জল কখন যে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে.... দেয়ালে কান পাতলেও কেউ শুনতে পায়নি এতটুকু হাহাকার। প্রতিটা দিন জলভরা চোখ দুটো সানগ্লাসে ঢেকে, মেকি হাসি মেখে মিশে গেছে হাজার হাজার স্রোতে।
৮
গাড়িতে এসে এসিটা অফ করে জানলাটা খুলে দেয় শ্রুতকীর্তি। দমকা হাওয়া এসে মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। সামনে ফ্রিঞ্জ করে কাটা লকস গুলো উড়ছে। গাড়ি ছুটে চলেছে আপন গন্তব্যে। যান মুখর রাস্তা আর কংক্রিটের জঙ্গল দ্রুত দৃষ্টিপটের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইসস প্রতিদিন গাড়িটা যখন এই "পেট বার্ড শপ" টার সামনে আসে, শ্রুতকীর্তির মনটা খারাপ হয়ে যায়। সুদৃশ্য খাঁচায় ছোট্ট রঙিন পাখীগুলো কেমন যেন ডানা ঝাপটায়! বড্ড কষ্ট হয়! আরে! আজ তো পঞ্চমী! তিস্তাপার্কে তাদের স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়ন যে! না আজ যেতেই হবে জল শহর। সব কাজ বাতিল হয় হোক। শ্রুতকীর্তি জানে কালকের পার্টির জের চলবে আজকের তিস্তা-পার্কের বন্ধুদের সমাবেশেও। তৃণা, মেঘনা ছুটে এসে বলবে, "অর্ঘ্যদা কী কেয়ারিং রে"! শ্রুতকীর্তিকে মিষ্টি হেসে বলতে হবে, "কি যে বলিস..."! বুক ফেটে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে তোরা কিচ্ছু জানিস না..... কিচ্ছু না। তার প্রতি কোনোদিনও কেয়ারিং নয় তার ওপেন রিলেসনশিপে বিশ্বাসী স্বামী অর্ঘ্য। বিয়ের পরদিনই সে জেনে গেছে তার স্বামীর জীবনে তার শুধু সামাজিক অস্তিত্বটুকুই আছে। এই বিশেষ দিনটা যে কত বঞ্চনার.... কত উপেক্ষার তা শুধু সে-ই জানে। দীর্ঘ ছ'বছরে কোনো জন্মদিনকে অর্ঘ্য উষ্ণ শুভেচ্ছা আর সান্নিধ্য দিয়ে স্বাগত জানায়নি। বরং অর্ঘ্যের বস আর বিসনেস্ পার্টনারদের হই- হুল্লোড় আর উল্লাসে শ্রুতকীর্তির বিশেষ অনুভূতিগুলো দম আটকে মরেছে। প্রতিবছরই অর্ঘ্য রিমাইনডারের দৌলতে অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে এ টি এম ছুঁড়ে দিয়েছে। আর সেও কলের-পুতুলের মতো স্ট্যাটাস অক্ষুন্ন রেখে একের পর এক ঈর্ষণীয় উপহার কিনেছে। প্রাচুর্য্য আর নিপুন অভিনয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সব উপেক্ষাকে। বছরের পর বছর এভাবেই ব্লটিং পেপারের মতো সব অপমান শুষে নিতে নিতে কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ছন্দপতন ঘটল সেদিন….
যখন সে ছুটে গিয়েছিল শাশুড়ি মায়ের কাছে দ্বিতীয় মাতৃত্ব লাভের সুখবর জানাতে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিনী তথা নারী মুক্তির ধ্বজাধারী শাশুড়ি মা গর্ভপাত করার প্রস্তাব দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন বংশের প্রদীপ রনি যখন আছেই, তখন দ্বিতীয় সন্তান তাদের কাছে বাহুল্য আর দুর্ঘটনা বৈ নয়। প্রথম সন্তান কন্যা হলে দ্বিতীয় বার ভাবার প্রশ্ন আসত। এত বড় আঘাত সহ্য করতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করে শ্রুতকীর্তি, আর তাতেই হিংস্র হয়ে ওঠে অমায়িক, প্রগ্রেসিভ মুখোশের অর্ঘ্য। মাঝে মাঝে সহেলীর কথা খুব মনে পরে শ্রুতকীর্তির। আজ মেয়েটার জন্মদিন কেমন আছে কে জানে! তবে তার থেকে ভালো নিশ্চই! মাঝে মাঝে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা ভেবেছে। স্বাধীন, চাকুরীরতা সে। কিন্তু পারেনি, ছোট্ট রনির মুখের দিকে তাকিয়ে। ওর যে এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে... আর নিজের সুখী-সুখী ইমেজটা যে আজকাল বড্ডো প্রিয় হয়ে উঠেছে!
পৈতৃক বাড়িতে শয্যাশায়ী, স্থবির মা। প্রোমোটারের উৎপাত। আর অন্যদিকে "সেন পরিবারের" অসীম পেশী শক্তি। লড়াইটা বেশ কঠিন! কারো সহানুভূতির পাত্রী সে হতে পারবে না কোনোদিন ।
৯
"সই! আমি শ্রুতি চিনতে পারছিস?"
"তোর গলা চিনব না! তুই আমার নম্বর পেলি কোথায়?"
"আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলি? পার্স ফেলে এসেছিস? শরীর ঠিক আছে? আমি আসছি। ঠিকানাটা বল।"
"ইয়ে মানে...থাম থাম! তুই কোথায় বল.. আমি তো বেরবই..কাজ আছে একটা, আমিই যাচ্ছি! হ্যাঁ যাচ্ছি কদমতলায় তো?"
১০
"বাহ! শ্রুতি তোর ডায়মন্ড রিং টা কী দারুণ রে! বার্থডে স্পেশাল!"
বাঁ হাতের কনুই-এর কাছটা ভীষণ জ্বলছে শ্রুতকীর্তির। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অর্ঘ্যর টাকায় কেনা আংটিটা দেখতে থাকে সহেলী। ধীরে ধীরে কুর্তির আস্তিনটা গোটায় শ্রুতকীর্তি। বেরিয়ে আসে দগদগে ক্ষতটা। মনে হয় ক্ষতটা যেন জ্বলজ্বলে হীরের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এ ক্ষত চিনেছে সহেলী। ননদ নিরু যখন ওর মাতাল স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্স কেস ফাইল করে ফিরে এল তখন থেকেই খুব চেনা এই ক্ষত!এত কষ্ট শ্রুতিটার?
চোখের জল লুকিয়ে জোর করে হেসে বলে শ্রুতি "রান্নার অভ্যাস নেই তো?"
কিছুক্ষণের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্রুতকীর্তি বলে "প্লিজ সই কাঁদিস না আমার জন্য! আমার চোখের জল একবার বেরোলে আর থামে না রে! অনেক কষ্টে আটকে রাখি।"
"আমি তোকে কত হিংসে করেছি জানিস! তোর সব কিছুই সোস্যাল মিডিয়াতে ফলো করতাম!কিন্তু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাইনি।
১১
কোর্ট মোড়ের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে রাকেশকে গাড়ী নিয়ে চলে যেতে বলে শ্রুতকীর্তি! এদের স্যানট্রোতে আর নয়। "অগ্রদূত" সংঘের মণ্ডপে এসে দাঁড়ায় শ্রুতকীর্তি। অনেকদিন পর ডাকের সাজের প্রতিমা দেখল সে! শঙ্খ-পদ্ম শোভিতা, গদা-চক্র-ত্রিশূল ধারিনী অপূর্ব দেবীমূর্তি। দেবী মূর্তির দুটি স্নিগ্ধ নয়নের মাঝে ত্রিনয়ন থেকে যেন ক্রোধবহ্নি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।অসুর দলনী দেবীই তো অনুপ্রাণিত করছেন আমাদের যুগ যুগ ধরে, যা কিছু অশুভ তার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াতে হবে যে! ধরণটা হবে শুধু নিজের মতো। এক ছুট্টে বড়ো রাস্তাটা পেরিয়ে 'পেটবার্ড শপ' টায় এসে পৌঁছয় শ্রুতকীর্তি। দোকানদারের হাতে টাকা গুঁজে দিয়েই এগিয়ে যায় ছোট্ট সাদা খাঁচাটার দিকে। ধীরে ধীরে খুলে দেয় খাঁচার পাল্লাটা। কংক্রিটের জঙ্গল, ধোঁয়া মাখা বাতাস অতিক্রম করে মুক্ত আকাশে উড়তে থাকে একজোড়া লাভ বার্ডস। খোলা আকাশের নীচে একবার বুকভরে শ্বাস নিতে পেরে অদ্ভুত আরাম লাগছে। নিজেকে উদাত্ত আকাশের মতো মুক্ত মনে হচ্ছে শ্রুতকীর্তির। যদি নিরু পারে, যদি মলি পারে তবে সেও পারবে। এখন সোজা "বসু ক্লিনিক"! তারপর যাবে দেশবন্ধু পাড়ায় মায়ের কাছে। মা যতই স্থবির হয়ে যাক আজ তাকে গিয়ে বলতেই হবে সে তার সন্তানদের নিয়েই নতুন পৃথিবী গড়বে।
১২
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বাড়ির কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি সহেলী। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। রাজবাড়ির মোড়ের সামনে ঠাকুর চলে এসেছে। একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে আপন মনেই বলে ওঠে "ক্ষমা করে দাও মা! আমি শ্রুতিকে হিংসে করেছি কিন্তু এতটা খারাপ কক্ষনো চাইনি। আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি যেমন আছি তেমন ভাবেই থাকতে পারি যেন! বিট্টুকে মানুষ কর আর শ্রুতিকে ভালো রেখ! ওকে শান্তি দিও"! বিডিও অফিসের সামনে ছোট্টো সিঙ্গারাগুলো সুনীল খুব ভালোবাসে! দাঁড়িয়ে পরে সহেলী। মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে ...
"সেই সুরে, বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে, অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি।
ভালোবাসি,ভালোবাসি।।"
চলতি হাওয়ার স্রোতে অনেক অবহেলা করেছে সুনীলকে আর না! ফেরার পথে নীলিমা দেবীর মিষ্টি পান নিয়ে যেতেই হবে! আজ ওনার যে বড্ড অভিমান হয়েছে!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴