যিনি আমায় ভাবান/সুনীতা দত্ত
যিনি আমায় ভাবান
সুনীতা দত্ত
সূর্যের প্রখর আলো দিনকে উত্তপ্ত করে আবার সন্ধ্যা হলে মিলিয়ে যায় - নেমে আসে অন্ধকার,
পৃথিবীর নিশ্চুপ অবস্থা এভাবেই জানান দেয় দীর্ঘ রাতের পর আবার আলোর অপেক্ষা। প্রতীক্ষা দিনের প্রখর আলোর! এমন এক অন্ধকার থেকে আলোয় উৎসরনের নাম পারমিতা দি । পারমিতা দি আমার থেকে বয়সে অনেকটা বড়, প্রায় আমার মায়ের মত। তবু সে বন্ধু হয়ে আমার জীবনে এসেছিল। তার জীবন, তার কর্ম, তার নিষ্ঠা, তার জীবনের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলা যায়, করে চলেছে। হয়তো যতদিন বাঁচবো, ততদিন পথ দেখাবে আলোর পথে উত্তরণের।
আমার শিক্ষাজীবন থেকে কর্মজীবন, তারপর আবার কিছুটা সময় শিক্ষা জীবনে প্রবেশের কালে পারমিতা দি আমার সহপাঠী - মাস্টার্সে পড়ার সময় তাকে এই রূপেই পেয়েছি অন্যান্য সমবয়সী সহপাঠীর সাথে। তার এই সময় শিক্ষাজীবনে আবার প্রবেশও আলোর পথে প্রত্যাবর্তন। কলেজ জীবন শেষ হতেই পারমিতাদির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর কয়েক বছরের ব্যবধানে দুই সন্তান প্রথমে ছেলে তারপর মেয়ে। স্বামী ব্যাংকের কর্তা ব্যক্তি আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলই। ছেলে মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনাটা আর করে ওঠা হয়নি। এখন আবার শুরু করেছেন ছেলে চাকরি রত এলআইসি বিভাগে মেয়ে তখনও শিক্ষারত। এইরকম পারিবারিক পরিবেশে থেকে সিদ্ধান্ত আবার মাস্টার্সটা শুরু করবেন। জুড়ে গেলেন আমাদের সাথে। নেতাজি ওপেন ইউনিভার্সিটির সাথে। বিষয় এমএসডব্লু - সামাজিক কর্মকাণ্ডের উপর মাস্টার্স। আমাদেরও তাই। স্বাস্থ্য বিভাগে থাকার কারণে আমি অন্য বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়ে উৎসাহিত হয়েছিলাম। পারমিতাদির যুক্তি ছিল ওই বয়সে তিনি তো আর সরকারি স্থায়ী চাকরি পাবেন না কিন্তু সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত হতে পারবেন এই ডিগ্রীর সূত্রে ও সরকারি সংস্থার সাথে জুড়ে কিছু সামাজিক কাজ করতে পারবেন।
শিলিগুড়ি মহিলা কলেজে সপ্তাহান্তে ক্লাস হত। প্রায়ই রবিবার ক্লাসের পর আসার সময় গল্প হতো। সাথে আরো বন্ধুরা ছিল মলয়, অমৃতা, রাজদীপদা আরো অনেকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রান্তের আমরা সবাই কিছু না কিছু কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম। পারমিতা দিই একমাত্র গৃহবধূ। আমাদের সাথে স্নেহ মাখানো বন্ধুত্বে জড়িয়ে ছিলেন। সুন্দর ব্যবহার, মায়াময় মুখ আমাদের তার প্রতি আকর্ষিত করত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সকলের প্রিয়। প্রথম বর্ষের প্র্যাকটিক্যাল এক্সাম দেবার সময় একসাথে কলকাতা গেলাম। যাবার সময় একসাথে টিকিট ছিল, তাই দুপুর হতেই তার বাড়িতে চলে গেলাম। কদিন পর উনার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ওনার মেয়ের সাথেও দেখা হল , তখন সে শিক্ষার্থী এক ঝলক দেখেছিলাম, লালিত তো মাখানো মুখ বেশ ভালো লেগেছিল। আমাকে আন্টি বলেই ডেকেছিল। তারপর আর কখনো দেখা হয়নি পারমিতাদির মেয়ের সাথে। কলকাতায় একসাথে থাকা আবার ফিরে আসা আমাদের আগলে রাখা ঠিক মায়ের মত। পরের বছর আবার কলকাতা একই কারণে পরীক্ষা দিতে যাওয়া, ততদিনে ওনার ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ও বৌমা ধুপগুড়ি শহরে কর্মসূত্রে থাকতে শুরু করেছিল। মাঝে মাঝেই পারমিতা দি ছেলে, তার কাজ, তার বৌমার চাকরি এবং নাতনির জন্মের গল্প করতেন।
পরবর্তীতে আমাদের ব্যাচে আমরা যারা অবিবাহিত ছিলাম সকলেই সংসার জীবনের পদার্পণ করি এক এক করে। পারমিতা দিয়ে যেহেতু জলপাইগুড়ির বাসিন্দা তিনি সেই সময় সেখানকার এক এনজিওতে কাজ করতেন। কিছু বছরে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। কোন এক অনুষ্ঠানে আমার সাথে একবার দেখাও হয়েছিল। স্নিগ্ধ শান্ত চেহারায় তখনো তিনি আমাদের অনেক কাছের প্রিয় মানুষ। দেখা হবার সুবাদে জেনেছিলাম মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে মাল মহকুমার এক বাগানে কাজে যোগদান করেছিল। বেশ চলছিল,হয়তো সব শেষের একটা শুরু থাকে। পারমিতাদি সেই শুরুর জন্যই আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। তখন সবেমাত্র ফেসবুক খুলেছি সেভাবে কিছু শেখাও হয়নি। একদিন ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে দেখি পারমিতা দি মেয়ের ছবি শেয়ার করেছেন ,লেখা "যেখানেই থাক ফিরে আয়"। চোখ থমকে গেল। বলা যায় আমি বিস্মিত! এ কি দেখছি সত্যি কি এমন ঘটলো যার জন্য পারমিতা দি এমন কথা লিখেছেন। যোগসূত্র বলতে পারমিতাদির ভাসুরের মেয়ে আমাদের সাথেই পড়তো। তখন ওকে ফোন করে জেনেছিলাম দিদির মেয়ে চাকরি সূত্রে যেখানে ছিল সেখানকার টয়লেট ব্যবহারের সময় তাকে সাপে কামড়েছিল। সব শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল। অদ্ভুত এক কষ্ট সেদিন মনের দরজা জানালায় আঘাত করেছিল এ কেমন নিদারুণ বেদনার অসীম খেলা। মনের বাঁধ ভেঙে অচেনা এক বেদনা ছেয়ে গিয়েছিল গহীন হৃদয়ে।
তারপর দিন গেছে পারমিতাদিকে আর ফোন করে কিছু বলতে পারিনি। বলিওনি। জানি না সে আশা করেছিল কিনা কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনি। কয়েক বছর কাটার পর। উনি মেসেজ করতেন খবর নিতেন। নিজেকে খুব দোষী মনে হতো এ কেমন আমি, সন্তানহারা মাকে একটু সহমর্মিতাও দেইনি। অথচ উনি খোঁজ নেন আমার। আসলে মাতৃত্বের যোগ্যতা ও উনি সেরা কারণ মেয়ের ওই ঘটনার পর তিনি নিজস্ব উদ্যোগে মেয়ের নামে এক সংস্থা খুলেছেন , যার মাধ্যমে তিনি চা বাগান গুলোতে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করে থাকেন , সচেতনতার কাজ করেন, সাথে স্বাস্থ্যশিক্ষা দেন। সেই সাথে তিনি তাদের পাশে থেকে নৈতিক মূল্যবোধের ও শিক্ষা দেন এই কাজে এতটা নিবেদিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি নিজে বাড়ির বাইরেই থাকতেন, যাতে পুরো সময়টা কাজে লাগাতে পারেন। তার মনে হয় এতেই তার মেয়ে তার সাথে থাকবে, অনেক মেয়ের উপকার করে থাকেন তিনি। তার এই উত্তরণ, সমাজের জন্য ভাবনা , মেয়েদের প্রতি দায়িত্ববোধ তাকে সকলের স্নেহময়ী "মা" করেছে। মাঝে মাঝে বেসরকারি কিছু চ্যানেলে ওনার সাক্ষাৎকার দেখি। খুব গর্ববোধ হয় , এমন মায়েরাও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিক, একটু বিশ্বাস নিয়ে বাঁচুক যে তার মেয়ে হারিয়ে যায়নি।
এখন ভাবলে খুব অবাক লাগে কেনই বা পারমিতাদি অসম বয়সে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন? সময় তাকে তখন তৈরি করেছিল আগামীর জন্য। এক সামান্য নারী আমার কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রেরণা সুখ তাকে দমাতে পারেনি। চোখের জলে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। শুধু অনুভব করেছেন, বিশ্বাস করেছেন তার আত্মজ আছে, কোথাও থেকে বলছে, " মা,আমি তো এই রূপেই তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম, তুমি যেন থেমে যেও না!" আজও পারমিতাদির সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি না , কিন্তু মননে চিন্তনে উনি আমার প্রাণের বড় কাছের বড় চেনা মানুষ। ইচ্ছে হয় তার গল্প সবাইকে বলি সবার সাথে ভাগ করি, যে আমায় সত্যিকারের জাগিয়ে তোলে ভাবিয়ে তোলে। সেই সাথে জীবনের সাথে মিশে যাওয়া সত্যি কারের রঙে রাঙিয়ে তোলে। আপনি আরো কাজ করুন, জীবনের সাথে মিশে গিয়ে আমাদের শিখিয়ে যান অবিরত যারা নেই তারা আছে, কাছের মানুষ কখনও হারায় না!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴