সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
28-April,2024 - Sunday ✍️ By- শঙ্খ মিত্র 271

যাঁরা মাথা তুলে আছে সাধারণের ভিড়ে/শঙ্খ মিত্র

যাঁরা মাথা তুলে আছে সাধারণের ভিড়ে
শঙ্খ মিত্র

প্রিয় কথাকার সৌগতদা,
                                     গ্রীষ্মের এই দহন বেলায় সহজ উঠোনের এককোণে, চিকরাশির সুনিবিড় ছায়াতলে বসে তোমায় এই চিঠি লিখছি। সম্প্রতি শেষ করে উঠলাম তোমার অসামান্য গল্প সংকলন 'ফকিরগঞ্জের লোকজন'। নিছক প্রথাগত পাঠ প্রতিক্রিয়া দেওয়া এই চিঠির উদ্দেশ্য নয়। কারণ কথাকার সৌগত ভট্টাচার্যের কলমের সঙ্গে পাঠক সমাজ ইতিমধ্যেই সুপরিচিত। কিন্তু এই বারোটি গল্পের সুতোয় তুমি যে অপূর্ব মালাখানি গেঁথেছ, তা অবলীলায় পাঠ করার পর আমার স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধি তোমাকে জানাতেই হচ্ছে। 
প্রথমেই বলি সংকলনের নামকরণের কথা। এই বই-এর পরিচিতি অংশ থেকেই জানতে পারি সুদূর অতীতে জলপাইগুড়ি জনপদের নাম ছিল ফকিরগঞ্জ। সেই অর্থে ফকিরগঞ্জের একজন বাসিন্দা হিসেবে গল্পপাঠের শুরুতেই এক নিবিড় আত্মিক টান টের পাই। প্রতিটি গল্পের একেকটি চরিত্র যেন কালের গর্ভে লুকিয়ে থাকা প্রান্তিক অঞ্চলের একেকজন প্রতিনিধি, যাঁরা বড় বেশি মাটির মানুষ, বড় বেশি আপনজন। একজন লেখক হিসেবে তোমার সততা, নিষ্ঠা, সহজাত অন্বেষণ ক্ষমতা যেভাবে এঁদের পাঠকের ঘরের লোক করে তুলেছে সেজন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
'পোড়ামাটির দেশ' গল্পে ফকিরচাঁদের নস্টালজিয়া কোথাও গিয়ে মনের গভীরে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। হলদিবাড়ি মামাবাড়ি হওয়ার সুবাদে ছোট থেকে বহুবার ইটভাটার সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছি। বাসে করে যেতে যেতে অনেকবার চোখ আটকে গেছে ওই ইটভাটার সামনে। ছোট ছোট চৌকো করে কাটা পুকুরগুলো যেন আবহমানের সাক্ষী দিচ্ছে এখনও। ফকিরচাঁদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়তো এখনো শোনা যায় ওই পুকুরের কালো জলে, ওই পোড়ামাটির দেশে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওই পোড়ামাটি দিয়েই একটা গঞ্জ একটা গ্রাম ধীরে ধীরে বদলে যায়। ফকির তাই অবলীলায় বলে ওঠে, "ইট পুড়লে চারকোণা শহর হয়ে যায়"।
'নহবত'-এর শাহেনশা সহজতার, সরলতার চূড়ান্ত প্রতিভূ। আগাগোড়া মাটির মানুষ শাহেনশা এমন একটি পেশার সঙ্গে যুক্ত যা সচরাচর কারো চোখেই পড়বে না। কিন্তু তোমার অনুসন্ধিৎসু মন এমনই বিরল প্রতিভাকে খুঁজে বের করে তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর স্নেহবৎসল পিতৃসত্তা, উপযুক্ত মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাকুলতা, পাশাপাশি তাঁর পাখিপ্রেম, পাখিদের জন্য উৎকণ্ঠা তাঁকে সাধারণ থেকে অসাধারণত্বে উন্নীত করেছে। শাহেনশার মত মানুষ আমাদের চারপাশে সাধারণের ভিড়ে মিশে আছে, গল্পের চরিত্র হলেও তুমি আলো ফেলেছ তাঁদের ওপর, বেঁধেছ অদ্ভুত মায়ায়। 

তুমি নির্মাণ করেছ জহরের মত একটি নিখাদ চরিত্র, যার ভেতর কোন ছল নেই, কোন ভণিতা নেই। নিজে একজন জ্যোতিষী হয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী-র রোগ সারানোর জন্য তাঁকে ছুটে যেতে হয়েছে এ্যালোপেথি ডাক্তারের কাছে। এই conflict তাঁর চরিত্রে আলাদা এক দ্যোতনার সঞ্চার করেছে। তাই আংটি ও পাথর বিক্রি করে অন্যের ভাগ্য ফেরানো জহর স্ত্রী-র রোগশয্যার পাশে বসে অকপটভাবে স্বীকার করে, "অসুখ সারানোর কোন ক্ষমতা ছিল না আংটিতে, শুধু সোহাগ ছিল পূর্ণিমা। ...রোগ সারানোর ক্ষমতা একরত্তি আংটিতে থাকে না"। আপাতনিরীহ সহজ সরল নির্বিবাদী মানুষগুলো রোজকার চলার পথে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও তোমার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁদের ভেতরের সত্তাকে ঠিক খুঁজে বের করেছে।

জলপাইগুড়ি জেলার শহর থেকে শুরু করে প্রান্তিক এলাকার আনাচে কানাচে তোমার সহজ বিচরণ। তার প্রামাণ্য দলিল এই সংকলন। তাই টাকিমারির চর, গজলডোবা, জোড়পাকরি, ইটভাটা, কাদোবাড়ি থেকে শুরু করে শহরের কদমতলা, দিনবাজার, স্টেশন মার্কেট, কোর্ট চত্বর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অঘোরবাবু যখন বৃষ্টিভেজা সকালে স্ত্রী-র স্মৃতিচারণ করতে করতে ক্লাব রোড ধরে মর্ণিং ওয়াক করেন, তখন তাঁর সাথে সাথে আমরাও পৌঁছে যাই ইউরোপীয়ান ক্লাবের দোরগোড়ায়। অথবা সরল মনের মিন্টু, সে হাটবাস করে সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলো চষে বেড়ায়, অথচ দেশ তাঁর কাছে এক বিস্ময়। সে বুঝতে পারে না দেশ কেন আলাদা হয়। উঠে এসেছে হাসিরাম মালোর মত মরমী চরিত্র। গজলডোবার হাসিরাম মালো তাঁর সঙ্গীসাথিদের সাথে ওপার বাংলা থেকে এপারে এসেছে সেই কবেই। ফি বছর বর্ষার সময় তাদের ঘর ভেসে যায়। এই পোড়াদেশে তাদের গুনতি শুধু মাথাপিছু এক একটি ভোট হিসেবে। গজলডোবার পরিযায়ী পাখিদের মতোই তার আক্ষেপ ও গভীর জীবনবোধ মিলেমিশে যায় - "পাখিগুলো জলে জলেই ঘুরে বেড়ায় আমাদের মতো, যখন যেখানে থাকে সেটারেই নিজেদের দ্যাশ মনে করে"। ময়নাগুড়ির সুলেখা, সামাজিক অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য ও অনেক বাধা অগ্রাহ্য করেও ব্রতী হয়েছে অসম জীবন সংগ্রামে, সুদূর কলকাতা শহরে। জীবন্ত হয়ে উঠেছে মহাদেবের মতো এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী চরিত্র। প্রতিটি চরিত্রে উঠে এসেছে তাদের মুখের ভাষা, উত্তরের একান্ত নিজস্ব বাচনভঙ্গি। প্রান্তিক অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের সাথে অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ব্যতীত এই আশ্চর্য নির্মাণ কখনোই সম্ভব নয়।

এই গল্প সংকলন ফকিরগঞ্জের লোকজনের নিজস্ব সম্পদ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অথবা শহরতলিতে বাসকরা বহুমানুষ এখনো এমনকিছু পেশার সঙ্গে যুক্ত যা কিছুক্ষেত্রে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। সেই মানুষগুলোই ধুঁকতে থাকা পেশাগত অস্তিত্ব ও জীবন সংগ্রাম নিয়ে নতুন করে পরিচিতি পেয়েছে। তোমাকে কুর্নিশ। তোমার কলম এমনই আরো অনেক দরদী ও মরমী বিস্ময় উপহার দিক। এই আশা রেখে শেষ করছি। 

                                           ইতি,
                 ফকিরগঞ্জের একজন সাধারণ পাঠক

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri