মৌসুমী মজুমদার-এর আলোচনায় উমেশ শর্মা-র বই 'আরশোলার নীড়'
মৌসুমী মজুমদার -এর আলোচনায় উমেশ শর্মা -এর বই 'আরশোলার নীড়'
শ্রদ্ধেয় উমেশ শর্মার পরিচয় নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই। উনি একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও গল্পকার। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে তাঁর লেখা আমরা উপহার হিসেবে পেয়ে থাকি। ওনার বিভিন্ন লেখনী দ্বারা আমরা ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়ে চলেছি।
মূলত গবেষণাধর্মী গ্রন্থের লেখক উমেশ শর্মার "আরশোলার নীড়" উপন্যাসটি একটি মনোবিকার কেন্দ্রিক অ্যাখ্যান। প্রথমেই বলি শিরোনামটি শুধু মাত্র দুটো শব্দ নয় এর গভীরতা সুদূর প্রসারী। বইটির প্রচ্ছদ নিঃসন্দেহে খুব সুন্দর এবং অর্থবহ।
উপন্যাসের নায়ক পঞ্চাশের দশকের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে দিশেহারা এক কলেজ পড়ুয়া। লেখক প্রবন্ধকার, গবেষক, ছোট ও বড়ো গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে একজন দক্ষ উপন্যাসিক। তিনি তাঁর লেখনীতে সুন্দর ভাবে নায়ককে উপস্থিত করেছেন যে বাঁধা ধরা জীবনে কখনোই অভ্যস্থ নয়। অচেনাকে চেনা ও অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্খা তাকে পাগলের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে ভারতের নানা প্রান্তে।
কলেজ পড়ুয়া অমিত লেখার প্রতি আগ্রহ থাকার সুবাদে এক পত্রিকা গোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসে। সেখানে সম্পাদক মহাশয়সহ কয়েক জনের সঙ্গে পরিচয় হয়। সহ সম্পাদিকার কৃপা দৃষ্টিতে ওনার বাবার কারখানায় কাজের জোগাড়ও হয়ে যায়। টিউশন, কাজ নিয়ে সময় কাটলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে মন অস্থির হয়ে উঠলে বাড়িতে মা বোনের সঙ্গে রেজাল্টের আগে কিছু সময় কাটানোর নাম করে কলকাতার পাট চুকিয়ে কেটে পড়ে। বাড়িতে ও বেশী দিন মন টেঁকে না। পরিযায়ী পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যায় বৃন্দাবনে__মন্দিরে প্রণাম করতে গিয়ে নজর পড়ে, "এখানে পয়সা না দিলে অন্ধ হবে।" ধর্ম স্থানে এহেন অনাচার তাকে লজ্জিত করে। অজানাকে জানতে অচেনা কে চিনতে সে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। এভাবেই বৃন্দাবনের দহিপুরায় যাদববংশীয় এক পরিবারে আট দিন আতিথেয়তা গ্রহণ করে আবার উদ্দেশ্যহীন পথে যাত্রা - সেখান থেকে এলাহাবাদ। ওখানেও এক মজার ঘটনা। প্রথম টমটম গাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা এবং কী করে দুষ্টু বুদ্ধি খাটিয়ে সেই গাড়ি থেকে পঁয়ত্রিশ টাকা কামাই করে আবার বিনে পয়সায় ট্রেনে চেপে বসা। সেই ট্রেনে দয়াপরবশ হয়ে ভদ্রলোক মিঃ সিদ্ধার্থ ঘোষের সাথে পরিচয় ও ভিটি স্টেশনে পদার্পণ। অমিতের ব্যবহার, সততার পরিচয় পেয়ে ওনার কোম্পানি বোম্বে কেমিক্যালস এ রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি পাকা হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন বাবুয়ানা ভালোই চলছিল কিন্তু...... সেই সোনার হাতছানি উপেক্ষা করে পাখি আবার উধাও___।
এবারে কাশী। সেখানে যাবার কারণ মাসীর বাড়ি। অমিত তার মাসিকে ঠাটবাট দেখাতে চেয়েছিল আর জলপাইগুড়িতে মামা এবং বেলাকোবায় মা বোনেদের কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খবর পৌঁছানোর একটা সুপ্ত ইচ্ছে হয়তো ছিল। মিথ্যে কথা বলে মাসির হাজার জ্ঞিজ্ঞাসা চাপা দিতে সেখান থেকেও পলায়ন। "পথই পথ খুঁজে দেয়".....এরপরে এর্নাকুলামে। বন্ধু বৎসল মানুষ কমল দাসের আশ্রয়, কাঠগোলাতে কাজ__চোখ কান খোলা জ্ঞান পিপাসু অমিত বৃন্দাবন গার্ডেনে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গিয়ে কমল দাসের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি - বিহারী গার্ড সুরিন্দরের সাহায্যে রাত্রি বাস। পরদিন বৃন্দাবন গার্ডেন প্রাঙ্গণে লোকের ভিড়ে হঠাৎ পেছন থেকে "বিল্টু" ডাক নামে চমকে ওঠা। মা, মামাও বোনের সঙ্গে দেখা ও বাড়ি ফেরা।
বিভিন্ন পরিবেশে ও মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করলেও কোনো প্রলোভন বা ভালোবাসায় তাকে এক জায়গায় বেশি দিন বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি। পকেট গড়ের মাঠ অথচ কী করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছে সে বর্ণনা লেখক পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেলে ধরেছেন। প্রকৃতির প্রতি টান ও বিভিন্ন জায়গার জীবন, জীবিকা ও চরিত্রের সঙ্গে তার একাত্মতা মনকে আকৃষ্ট করে। "বাড়ি থেকে পালানো আরশোলা প্রেমিক প্রেমিকার মতো".. নায়ক অমিতের জীবনে ও ঘটনার ঘনঘটা দৃশ্যমান। কী করে ভবঘুরে, যাযাবর ও রোমান্টিক অমিতের জীবনে বিয়ের পিঁড়িতে বসা, ফুলশয্যার রাতে রক্তরাঙা শাড়ি সিঁদুর দেখে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া..... প্রচণ্ড মানসিক চাপে নার্সিং হোম, স্ত্রীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া... নতুন চাকরি, নব দম্পতির পুনর্মিলন। হানিমুনে গিয়ে স্ত্রীকে ফেলে উধাও হওয়া। তারপর? রয়েছে টান টান উত্তেজনাময় আরো কয়েকটি পর্ব।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আরশোলারা বেঁচে আছে। নিজেদের আত্মরক্ষার রসদ নিজেরাই কীভাবে খুঁজে নেয় - জানতে হলে, সহজ সরল, সাবলীল ভাবে লেখা রহস্য, রোমাঞ্চ ও ভালোবাসায় মোড়া উপন্যাসটিকে নিবিড়ভাবে পড়তেই হবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴