মোক্ষ/শুক্লা রায়
মোক্ষ
শুক্লা রায়
একটা ঘোর লাগা দুপুর। ঘুরে ঘুরে মুখ থুবড়ে পড়া বিষন্ন বাতাস। কিছুটা উদাস, কিছুটা কষ্টে মুচড়ে ওঠা বুক। ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়া মাটির ঢেলাগুলি ধুলো হয়ে ওড়ে, অকারণ লেপ্টে যায় জামা-কাপড়ে, সাদা স্কুটির গায়ে। এমন এক ধুলোপথেই তোমার সাথে কথা হল। বাঁকের গায়ে হেলান দিয়ে আমি তোমার সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রাখলাম। পথ তো পথই থাকে, জীবনের প্রান্তে এসে শুধু তার পরিচয় পাল্টে যায়। চকলেট রঙের হিরো জেট সাইকেলের এই লেডিস ভার্সনের পিঠটাকেই এক সময় মুক্তি মনে হত। প্রাণপণ প্যাডেলে চাপ দিয়ে দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া যেত কত শত তেপান্তরের মাঠ। তোমার রঙিন জামা মেঘের গায়ে রঙ ছড়াতে ছড়াতে হাওয়ায় উড়ত পত পত। অথচ এখন ইচ্ছে মতো স্কুটির স্পিড বাড়িয়েও সে মুক্তিকে ছোঁয়া যায় না। পথ সেই একই আছে, কিন্তু তার ছায়া পাল্টে গেছে অকস্মাৎ। বারবার সিট কভার পাল্টানো শক্ত খটখটে সাইকেলের পিঠে চড়েও সদ্য কৈশোর পেরনো মেয়েটা যতটা স্বপ্ন দেখত, এখন এক ঝকঝকে সাদা স্কুটির নরম পিঠে বসেও কোনো স্বপ্ন দেখে না। জীবনের কাছে চাইবার কিছুই নেই এখন। তাই চোখদুটিও সাদা পাতার মতো শুকনো। যেন শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত, জলের দাগ আছে, জল নেই কোথাও। সবখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার যে যন্ত্রণা তা পরতে পরতে জড়িয়েছে, আষ্টেপৃষ্ঠে মেখে নিয়েছে সবটুকু জীবন। তবু শূন্যতাকেই আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে বেঁচে থাকার দৈর্ঘ্য। সে পথেরও এক মাধুর্য আছে, অন্যরকম। তাকেই বা অস্বীকার করি কি করে! তবু যখন এই একলা হওয়ার পথটুকুতে মাঝে মাঝে তোমার দেখা পাই, চুপি চুপি বলতে ইচ্ছে করে, আমার কাছে সময় আসলে ভয়ের নামান্তর মাত্র। এছাড়া ভয়ের আর কোনো গোপন অনুবাদ নেই।
আসলে একটা বড় আকাশ খুঁজে পাওয়ার পরই হয়ত পাখিটি অনুভব করে তার বুকের ভেতরেই এক সূক্ষ্ম জাল, যে জালের বেড়া ডিঙোনোর সাধ্য তার নেই। নীরুপায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তবু এক অসহায় অস্থিরতা। কাব্যের গ্লাস ভরে ওঠে অনুভবি রঙের নানান শেডে। সে গ্লাস পান করে, পান করিয়েই এক অহেতুক মোক্ষলাভ।
মোক্ষ বলে যদি কিছু ছিল তাকে কীভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যায়। এই একটা এত বড় জীবন জুড়ে কী চেয়েছিলাম তার কোনো অবয়ব এখন আর স্পষ্ট মনে করতে চাই না। এখন মনে হয় ঠিকঠাক একটা "আমি" হয়ে উঠতে পারাটাই বোধহয় জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটাই তাড়িয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। বাকি জীবন। এত এত কথা একটি কিশোরী যদি সেদিন বুঝত তবে সবকিছু কী অন্যরকম হতে পারত? এসব বিতর্ক সবার জীবনেই থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবু সব শেষে মনে হয় কিছু থাকে অবধারিত পথ চলা, কিছু নিজস্ব অভিমুখ। দুই পথকে সামলে সুমলে এগিয়ে যেতে পারাটাই সুখ এখন। কোথাও ছাপ ফেলে নিজেকে খোদাই করে রাখতে পারা নয়, নিজের ভেতর নিজেকে ফিরে পাওয়াটাই সুখ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴