মেঠো প্রলাপ/অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
মেঠো প্রলাপ
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
****************
সন্ধে শেষ হয়ে চার্চের বড় ঘড়িখানা রাত শুরুর জানান দিচ্ছে ঢং ঢং শব্দে। আকাশ থেকে একফালি চাঁদের ঠিকরে আসা আলোয় সবে যীশুখ্রিস্টের মুখটা চকচক করছে যখন এমন সময় টালমাটাল পায়ে সেখানে এসে বাপ্পা বলতে শুরু করল- লর্ড আমি আজ জলপথে আছি, রাগ কোরো না, আজ তোমায় আমার অনেক কথা বলার আছে। লিখতে পারলে সেসব একটা বড় চিঠি হয়ে যেত। তুমি ছাড়া আর কাকেই বা এসব কনফেস করব বল? জিভটা মাঝেমাঝে জড়িয়ে গেলে, তুমি প্রভু, এসব ঠাট্টা ভেবে উড়িয়ে দিও না। বুকটা আজ খালি করতেই হবে তোমার কাছে। পেটে হাল্কা করে ঢেলে এসেছি খানিকটা সেই কারণে। আজ সব হিসেব চুকিয়ে দেবার দিন লর্ড।
চার্চ মাঠের ফুটবল ফাইনালে আজ আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি, বুটজোড়া তুলে রাখব এবার। রোজগার বাদ দিয়ে বেকার ছেলের খেলাধুলা করা নিয়ে বাড়িতে সবসময় বাওয়াল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম তাই। আর মাঠের দিকে যাব না কোনদিন। আজ খেলা শুরুর আগে তোমার নাম ধরে ডেকেছি খুব। প্রার্থনা করছিলাম শেষ ম্যাচটায় যেন জান লড়িয়ে দিতে পারি। অনেক টিটকারি, হ্যাটা'র জবাব দিতে হত যে আজ! প্রতিপক্ষ ট্রান্সপোর্টের টিমের বড় খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার শেষ সুযোগ নষ্ট করতে চাইনি। ওদের কোচ বাটুলদা আমাকে প্লেয়ার-ই মনে করে না। মুখে শুধু শৈবালদা, নিতাইদার কথা। মানছি ওরা ভাল খেলত কিন্তু আমারও আজ বোঝানোর ছিল আমি কী জিনিস! বোঝাতে হবে বাড়ির লোকগুলোকেও। বেকার হলেও ফুটবল খেলে আমি কম কিছু পাইনি। ছোটভাইটা খুব কথা শোনায় আমায়। আমাদের ম্যানেজার ক্যাবলাদা বলেছিল, আজ ফাইনালটা জেতাতে পারলে পৌরসভায় আমার নাকি একটা চাকরি পাকা। আমি জানি বুট তুলে রাখলে সবাই এসব ভুলে যায় তবু দেখি কী হয়? মাঠের পুরো দর্শক ট্রান্সপোর্ট টিমকে সমর্থন করলেও আমাকে আটকানো আজ কারো সাধ্য ছিল না লর্ড। মাঠে নামার সময় হাতের মাদুলিটা ধরে চুপিচুপি বেশ ক'বার প্রসাদদার নাম আউরে নিয়েছিলাম জান? রাইট আউটে কী দারুণ খেলত লোকটা! গুরু... গুরু!! ও ওহ্, আমার কথা শুনতে শুনতে চোখ লেগে গেল নাকি তোমার? ঘুমিয়ে পোড়ো না বস্! মানছি, আমার জিভটা মাঝেমাঝেই জড়িয়ে যাচ্ছে। কথা দিচ্ছি, এটাই শেষ। আর তোমায় জ্বালাব না কখনো।
খেলার শেষ মুহূর্তে, তখনও গোল পায়নি কোন দলই, মাঝমাঠে একটা বল পেয়ে তোমার নাম নিয়ে দৌড় শুরু করলাম জেসাস। আমি দৌড়লেই মাথার লম্বা চুলগুলো উড়তে শুরু করে, তুমি তো জান। স্কুলে এই চুল নিয়ে ধ্রুব স্যর কত যে বকা দিতেন একসময়! দর্শকদের মধ্য থেকে কয়েকটা মেয়ে বলছিল, দ্যাখ প্লেয়ারটার চুল একদম মিঠুনের মতো! আমি সে কথা শুনে স্পিডটা আরো বাড়াতে চাইলাম। এক ঝলকে মনে পড়ল তুলির মুখটা। মেয়েটা বোধহয় এই চুল দেখেই অতো ভালবেসে ফেলেছিল আমায়। একটা কিছু রোজগার পাকা হলেই বিয়েটা সেরে ফেলতাম লর্ড। কিন্তু বেকার ছেলের ভরসায় কেই বা আর বসে থাকে বল? যেদিন তুলির বিয়ে হয়ে গেল, পুরিয়ায় দু-টান মেরে খুব কেঁদেছিলাম সারারাত।
যাক্ গে, বল নিয়ে ক'পা এগোতেই চোখে পড়ল ট্রান্সপোর্টের লেফট ব্যাক বাবুরামদা ট্যাকেল করতে ছুটে আসছে। ছোট্ট টোকায় ওকে পার হয়ে বড়বক্সের কোণে পৌঁছতেই কানে এল ডিফেন্স থেকে পার্থ চেঁচাচ্ছে, বাপ্পা বিমলকে মাইনাস কর। পার্থটা বড্ড চেঁচায় মাঠে। আমি ওর কথা কানে না নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম ট্রান্সপোর্টের গোলকিপার কমলেশ কাছের পোস্টটা গার্ড করে রেখেছে। আমাদের রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে ক্যাবলাদারাও চেঁচাচ্ছিল- মাইনাস কর, মাইনাস কর। কিন্তু আমি লর্ড, ততক্ষণে গোলকিপারের হাত আর পোস্টের মাঝখানে একটা গ্যাপ দেখতে পেয়ে গেছি। ঠিক করলাম ঐখান দিয়েই বলটা জালে জড়াব। বুঝতে পারছিলাম ওদের স্টপারটা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসছে। আমার হাতে সময় ছিল না একটুও। শটটা নিতে হোত তক্ষুণি। ঐ একটা শট ট্রান্সপোর্টের কোচের মুখের ওপর জবাব, ঐ একটা শট ভাইয়ের অপমানের জবাব, ঐ একটা শট তুলিকে না পাওয়ার সান্ত্বনা, ঐ একটা শট আমার রোজগারের নিশ্চয়তা...আমি পা ওঠালাম, আড়চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম গোলের জালটা ওদের গোলকিপারের হাতের ফাঁক দিয়ে চিকচিক করছে। গায়ের সব শক্তি দিয়ে শট নিতেই বলটা গোলার মতো এগোতে থাকল, এগোতে থাকল, এগোতে থাকল...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴