সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
15-October,2023 - Sunday ✍️ By- সুকান্ত নাহা 340

মেঘে ঢাকা রোদ্দুর/সুকান্ত নাহা

মেঘে ঢাকা রোদ্দুর
সুকান্ত নাহা
****"************

বৃন্দাবনবাবু কদিন যাবৎ লক্ষ্য করছেন তিনি  ইদানিং একেবারেই হাসছেন না। মানে সেই প্রাণখোলা, দমফাটা, পেটে খিলধরানো হাসিটি কিছুতেই হাসতে পারছেন না। শেষ কবে  সেরকম হেসেছেন সেটাও মনে পড়ছে না। এহেন চিন্তা ক্রমে দুশ্চিন্তায় পর্যবসিত হতে থাকে।  বৃন্দাবন খুব গভীর ভাবে অনুধাবন করে বুঝলেন আসলে তাঁর হাসির বেগ বা উদ্রেকটাই বিলকুল উধাও হয়ে গেছে। হাসির কনস্টিপেশন বলা যেতে পারে। এটা কেন হচ্ছে কে জানে। কোনও রোগ কিনা ভেবে একটু ফাঁপরে পড়ে গেলেন। " হাসি পায় না কেন "- লিখে নেট সার্চ করেও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পেলেন না। সব উল্টোপাল্টা তথ্য। এক জায়গায় লেখা আছে দেখলেন, "হাসি মহৌষধ। হাসি না পেলেও জোর করে হাসুন। নিয়ম করে হাসুন। না হলে লাফিং ক্লাবে ভর্তি হয়ে যান।"  একদিন ভোরে উঠে খোলা ছাদে গিয়ে  চারপাশটা দেখে নিয়ে জোর করে হো হো শব্দে হেসে উঠলেন। বেমক্কা হাসির আওয়াজে কার্নিশে বসে থাকা কাকগুলো উড়ে গেল। কিন্তু  কাজের কাজ কিছুই হলো না। এ যেন যান্ত্রিক হাসি। মনে সেই তৃপ্তিটাই এলো না। দু চারবার অমন হাসার পর বরং মনোকষ্টটা আরো চেপে বসলো। আগে তো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হাসি আসতো। হঠাৎ করে কী এমন হল...। 

বৃন্দাবন নিজের প্রতিটি চালচলনের ওপর এবারে ক্লোজ মনিটরিং শুরু করলেন। দেখলেন যথেষ্ট হাসির কারণ থাকলেও তার হাসি পাচ্ছে না। হাসির দৃশ্য দেখে  চারপাশে সবাই যখন হাসে তাঁর হাসি তো পায়ই না উল্টে মনে হয় লোকগুলো এত হাসে কেন? হাসি কি এতই সস্তা নাকি যখন তখন হে-হে করে হেসে ফেললেই হলো! চারপাশে সবাই যত হাসে তাঁর গাম্ভীর্য ততই যেন বেড়ে যায়। কেউ যদি তাঁর হুঁকোমুখ দেখে প্রশ্ন করে, "কী হল, সবাই হাসছে আপনি হাসছেন না যে!" বৃন্দাবন তখন নিরুতপ্ত  স্বরে উত্তর দেন, "সবাই হাসছে বলে আমাকেও হাসতে হবে তার কোনও মানে আছে?" প্রশ্নকর্তা সন্দিগ্ধ চোখে তাঁকে জরিপ করে কী যেন ভেবে নিয়ে সন্তর্পণে তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করেন। 

এভাবে বন্ধুমহলেও যে  বৃন্দাবন ক্রমশ একা হয়ে পড়ছেন সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। ফলস্বরূপ ডিপ্রেশনটা বাড়তে থাকে। বৃন্দাবন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন ঘরের ভেতর। কিন্তু বাড়ির লোকজনও একদিন ব্যাপারটা ধরে ফ্যালে। টিভিতে দমফাটা হাসির সিনেমা চলছে। সবাই হাসছে। বৃন্দাবনের কিছুতেই হাসি পাচ্ছে না। না হাসার কারণে এরপর তাঁর দিকে কিছু অবধারিত  প্রশ্ন যে ছুটে আসতে চলেছে সেটা আঁচ করে তিনি খবরের কাগজ দিয়ে মুখটা আড়াল করেন। ফল উল্টো হলো। মেয়ে ফস করে কাগজটা সরিয়ে রীতিমতো অনুযোগ করে ওঠে, "তুমি কী বেরসিক গো বাপি, এ্যাতো মজার একটা সিনেমা চলছে আর তুমি দেখছ না? দ্যাখো না, হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে তোমার।"

অগত্যা কাগজ সরিয়ে অনেকক্ষণ ব্যাজার মুখে টিভির পর্দায় চোখ রাখেন বৃন্দাবন। অনেকগুলো সিন কেটে গেল। সবাই গড়িয়ে পড়ছে হেসে। তাঁর হাসি পাচ্ছে না। মেয়ে,বৌ তাঁর মুখের দিকে তাকাতেই সন্ত্রস্ত বৃন্দাবন রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ফিক করে  কাষ্ঠহাসির দেঁতো বিজ্ঞাপন দিয়েই শাটার বন্ধ করে ফেললেন।  সেটা দেখেই বৌয়ের ভ্রূ কুঁচকে গেল। বৃন্দাবন বেশ বুঝতে পারলেন কেস কেরোসিন।  এবারে নির্ঘাৎ শয়নকালে বেডরুমের লক আপে  তাঁর এই  ব্যাজার-থোবড়ায়ন-এর ওপর ম্যারাথন জেরা চলবে। হলও তাই। 

অন্যদিন ডিনার সেরে শুকনো আমলকি মুখে পুরে খাটের হেডরেস্ট-এ হেলান দিয়ে একটু আধটু বই চর্চা করেন বৃন্দাবন নস্কর। সেদিন সেসব চুলোয় রেখে সাত তাড়াতাড়ি বাতি নিভিয়ে আশীরনখর ক্যাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে নাক ডাকার ভান করতে লাগলেন । তাতেও শেষরক্ষা হলো না। বৌ কাজ সেরে এসে প্রথমেই ছাগলের ছাল ছাড়ানোর মতো করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো ক্যাঁথাটা সরিয়ে বৃন্দাবনকে বেআব্রু করলেন। তারপর শুরু হলো ঠেলাঠেলি, "এই যে, আর ঢঙ করতে হবে না...ওঠো কথা আছে।"

বৃন্দাবন রা কাড়েন না। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকেন। ফের ঠ্যালা, "কৈ, কথা কানে যাচ্ছে না বুঝি? উঠবে, নাকি আরো জোরে চেঁচিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করব?"

বৃন্দাবন প্রমাদ গোনেন। এই স্পিকার যদি একবার লাউড হয় তবে এক্ষুণি প্রতিবেশীদের জানালায় জানালায় ক্রাউড জমে যাবে । পরদিন মুখ দেখানোর জো থাকবে না। বিশেষ করে পাশের বাড়ির রমেনটা তো ওৎ পেতেই থাকে।  ঘর থেকে বেরোলেই চেপে ধরবে,  "আরে বৃন্দা, তোর বাড়িতে রাতে খুব হৈ- হট্টগোল শুনলাম। কী হয়েছিল? কারো শরীর টরীর খারাপ করেনি তো?" বৃন্দাবন জানেন ওটা ছুতো। খেজুর করে ও আসল ব্যাপারটা জানতে চাইছে। বাজারে খবর আছে কারো বাড়িতে ক্যাঁচাল লাগলেই রমেন পোদ্দার ঝগড়ার ঠিকঠাক নেটওয়ার্ক পেতে  মাঝরাতে ছাদে গিয়ে জলের ট্যাংকের পাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকে পাপারাৎসিদের মতো। জল অদ্দূর গড়ানোর আগেই অবশ্য বৃন্দাবন চোখ কচলাতে কচলাতে  উঠে বসেন। হাই তোলার ভান করে বলেন "কী হল, চেঁচামেচি করছ কেন। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম..."

-"ওসব নাটক রাখো। এবারে বলো তো দেখি তোমার ব্যাপারটা কী? ভাবছ কিছুই টের পাব না। তাই না?" বৌয়ের অর্ধনিমিলীত চোখে চাপাগলার শাসানি শুনে বৃন্দাবনের কেন যেন মনে হয় এই মহিলা তাঁর সহধর্মিনী না হয়ে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসার হতে পারতো অনায়াসে। 
"কে-ক্ ক্যানো... কী হলো আবার?"  ঘাবড়ে গিয়ে বৃন্দাবনের কথা জড়িয়ে যায় । 

-"কী হলোও? ন্যাকামি হচ্ছে? আমার চোখকে ফাঁকি দেবে?" 

-"আরে ঝেড়ে কাশো তো... কী হয়েছে সেটা আগে বলো..." বলে বাড়তি একটু পৌরুষ এনে বৃন্দাবন সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াতেই বৌ ঝাঁঝিয়ে ওঠে। 

-"খবরদার। এই বন্ধ ঘরে সিগারেট খাবে না।"

-" বন্ধ ঘরে ক্যানো। আমি তো... "

-"নোওওও... খাবে না বলছি যখন খাবে না। এবারে আমার কথার উত্তর দাও... তোমার হয়েছেটা  কী?" বৌ এবারে চোখে চোখ রাখে। 

-"কী আবার হবে। কিছুই না। কেন? হঠাৎ এ প্রশ্ন?"

-"দ্যাখো, আমি সব লক্ষ্য করছি অনেকদিন ধরে। বাড়িতে থাকলে মুখটা হাঁড়ি করে বসে থাকো। কিছু জিজ্ঞেস করলে পানসে পানসে উত্তর দাও। হাসতেও যেন পয়সা লাগে তোমার। বাইরে তো দিব্যি হা হা হি হি চলে অফিসের মেয়ে কলিগ গুলোর সাথে। ভাবছ কিছুই খবর রাখি না? তাই না?"

যাক, বৌ লাইনেই আছে। গড়পড়তা ঘরের বৌ যেমন বস্তাপচা ডায়েলগ দেয় তেমনটাই দিচ্ছে। খুব বেশি প্রগতিশীল হতে পারে নি। আন্দাজে  তেড়েফুঁড়ে মিসাইল ছুঁড়েও যখন কাজ হবে না হেদিয়ে গিয়ে কাঁদবে। লাস্ট টুয়েন্টি ইয়ারস এমন ডিফিটিং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বহু দেখেছে বৃন্দাবন। 

"ধূ-স-স-স-স। কী যে বলো? অমন  হাসতে পারলে তো বেঁচে যেতাম।" 

-"মানে! তা, হাসতেই তো বলছি। কে তোমাকে না হেসে মরতে বলেছে।" বৌ তেতে ওঠে ফের। 

-"হাসি পায় না যে আমার। হাসি শুকিয়ে গেছে।" উদাস সুরে কথাটা ভাসিয়ে দিয়ে ফের গায়ে ক্যাঁথা টানতে গিয়ে হোঁচট খায় বৃন্দাবন।  বৌ ক্যাঁথা ছিনিয়ে নিয়ে ঝামটে ওঠে, 
-" ইয়ার্কি হচ্ছে? হাসি কি নদী নালা যে শুকিয়ে যাবে। এক হায়না ছাড়া আর কোনও জন্তু জানোয়ার হাসে না শুনেছি। তুমিও কি সেই পর্যায়ে পড়ো?"

গাধা বানিয়েই তো রেখেছ, কথাটা বলতে গিয়েও গিলে নেয় বৃন্দাবন। এই রাতবিরেতে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয় না তাঁর। বরং এই হাসিহীন জীবনটা বড় অর্থহীন মনে হতে থাকে। আচমকা বৃন্দাবনের মাথায় আইডিয়া খেলে যায় আচ্ছা কাউকে দিয়ে একবার কাতুকুতু দিয়ে দেখলে কেমন হয়। সত্যিই তো! অনেক দিন তো  কেউ কাতুকুতু দেয়নি! এমনও তো হতে পারে কাতুকুতুর চোটে হাসি বেড়িয়ে এলো। অন্তত ছটাক হাসিও যদি বেরোয় তাও তো কিছুটা স্ট্রেস রিলিফ হতে পারে। ছোটবেলায় তো কাতুকুতু খেয়ে কতই না হেসে গড়িয়েছেন। কলেজ হস্টেলের রান্নার ঠাকুর ভুঁড়িদার শম্ভুভাই দূর থেকে কেউ কাতুকুতু দেখালেই  হাসতে হাসতে ছুটে পালাত। তেমনটাও যদি হতো। কিন্তু কাতুকুতু দেবেটা কে। নিজেকে নিজে তো আর দেয়া যায় না। আচ্ছা বৌকে বললে কেমন হয়। কিন্তু তাতে যদি হিতে বিপরীত হয়। তবু যা হয় হোক। কী আর হবে।একটু হাসির জন্য ফাঁসিতে তো চড়াবে না। বৃন্দাবন বলেই ফেলেন, 

-"অ্যাই, শোনো না, তুমি একটু আমাকে কাতুকুতু দেবে..."

বৃন্দাবন যতক্ষণ এসব ভেবে যাচ্ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর কেশলুপ্ত  "গাঞ্জা" ভূখণ্ড তাক করে একতরফা অবিরাম মিসাইল বর্ষণ করে চলেছিল সহধর্মিনী। এই অদ্ভুত কথাটা লঞ্চ করতেই আচমকা সিজ ফায়ার। বৌ স্তব্ধ। বিস্ময়ে ঠোঁট ঝুলে গিয়ে কেমন যেন হতভম্ব দেখাচ্ছে। একটু ধাতস্থ হতেই বৌ বিস্মিত স্বরে বলে ওঠে, 

-"কী বললে? কাতুকুতু দেব? মানে!  হঠাৎ করে কাতুকুতু দিতে যাব কেন। হাসাতে...? "

-"ঠিক ধরেছ। একবার ওটা করেই দেখি না। যদি হাসি পায়।" বৃন্দাবনের কথাগুলো কেমন যেন অসহায় শোনায়। 

বৌয়ের স্বর এবারে তিরিশ ফিট খাদে নেমে যায়। গায়ে হাত দিয়ে, দু' চোখের পাতা টেনে আগাপাস্তালা দেখে বলে, "অ্যাই সত্যি করে বল তো, তোমার কী হয়েছে? শরীর টরীর খারাপ করেনি তো? নাকি অফিসে সিরিয়াস কিছু..."

-"আরে না, না... ওসব কিছু না। এই তোমরা বৌ গুলো না...স্বামীর ঊনিশ থেকে বিশ দেখলে কি টেনশন শুরু করে দিলে। আরে সব মানুষ কি সমান হয়। কেউ বেশি হাসে। কেউ কম। এই যা।" বলেই এই চান্সে বৌ একটু আবেগী হয়েছে বুঝে ঝপ করে সিগারেট ধরিয়ে ফ্যালে বৃন্দাবন। এবারে অবশ্য বৌ কিছু বলে না। অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে স্বামীর দিকে। এরপর হঠাৎ করে মরিয়া হয়ে উঠে বলতে থাকে , 

-"না, না তা বললে তো শুনব না। তোমার মেন্টাল রোগ হয়েছে। না হওয়ার তো কারণ নেই। তোমার বাপের গুষ্টির তো বেশীর ভাগই মেন্টাল পেশেন্ট। তোমার কাকার মাথার গণ্ডগোল ছিল। ঠাকুরদা ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়েছিলেন। সে-ও একপ্রকার পাগলামি ছাড়া কী বলব। তোমার সেই পিসিমা, চরম ছুঁচিবাইগ্রস্ত। সেটাও এক ধরণের মেন্টাল প্রবলেম। এক তোমার বাবাই যা প্রকৃতিস্থ ছিলেন। তাও মাঝে মাঝে  গুম মেরে যেতেন। কালই চলো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাব।"

বৃন্দাবন রিয়ালাইজ করে  কেস ক্রমশ জটিল হচ্ছে। বৌ এবারে সমস্যার গোড়ায় না পৌঁছে ছাড়বে না। কিন্তু গোড়াটাই যে কোথায় সেটাই তো ধরা যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে একসময় বৃন্দাবনের মনে হয় আচ্ছা, এমন তো হতে পারে বৌ যা বলছে সেটাই ঠিক। দৃষ্টান্ত গুলো তো একেবারে ফেলনা নয়। নির্জলা সত্যি। তাহলে কী বাস্তবেই তার সাইকো প্রবলেম হয়েছে? কিন্তু তাই বা কি করে হয়। বাদবাকি সবই তো ঠিক আছে। খাওয়া, ঘুম, কথাবার্তা, মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা, অফিসে কাজকর্ম সব ঠিকঠাক চলছে। কেবল হাসিটাই যা আসছে না। 

বৃন্দাবনের কোনও ওজর আপত্তি ধোপে টেঁকে না। বৌ চেপে ধরে সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার হোড় কেস হিস্ট্রি  শুনতে চাইলে বৃন্দাবন কিছু বলার আগেই বৌ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শ্বশুর কুলের "ছিট" বিষয়ক থানকাপড় খুলতে যাচ্ছিল । 
ডাক্তার থামিয়ে দিয়ে বলেন, "ওঁকে বলতে দিন।" বৃন্দাবন রেখে ঢেকে যতটুকু বলার বলে যাচ্ছিল। কয়েক লাইন বলতে না বলতেই বৌ ঢুকে পড়ে, "না- না ডাক্তার বাবু, ও লজ্জা পাচ্ছে। আমার শ্বশুর বাড়ির দিকে সবাই অল্পবিস্তর তারকাটা।"

"তারকাটা" শব্দটা  যথেষ্ট বোধগম্য হওয়া বা না হওয়ার মাঝে দোদুল্যমান ডাক্তার বাড়তি গাম্ভীর্য এনে বলেন, "আপনি যদি এভাবে মাঝখানে বলেন তাহলে..."

বৃন্দা-বৌ থেমে যায়। বৃন্দাবন বলে যায়। সবটুকু শুনে ডাক্তার কিছু ভেবে বলেন,  "বাড়িতে  ছোট বাচ্চা কাচ্চা আছে?"

"বাচ্চা! কেন ডাক্তার বাবু।" বৃন্দাবন আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে। 
-"আছে কি নেই বলুন।"
-"না। নেই।"
-"আনতে হবে।"
-"মানে! এই বয়সে আবার বাচ্চা..." বৃন্দা-বৌ  আতংকে এবারে আর মুখ বন্ধ রাখতে পারে না। 
-"বাচ্চা আনা বলতে বলতে চাইছি বাচ্চাদের সান্নিধ্য। নিজের না থাকলে পাড়া পড়শির বাচ্চাদের সাথে মিশুন। তাদের ঘরে ডেকে আনুন। কথা বলুন। সব সমস্যা কেটে যাবে।"

বৃন্দাবন দম্পতি পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি  করে। ডাক্তার হোড় চশমার ওপর দিয়ে দুজনকে একবার দেখে নিয়ে কাগজে খসখস করে কিছু লিখে বৃন্দাবনের হাতে দিয়ে  বলেন, "এটা ধরুন।"

বৃন্দাবন একবার তাতে চোখ বুলিয়ে বলেন, "এটা তো একটা..."
-"হ্যাঁ একটা ঠিকানা। পরশু রবিবার সকাল ন'টা নাগাদ ওখানে চলে যাবেন।"
-"কিন্তু তাতে কী হবে?"
-"কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও প্রশ্ন নয়... যা বলছি  সেটাই করবেন" ফেলুদা স্টাইলে ডাক্তার তর্জনী হেলিয়ে কথাটা বলে চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসেন। 

-"আর ওষুধ পত্তর...?" বৃন্দা-বৌ ফের মুখ খোলেন। 
ডাক্তার হোড় প্রেসক্রিপশন কাগজে লিখে দ্যান
১) দিনে আট ঘন্টা ঘুম
২) শুধু মাত্র দু ঘন্টা মোবাইল যাপন (ঘুমোনোর আধঘন্টা আগে সুইচড অফ করা আবশ্যক) 
৩) প্রত্যহ মর্নিং ওয়াক কম করে দু কি. মি
৪) পেট পরিষ্কার রাখা
৫) পরিবারের লোকজনের সাথে যথেষ্ট সময় কাটানো
৬) ভাল ভাল বই পড়া। 

বৃন্দাবন একবার চোখ বুলিয়ে রেখে দেন। কিন্তু অন্য কাগজটাই তাকে ভাবাচ্ছে। সেখানে লেখা। 
"চাঁদের পাহাড়"
বিজনপুর  বাস স্ট্যান্ড থেকে দুই কিমি দক্ষিণে। ঠিক সকাল ন'টায়
নিচে একটা ফোন নম্বর দেয়া। 

"বিজনপুরে না গেলে কিন্তু অসুখ সারবে না। ওখানেই আছে আপনার ওষুধ। পৌঁছে ঐ নম্বরে কল করে  নেবেন ।" বলেই ডাক্তার কলিং বেল টিপে দ্যান পরের পেশেন্টের জন্য। 

শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহর বিজনপুর। চাপা কৌতূহল বুকে চেপে বৃন্দাবন বাস থেকে নামেন। স্ট্যান্ডে নেমে প্রদত্ত নম্বরে কল করেন।  মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঠিক ন'টায় ই-রিক্সা চেপে বৃন্দাবন একটি অনুচ্চ পাহাড়ের ওপর লম্বা দোচালা স্কুল বাড়ির মতো বাড়ির গেটে নামেন। গেটের বাইরে ফলকে লেখা "চাঁদের পাহাড়"। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই বৃন্দাবন দেখেন অনেকগুলো ছেলে মেয়ে সেখানে ছোটাছুটি করছে। আর একধারে একটু ছোট শিশুরা  হাতে হাত রেখে গোল হয়ে ঘুরছে । আর তাদের মাঝখানে একজন মাঝবয়েসি মানুষ। কিন্তু এ-এ -কি! এ যে ডাক্তার হোড়!! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে থাকেন বৃন্দাবন বাবু। ডাক্তার হাসি হাসি মুখে হাতে তালি দিয়ে গান গাইছেন শিশুদের সাথে "আমরা সবাই রাজা.. ."
কিছুক্ষণ পর গান থামিয়ে ডাক্তার এগিয়ে আসেন। বলেন, "চলুন ওদিকে গিয়ে বসি।"

একটি গাছের তলায় দুজনে বসেন। কপালের ঘাম মুছে ডাক্তার বলেন, "খুব অবাক হলেন তাই না?" বৃন্দাবনের অবাক হওয়ারই কথা। 

-"এটি একটি অনাথালয়। শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ডাক্তার একসময় এটি গড়ে তোলেন। তাঁরাই  চালান।  এখন আমিও আছি তাঁদের সাথে। আমি প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ চলে আসি। দুপুর অবধি এদের সাথে কাটিয়ে চলে যাই। তবে এখানে প্রথম আসি  নিজের স্বার্থেই।"

-"আপনার কীসের স্বার্থ ?" বৃন্দাবন জিজ্ঞেস করেন। ডাক্তার হোড় ঘাম মুছে চশমাটা  পড়ে বলেন একটু হাসেন। তারপর বলেন , "আমিও যে আপনারই মতোই একসময় হাসতে ভুলে গেছিলাম। আপনার মতোই ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে। প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হয়েছিল। ওষুধ পত্তর খাইনি। শুধু খুঁজতে চেয়েছি রোগের কারণ। একদিন এক ডাক্তার বাবুর পরামর্শে এখানে আসা। আজ আমি এই অনাথ শিশুগুলোর মাঝে জীবনের পরম আনন্দ খুঁজে পেয়েছি। ওরা দুঃখ কি জানে না। হোঁচট খেলে কাঁদে। পরক্ষণেই ভুলে গিয়ে হেসে ওঠে। আমরা বুড়োরা তা পারিনা। দুঃখ পুষে রেখে কষ্ট পাই। যাক গে, সেসব... এবারে  আসুন তো আমার সাথে..."

ডাক্তার হোড় আবার এগিয়ে যান বাচ্চাদের দিকে। বৃন্দাবন অনুসরণ করে তাঁকে। ওদের কাছে গিয়ে ডাক্তারবাবু বৃন্দাবনকে দেখিয়ে বলেন "এ আমার বন্ধু। আজ থেকে  তোমাদেরও বন্ধু। তোমরা খেলায় নেবে তো এঁকে?"

বাচ্চারা সমস্বরে বলে ওঠে,"হ্যাঁ...." । হঠাৎ একটি ছোট্ট মেয়ে এসে বৃন্দাবনের পাঞ্জাবির কোণাটুকু ধরে টানতে থাকে। বৃন্দাবন একটু অবাক হয়ে বলেন, "কী হল? কিছু বলবে?"

মেয়েটি ভাসাভাসা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, "তোমারও বাবা-মা কে-উ-উ নেই ...?" 

মুহুর্তে বৃন্দাবনের দু'চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। দু'হাতে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে দু গালে চুমু খেতে খেতে বৃন্দাবনের কেন যেন মনে হয় তিনি সঠিক ওষুধটি পেয়ে গেছেন। মেয়েটি তাঁর খুব স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করেছে। বুকের ভেতর মেঘ ভেঙে তেড়ে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টি থেমে গেলেই এবারে বহুদিন বাদে ঝলমলে রোদ উঠবে। মেঘ না সরলে যে রোদ ওঠে না। যে রোদ ঢাকা পড়েছিল কালো মেঘের পরতে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri