মুহূর্ত/সুনীতা দত্ত
মুহূর্ত
সুনীতা দত্ত
আজকাল নিরন্তর ভালো থাকা চারিদিকের মানুষগুলোকে অবিরত অনাবিল আনন্দ দেয়া আর হয়ে ওঠে না। অথচ শিক্ষাজীবনের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিন চেষ্টা চলত অন্যকে ভালো রাখার। হয়তো সর্বাগ্রে সেটা সম্ভব হত না কিন্তু দিনশেষে একটা অচেনা ভালোলাগা তৈরি হত। আমার সেই মুহূর্তগুলোতে শুধুই অক্ষরের রং খেলা চলত সুরের সমস্ত রাগ যেন নেমে আসত আমার আঙুলগুলোতে। কেন? কারণটা শুধুই লেখা - ডায়েরির পাতা ভরাট করার সময় পানকৌড়ির মত মন ইচ্ছেডানায় ভর করে উড়ে চলত। হাজার কষ্ট, দুঃখ, রাগ, অভিমান, জ্বালা, ভালোবাসা সব ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলার পর মনে অপার এক শান্তি নেমে আসত যেটা ভাবলেও আজকাল খুব আনন্দ পাই। সেদিন পুরানো রঙ ছটা একটা খাতা চোখে পড়তেই মনটা খচখচিয়ে উঠলো। কলেজ জীবনের সময়ের লেখা - একটা গল্প বোধহয়! পড়ে দেখলাম রসদ কিছু ছিল না কিন্তু আমার আমি কে ওই গল্পে আবিষ্কার করলাম অক্ষর বিন্যাসে, হাজার হাজার শব্দ নির্নিমেষ লিখে গেছি, কই এখন তো সেভাবে লিখতে পারি না। ইচ্ছে হলো নিজের সাথে আবার একাকার হওয়ার।
আজকাল সবারই প্রায় এক অবস্থা। সবদিকে সময় দিতে গিয়ে ভালোলাগার গানগুলো হারিয়ে যেতে যেতে অন্তরীক্ষে পৌঁছাতে বসেছে। মনে সোনালী স্বপ্ন না দেখি টুকরো করে ফেলে আসা, ফেলে চলা কিছু আনন্দ রাশি ভাগ হয়ে অনেকের মনকে অপার আনন্দ দিক। ভরিয়ে তুলুক জীবনের জটিল অংকের পরিসর।
রাত জাগা চোখ গুলো ঢুলুঢুলু চেয়ারে বসে হেমন্তের হাওয়ায় একটু শীত শীত ভাব নিয়ে সামনে তাকাতেই চোখ পড়ল উদয়ের দিকে, উদয়ের যা বয়স তাতে ওকে নাম ধরে বলা সাজে না, তবে আমি নাম ধরে ডাকি না। ভাববাচ্যে তুমি বলি। নিজস্ব কাজের ধরনেই উদয়কে জিজ্ঞেস করলাম -"কি ব্যাপার, কি লাগবে?"
নেশায় বুঁদ উদয় টলছে, তাকাতেই পারছে না আমার দিকে। আমি ঘরের ভেতর চেয়ারে বসা ও গ্রিলের বাইরে, মাঝে ছোট বারান্দা, সেখান থেকেই বলছে - "দিদিমনি, শরীরটা খুব ব্যথা, হাতে কাটছে একটু ওষুধ দিবি?"
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার বাইরে বারান্দায় এলাম কোথায় , কি হয়েছে দেখতে চাইলাম। এরই মধ্যে আমার সেন্টারের (উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র) পাশের বাড়ির মাসি বেরিয়ে এল। উদয়কে গ্রিলের পাশে সিঁড়িতে বসতে বললাম। পাশের বাড়ির মাসি বলল- "আরে ও কালকে বাড়িতে মারামারি করেছে। দেখ না হাতে কতখানি কাটা!"
দেখলাম ডান হাতের তালু অনেকটা ঝুলে গেছে। কল থেকে জল এনে নোংরা হয়ে যাওয়া হাতটা ধুয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে করতে বললাম, " কার সাথে মারামারি করলে?" উদয় ওরাও বছর চুয়ান্নর প্রবীণ মানুষটির চোখ দিয়ে জল পড়ল টপ করে আমার হাতের উপর। কিছু বললাম না আর। আমার নীরবতায় উদয় কিছু বুঝল কিনা জানি না চোখ মুছে অভিযোগ জানাল ছেলের নামে। পাশে মাসির থেকে জানলাম সারাদিন হাড়িয়া খেয়ে জঙ্গলের কোণে পড়েছিল। কেউ হদিস পায়নি সারাদিন। ছেলে যখন খোঁজ পেয়েছে রাগে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেছে। এসব শুনতে শুনতে উদয়ের হাতের ফার্স্ট এইড করা হয়ে গেল। উদয় বলল -"দিদিমণি ব্যথার ওষুধ দিবি না?"
আমার খুব রাগ হল-"কি আর দিব ?তোমার কি শরীরে ওষুধ কাজ করবে? হয়তো ওষুধটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাড়িয়া দিয়ে খাবে!"
উদয় বলল -"না দিদিমণি , ওই সব আর খাব না রে!" আমি বললাম -"কথাটা মনে থাকবে?"
"হ্যাঁ থাকবে" বলে উদয় টলতে টলতে চলে গেল। কয়েকদিন পর উদয় আবার ওষুধ নিতে এল। "কি হয়েছে?" "জ্বরের ওষুধ নিব।"
আজ উদয় সামনে এল একদম স্বাভাবিক। আজকের আগে ও অনেকবার ওষুধ নিতে এসেছে, যতবার এসেছে অপরিচ্ছন্ন, ঢুলুঢুলু শরীর। কিন্তু আজ হাসছে আর বলছে -"কিরে দিদিমনি, জ্বর হইছে বললাম রক্ত নিবি না?" আমি হাসলাম। ওকে বললাম -"যতবার জ্বর হয়েছে, রক্ত নিতে চাইলে বলেছ না না ব্যথা লাগে, দিব না।" উদয় হাসছে। স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল -"তুই সেদিন না করছিস, আমি এখন আর রোজ নেশা করি না। মাঝে মাঝে হাটে গেলে অল্প খাই।" আমি চুপ করে থাকলাম। উদয় ওর সাথে আনা ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিক বের করে আমার দিকে দিল । বলল -"বৌমা একদিন বলেছিল,তুই লেবু খাইস রোজ, এই নে আমার গাছের লেবু, খাইস!"ওর রক্তের নমুনা নেওয়ার পর ওষুধ দিলাম। উদয় জানাল রিপোর্ট আসলে জানাতে। ও এটাও আমাকে নিশ্চিত করল ও আর হাড়িয়া দিয়ে ওষুধ খায় না। ওর চিকিৎসা পর্ব শেষ হলে ও বিদায় জানিয়ে চলে গেল।
শান্ত মনে নিজের বরাদ্ধে থাকা চেয়ারটাতে বসলাম টেবিলে রাখা লেবুর প্লাস্টিক। উদয়ের বৌমা আমার সেন্টারে প্রায়ই আসে। ওকে ছোট থেকেই দেখেছি আমি। ওর নাম মালতি। ও মাঝে মাঝে এসে গল্প করে আমার সাথে। মাঝে মাঝে চা করে এনেও খাওয়ায় পাশেই বাড়ি বলে। ওর সাথে কথায় কথায় কথা হয়েছিল, আমি সকালে লেবু জল খাই । সেই কথা উদয় কোনোভাবে শুনেছে, মনেও রেখেছে। একা বসে ছিলাম পাশের বাড়ির মাসি এসে সামনের বেঞ্চে বসলেন। আমি তখন মনে মনে ভাবছি উদয়ের এত পরিবর্তন! সামনে বসা মাসি বলল, "উদয় তোমার কথা খুব বলে। তোমার বকা শুনতে নাকি ওর ভালোলাগে। তোমাকে মেয়ের মতো দেখে।"
সেদিন মনের কোণে এক টুকরো আনন্দ সারাদিনের ক্লান্তি, ক্ষোভ সব দূর করে দিয়েছিল। জীবনের এই পরম পাওয়াটুকু কখনো শেষ হওয়ার নয়। এইরকম মুহূর্তগুলো বারবার চিৎকার করে অন্তরে আলো জ্বালে, "ভালো আছি, আমি সত্যিই ভালো আছি!"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴