মিলি ভট্টাচাৰ্য-র আলোচনায় সৌগত ভট্টাচাৰ্য-র 'ফ্রেমের বাইরে'
মিলি ভট্টাচাৰ্য-র আলোচনায় সৌগত ভট্টাচাৰ্য-র 'ফ্রেমের বাইরে'
ফ্রেমের বাইরে
সৌগত ভট্টাচাৰ্য
আলোচনা : মিলি ভট্টাচাৰ্য
অবিন্যস্ত চুল, গুরুগম্ভীর কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে দুটো গভীর চোখে নবীন কিশোরের দৃষ্টি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা নিয়ে প্রায় মাঝবয়সী কোনো ভদ্রলোককে যদি পথ ঘাট মাঠ আকাশ নদীর সাথে সখ্যতা পাতাতে দেখেন, অথবা
প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতরে কোনো গলির মুখে ঝুপড়ি চা দোকানে বসে হেসে হেসে গল্প করতে দেখেন, বুঝবেন উনি সেই ভদ্রলোক যিনি পেশায় অধ্যাপক আর নেশায় ছবি কথার সৃজক।
উনি আমাদের ভাতৃ প্রতিম সৌগত ভট্টাচাৰ্যl
সম্প্রতি, উত্তরবঙ্গের ৪২তম বইমেলা থেকে কিনলাম তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই 'ফ্রেমের বাইরে'। মলাটের ছবি, বই এর পাতায় পাতায় illustration আর বর্ণমালার বুননে এক অদ্ভুত সুন্দর নকশিকাঁথা! পড়তে গেলেই চোখের সামনে ব্যক্তি বস্তু সপ্রাণ হয়ে নড়ে চড়ে বেড়াবে, ভাবাবে, ভালোবাসাবে।
প্রচ্ছদে চমক ---বনলতা ফুল পাখির নিরালা সাম্রাজ্য আর ফ্রেমের ভিতর থেকে ফ্রেমের বাইরে পাখিমনের পলায়ন ---একটা উড়াল, বাধা গৎ থেকে অজানা ভাবের আকাশে এক গভীর ড্রাইভ!
পাতার ভাঁজে ভাঁজে illustration, এঁকেছেন শিল্পী সুপ্রিয় ঘটক। বইটি উৎসর্গিত লেখকের দুই বিশ্বস্ত বন্ধু বাইক আর ক্যামেরাকে, কী ভীষণ অযান্ত্রিক!
কথাকার সৌগত তাঁর রোজকার যাতায়াতের পথে ক্যামেরায় চোখ রাখেন অধরা মাধুরীর খোঁজে। খুব চেনা পরিসরেও অচেনার আনন্দ খোঁজেন কৈশোরের চাপল্যে! আর অদ্ভুত সুন্দর ভাষা বিন্যাসে তা ব্যক্ত করেন কেমন বাউল গানের মতো। সহজ সরল কলেবরে এক গভীর দর্শনের বাস।
"প্রায়দিনই বিকেলবেলায় সিগন্যাল ঘরের সামনে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে শরতের মুখোমুখি হই। সামনে নদী, অদ্ভুত লাল একটা আকাশ, সূর্য ডোবার আগে সে তার সমস্ত রং ঢেলে দিচ্ছে নদীর জলে, কাশ ফুলের ডগায় আর ধানের শিষে।
------------আমরা তিনজনে দাঁড়িয়ে থাকি, আমাদের সামনে শরৎ অপেরা। এক আকাশ তলে দাঁড়িয়ে তিনজন তিন রকমভাবে। এই অপেরার দর্শক!" (শরৎ অপেরা )
নীরস তত্ত্ব দর্শনে বা ঝকঝকে বুদ্ধির শানিত ছটায় যখন বোধ ধাঁধিয়ে যায়, মন হাঁপিয়ে ওঠে, এমন সাবলীল গদ্য ওর মরমী মন নিয়ে আরাম পৌঁছে দেয় মস্তিষ্কের কোষে কোষে। আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে উজ্জীবনে ---
ঐ তো আলো, ঐ তো প্রাণ!
"ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। সে নেমে যাওয়ার আগে কাঁধ ব্যাগ থেকে সামান্য আবির আমার গালে ছুঁইয়ে দিয়ে মুখটা আমার মুখের কাছে এনে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বলে --কালা, তোকে যে বড়ো মনে ধরেছে রে কালা! ট্রেনের চৌকো জানলার ফ্রেমে একটার পর একটা দৃশ্য তৈরী হচ্ছে আবার কত দৃশ্য হারিয়ে গেছে প্রতিদিন। আজ অবধি অমনভাবে কালা ডাকে ডাকতে শুনলাম না।"
"কালার সব গোপিনীই বসন্ত দিনে মথুরা বৃন্দাবন আলো করে হোলি খেলে, এমন তো নয়। কেউ কেউ দু'হাতে তালি বাজিয়ে ট্রেনে ট্রেনে মাধুকরী ও করে।"
(মাধুকরী )
সুন্দর অসুন্দরের পাঁজর ভেদ করে কথাকারের চোখ মানুষ খুঁজে ফেরে -----
"বাইক স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখি, কবেকার সেই ছালবাকল ওঠা বৃদ্ধ গাছগুলির গায়ে কত রঙের নতুন অর্কিড ফুটেছে, গাছগুলোর শরীর অর্কিডে ভরে আছে।সবাই একে একে চলে গেলেও পুরোনো গাছ আর অর্কিড কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না l"
"কোনো এক প্রবল বৃষ্টির দিনে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার ধারে একটা শেডের তলায়, দেখি প্যান্ট জামা গুঁজে পরে গলিন একটা বিরাট মানকচুর পাতা কে ছাতার মতো ধরে অন্য হাত দিয়ে পাতার বাঁশিতে "মেরে নয়না শাওন ভাদো "--বাজাতে বাজাতে হেঁটে যাচ্ছে। ওর পিছন পিছন সবুজ হাই ওয়ে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আস্ত একটা বর্ষাকাল।"
(হাই ওয়ে কোলাজ )
অতি সাধারণ আটপৌরে জীবনের ভাঁজে ভাঁজে যে নান্দনিকতা লুকিয়ে থাকে, গতানুগতিক জীবনযাত্রার খাঁজে খাঁজে যে অমল আলোর পরশ এসে লাগে তা পার্থিব কে অপার্থিব করে তোলে। সাধারণ থেকে অসাধারণে উত্তরণ ঘটায়। আর এই রঙিন নকশিকাঁথাই কথাকার বুনে চলেন পরম মমতায়, কখনো ক্যামেরা চোখে নিয়ে, কখনো কলম হাতে নিয়ে। এই নকশিকাঁথার বিস্তার অজ্ঞাত জনপদ থেকে ঐতিহাসিক নগর -- সাধারণ মানুষের সুখ দুখের বারোমাস্যা, তার নির্মোহ উদাসীনতা, তার প্রগাঢ় মায়া বন্ধন, সব কিছু ধরা দেয় কথায় ছবিতে। ক্যামেরা শিল্পী সৌগতের প্রতিটা ছবিই তাই অনেক কথা বলে।
আমি নিবিড় পাঠক, আবিষ্কার করি ছবি কথার পিছনে এক সংবেদনশীল হৃদয়কে, এক সুন্দর মনের মানুষকে।
আমি এক অতি সাধারণ পাঠক, আনন্দরসের মাধুকরী করি, আর বলি :
"বয়ে চলো বয়ে চলো
কালোর বুকে আলো হয়ে
সময়ের বুকে জীবন হয়ে
বয়ে চলো ----"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴