মালার সঙ্গে খেলা/চিত্রা পাল
মালার সঙ্গে খেলা
চিত্রা পাল
----------------------
গাড়িটা যেই অরণ্যের পথ ধরল রিজু একেবারে চুপ। ও অবাক বিস্ময়ে চারপাশ দেখতে থাকে। এর আগে বেশ ঘ্যান ঘ্যান করছিল। আসলে কি জানি কেন ওর মেজাজ ঠিক নেই। শিলিগুড়িতে দিদার কাছে এসে একটু ঠিক হয়েছিল, তাও পুরোপুরি নয়। তবে ওর দিদা একটা মজার গল্প বলতে শুরু করলে সেটা কিন্তু ও বেশ মন দিয়ে শুনছিল। সেই যে সেই এক গহীন বন, যেখানে ময়ূর পেখম মেলে খেলে বেড়ায়, টিয়ার ঝাঁক টি টি করতে উড়ে যায় সেইরকম এক মজার দেশের কথা। ও থাকে শহরে,স্কুলে যায় বটে তবে এমন গাছপালা সবুজের সঙ্গ তো পায় না, তাই সেই ভালো লাগাটাও গড়ে ওঠেনি। জলদাপাড়া অরণ্যের কথা শুনেছে, ছোটবেলায় নাকি ও একবার এসেওছিল, কিন্তু তখন ও খুব ছোট সেটা মনে রাখার বয়সও নয়, তাই মনে নেই । এখন একটু বড় হয়েছে, এবার ক্লাস ওয়ান সেটা আবার ওর কাছে খুব গর্বের। যে জিজ্ঞেস করে, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো, ও বেশ বুক ফুলিয়ে উত্তর দেয়, আমি এখন ক্লাস ওয়ান। আর ন বছর পরেই আমার স্কুল শেষ। এই তথ্যটা অবশ্য ওর বাবা ওকে বলেছিল। যেদিন ও প্রথম ক্লাস ওয়ানের ক্লস শুরু করে সেদিনেই ওকে বলেছিল আর ওর ও বেশ মনে ধরেছিল কথাটা।
মাদারিহাট থেকে অরণ্যের দিকে যেতেই রিজুর মনে হলো ও যেন এক সবুজ রাজবাড়িতে এসেছে। কত গাছপালা। আসলে এ অরণ্য শাল, শিশু খয়ের সেগুন এসব গাছের অরণ্য। অরণ্যর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে তোর্ষা আর মালঙ্গী নদী পুব থেকে পশ্চিমে। অবশ্য মাদারিহাটের আগে থেকেই সেই সবুজের রাজ্য শুরু হয়েছে। ওই দেখো একটা ময়ূর কি বড় পাখা ওর, বলে চিৎকার করে বলে। ওর দিদা বলে, এখানে একবারে জোরে কথা বলবে না। ক্যানো জানো?’ রিজু ফিসফিস করে বলে ‘ক্যানো’? দিদাও খুব আস্তে বলে, ‘ওরা না একেবারে শব্দ পছন্দ করে না।আর ওরা বিরক্ত হয়, ভয় ও পায়।তাই শব্দ শুনলেই ওরা পালিয়ে যায়। তাই এইবনভূমে গাড়ির হর্ন বাজানো ও বারণ।
রিজু ওর মা বাবা দিদার সঙ্গে যখন এখানে পৌঁছল তখন প্রায় দুপুর। ওর মা বাবা এখানে থাকা,দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে,রিজুর দিদা তখন ঘর সংলগ্ন বারান্দায় বসলেন বেতের চেয়ার টেনে। বললেন, এই যে একটা ছোট নদী মতো দেখছ, এটা কিন্তু একটা নদীর অংশ, সে নদীর নামটাও ভারি মিষ্টি, তার নাম তোর্ষা। এই সমস্ত অরণ্যটাই তোর্ষার ধারে। রিজু জিজ্ঞেস করে, ‘এখানে বাঘ দেখতে পাব’? তুমি হাতি দেখতে পাবে, কত হরিণ দেখতে পাবে, যদি কপাল ভালো থাকে তাহলে গন্ডারের ও দেখা পাবে। ওদের কখন দেখব? ওই যে দূরে একটা সাদা রঙের ঢিপি দেখতে পাচ্ছ, ওখানে ওদের খাওয়ার জন্য লবন বা নুন দেওয়া থাকে, ওরা ভোর বেলায় ওই নুন খেতে আসে। তখন দেখা যায় ওদের। রিজু বলে, কাল আমি ভোর বেলায় ঊঠে ওদের দেখবো।এমন সময় ওর বাবা বললো, রিজু স্নান টান করে তৈরি হয়ে নাও। আমরা খেতে যাবো।
তখন রিজুকে যে কথা গুলো বলা হলো না, সেগুলো ওর দিদার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। মনে হয় এই সেদিনের কথা। রিজুর মা,ছোট্ট মণিকে নিয়ে এসেছিলেন এই ডুয়ার্সের অরণ্যে। তখন মণির বাবা এই অরণ্য নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, সে অনেক আগেকার কথা। তখন এমন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ধারণাও আসেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর ও আগে এই ভয়ংকর ঘোর বনাঞ্চলে বাস করতো টোটো মেচে এই সব উপজাতি। আসলে এরাই এই মাটির মানুষ। এইসব জায়গাগুলোর ও নামের সঙ্গে মিলিয়ে, যেমন টোটোপাড়া, মেচপাড়া। অনেকপরে বোধ হয় ১৯৪১-৪২ সালে জলদাপাড়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অঞ্চল নামে এই অঞ্চলের নামকরণ হয়। আর ২০১৪ সাল থেকে এই অঞ্চল জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানবলে পরিচিত হয়। তবে প্রাথমিকভাবে এখানে মানে এই বনাঞ্চলকে ভারতীয় গন্ডারের সংরক্ষিত অঞ্চল বলেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।এসব ভাবনার মধ্যেই মণিএসে বলে, মা খাবে চলো’ তখনকার মতো ভাবনা স্থগিত রেখে ওনাকে উঠে পড়তে হলো দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের উদ্দেশ্যে।
বিকেলে ওরা হুডখোলা জিপে করে বেশ অনেকটা ঘুরে এলো। একটা নজরমিনারেও উঠেছিল ওরা। সেখান থেকে রিজুর যে গাছটাই চোখে পড়ছে, জিজ্ঞেস করছে এটা কী গাছ, ওই গাছটার নাম কি? রিজুর বাবাও আর সব জানে না। যতটা জানে বলছে, আবার সঙ্গের গাইডকেও জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছে।ফেরার সময় রিজু দেখে একটা বড় হাতির সঙ্গে একটা বাচ্ছা হাতি। বড় হাতিটা যেমন করে শুঁড় দুলিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে খাচ্ছে, ছোটটাও চেষ্টা করছে তেমন করে খেতে। তাই দেখে রিজু আনন্দে বলে ওঠে, দ্যাখো, দ্যাখো বড়টা যেমন করছে, ছোটটাও তেমন করছে। রিজুর কথা শুনে গাইড বলে, ও করবে না ক্যানো, ও যে ফুলকুমারী আর ওর মেয়ে মালা। ওর মা যা করবে, মালাও তাই করবে। এই করেই ওরা শেখে সব কিছু। রিজু জিজ্ঞেস করে সব কিছু মানে? গাইড বলে, মানে এই খেতে শেখা, কেমন করে গাছের পাতা টেনে খেতে হয়, কেমন করে নদী পেরোতে হয়, কোনদিকে বিপদের ভয়,সেইদিকে না যাওয়া এই সব কিছু। রিজুর দিদা পাশ থেকে তখন ওকে বলে, যেমন তোমাকে শেখাতে হয়, কেমন করে কলার আধখান্মা ছাড়িয়ে ধরে একটু একটু করে খেতে হয়, তেমন। রিজু বুঝলো ব্যাপারখানা।
পরদিন ভোরে হাতির পিঠে চেপে ওরা বেরোল অরণ্য ভ্রমনে। আজ ওদের নিয়ে যাচ্ছে সেই কালকের ফুলকুমারি সংক্ষেপে ফুল। মাহুতের কথা কিসুন্দর বুঝতে পারেফুল।ওদের নিয়ে যেই ফুল যেই চলতে শুরু করলো,তেমনি মালাও এসে যোগ দিলো ওদের সঙ্গে। যেতে যেতে ফুল সামনে ওর পছন্দের খাবার যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে শুধু নয়, মালাকেও দিচ্ছে। গাছের কচি পাতা, কচি ঘাসের ডগা এসব। মালা কিছু খাচ্ছে কিছু ফেলছে। চলতে চলতে ওরা বনের ভেতরে একটা ছোট জলধারার কাছে এসে ফুল দাঁড়িয়ে পড়েছে।তখন মাহুত বললো, ওর বাচ্ছাটা আসেনি, তাই। একটু পরে মালা দৌড়ে মায়ের গা ঘেঁসে দাঁড়াতে ফুল শুঁড় দিয়ে ওকে কাছে টেনে আবার চলতে শুরু করে। রিজু খালি মালার কান্ডই দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই ফুল ওর বাচ্ছাকে শুঁড় বুলিয়ে দিচ্ছে। ওর বাচ্ছাও খুব খুশি। রিজুর একবার মনে হলো মালা যেন হাসছে। সে কথা ওর বাবাকে বলতে ওর বাবা হাসি চেপে বলে, তাই তো ।
এই হাতির পিঠে চেপে ঘুরতে খুব মজা লেগেছে রিজুর, অবশ্য রিজুর কেন ওদের সকলের। ওখানকার অফিস থেকে রিজুর বাবা একখানা এই অরণ্যর ওপরে লেখা বই কিনে এনেছে। সেই বইতে এই অরণ্য সর্ম্পকে অনেক কথা লেখা আছে। সন্ধ্যে বেলায় চা খেতে খেতে সেই বিবরণ দেয় রিজুর মা, দিদাকে। বলে, এখানে অনেক প্রজাতির গাছপালা আছে,আছে অনেক প্রজাতির পাখি যা আর কোথাও দেখা যায় না। এখানে এত লম্বা লম্বা ঘাস হয় যে হাতি পর্যন্ত্য সেই ঘাসের বনে দিব্যি ডুবে যায়। সবচেয়ে বড় কথা এই জলদা পাড়া অরণ্যে আছে প্রচুর গন্ডার। সঙ্গে সঙ্গে রিজু বলে ওঠে আজ সকালেই তো দুটো তিনটে চারটে গন্ডার দেখলুম না মা? ওর মা বলে, হ্যাঁ তা দেখেছি। রিজুর বাবা সেই কথার পিঠে বলে, তা তো দেখতেই পারো, কেননা কাজিরাঙ্গার পরেই তো আমাদের দেশে এখানে সবচেয়ে বেশি গন্ডার আছে। এবার হঠাত্ রিজু বলে, বাবা, মালাতো আমার চেয়ে ছোট,কিন্তু দেখতে কি বড়ো ও বল নিয়ে খেলতে পারে? ওর বাবা একটুও চিন্তা না করে বলে, হ্যাঁ,হ্যাঁ খুব খেলতে পারে, ওকে বল দিলে এমন মারবে যে ওই লম্বা লম্বা বাঁশ ঝাড়ের ওপর দিয়ে চলে যাবে । আচ্ছা বাবা ও যখন ঘুমোয়, ও কি ওর মার কাছে থাকে? হ্যাঁ ও তো ওর মায়ের কাছেই থাকে। তখন দেখলি না, একটু দূরে গিয়েছিলো বলে ওর মা কত বকাবকি করলো। কখন? ওই যখন এলো তখনই তো।
রাতেও রিজু মালার কথা বললো কবার। পরদিন সকালে রিজু ওর বাবার সঙ্গে সামনের খোলা জায়গায় বেড়াচ্ছে, এমন সময়ে রিজু দ্যাখে হাতির পিঠে চড়বার যে সিঁড়ি মতো আছে, সেখানে একটা বাচ্ছা হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখে ওর বাবা বললো, ওটা বোধ হয় মালা। সঙ্গে সঙ্গে রিজু বলে বাবা,আমি ওর কাছে যাবো। ওর বাবা বললো চলো। দুজনেই এখন মালার কাছে। এবার ওর বাবা দু একবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ও বেশ মাথা নীচু করেছিলো। রিজুর খুব ইচ্ছে হলো,ওর সঙ্গে খেলবে । তার আগে একবার ওর মাথায় হাত দেবে। ওর বাবা বললো আয়, কোলে ওঠ, না হলে ওর মাথায় হাত পাবি না। রিজু ওর বাবার কোলে উঠে ওর মাথায় একবার হাত দিয়েছে। এবার যেই আর একবার মাথায় হাত দিয়েছে, মালা ওদের একেবারে কাছে আসার চেষ্টা করছে। যত ওর বাবা ওকে কোলে নিয়ে সরে যাচ্ছে, তত ও আরও এগিয়ে এসে একেবারে শুঁড় বাড়িয়ে দিয়েছে রিজুর গায়ে। রিজু ভয়ে চিল চীত্কার করে কেঁদে উঠতে একটা থপ থপ করে জোর শব্দ হয়। সবাই তাকিয়ে দেখে, মালার মা ফুল দৌড়ে এদিকে আসছে। রিজুকে নিয়ে ওর বাবা কোনক্রমে দোতলায় উঠে গেলে সবাই তাকিয়ে দেখলো,যে ফুল আসলে মালার কাছেই আসছিলো। মালার সারা গায়ে শুঁড় বুলিয়ে যখন ওকে নিয়ে চলে গেলো বনের দিকে,সবাই তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেন। রিজু আর বাবার কোল থেকে নামে না। বলে, আমি তো মালার সাথে খেলতেই চাইলুম, ও ও রকম দৌড়ে এলো ক্যানো? ওর বাবা জানে, মালা ও খেলতেই এসেছিলো ওর মতো করে কিন্তু আমরা যে ওদের বুঝতেই পারি না, আর ওরাও আমাদের বুঝতে পারে না। যদি আমরা ওদের আর ওরা আমাদের কথা বুঝত ... ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴