মানবতার খোঁজে কালিম্পঙের গ্রাহামস হোমে/গৌতম চক্রবর্তী
মানবতার খোঁজে কালিম্পঙের গ্রাহামস হোমে
গৌতম চক্রবর্তী
বাংলার পাহাড়ের এমনিতেই একটা আপন করে নেওয়ার আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। গত কয়েকদিনের ঝড়বৃষ্টির পালা কাটিয়ে উঠে রোদ ঝলমলে কালিম্পং যেন নতুন রূপে আবির্ভূতা। দার্জিলিং এর মতো এখানেও ঘিঞ্জি ভাবটা পুরোমাত্রায় জাঁকিয়ে বসেছে। স্কটিশ মিশনারিদের হাতে গড়া শৈলাবাস কালিম্পং এখন ব্যস্ত জনপদ। আর এখন তো আলাদা জেলা। উচ্চতা দার্জিলিঙের চেয়ে অনেকটাই কম। সাড়ে বারোশো মিটারের মতো উঁচু।
গত কয়েক বছরে অজস্র গাছ আর যত্রতত্র পাহাড় কেটে হোটেল বানানোর চক্করে আজকাল কালিম্পঙে গরমটা মাত্রাছাড়া। এখন কালিম্পঙে শীতেও আর তেমন ঠাণ্ডা পড়ে না। কালিম্পঙে যখন রবীন্দ্রনাথ ছিল তখন শরতের আভাস আসতে না আসতেই উত্তুরে হাওয়া ঢুকে পড়ত জানলা দিয়ে। আট দশকে এই পরিবর্তনটা একটু বেশিই চোখে পড়ল । অবশ্য এই অতি-বদলের বেশিরভাগটা হয়েছে গত দু’দশকেই বলতে গেলে। একসময় পাখার দরকারই পড়ত না, আর এখন নাকি গরমের সময় পাখা ছাড়া থাকাই যায় না।
এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে একটা স্কুলের গেট। ভেতরটা অবশ্য স্কুল বলে মনে হবে না। চারিদিকে সবুজের ছায়াখেলা বাগান। পাখি ডাকছে। অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ।
কালিম্পং-এ ডেলো পাহাড়ে পাঁচশো একর জায়গা জুড়ে রয়েছে ড. গ্রাহামস হোমস। ভেতরটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আলোকিত। এখানে গাছ লাগাতে হয় না, আপনা থেকেই তারা ঘিরে রাখে ক্যাম্পাসকে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি কালিম্পঙে ডক্টর গ্রাহাম’স হোমসের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে। রেভারেন্ড জন অ্যান্ডারসন গ্রাহামের তৈরি স্কুল। চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের এক মিশনারি। ১৮৮৯ সালের ৬ই এপ্রিল এখানে পা রেখেছিলেন তিনি আর তাঁর স্ত্রী ক্যাথারিন। দার্জিলিং থেকে টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছিলেন গ্রাহাম দম্পতি। সেই যে পা রাখলেন হিমালয়ের এই ছোট্ট প্রান্তটিতে, আর কখনও দেশে ফিরলেন না। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে অন্ধ সংস্কার থেকে ‘বাঁচানো’। প্রচ্ছন্ন ঔপনিবেশিক মনোভাব, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি সত্যিই তাঁর মহত্ত্বের পরিচয় রাখে।
সেদিন রবিবার। তাই স্কুল ছুটি। সামনের একটা পুকুরের ধারে কিছু ছাত্র মাছ ধরার আয়োজন করছিল। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল এখানে আলাদা আলাদা ভবন রয়েছে। প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে তারা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। মূল প্রশাসনিক ভবনটি বন্ধ, তাই কিছু তথ্য সংগ্রহের ইচ্ছে থাকলেও সেটিকে সংবরণ করে নিতে হল। তবে পেয়ে গেলাম হোস্টেল তথা স্কুলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে। প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিলেন না। তারপর উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতেই জানালেন, ছাত্রছাত্রীরা বেশির ভাগই উত্তর-পূর্ব ভারতের। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডেরও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী এখানে পড়াশোনা করে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে অনুদান কমতে থাকায় স্কুলের রক্ষণাবেক্ষণ বেহাল হয়ে পড়েছে। স্কুলের দু’টি ভবন বেহাল হয়ে পড়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ আরও সমস্যায় পড়েন পাহাড়ে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ায়। বিদেশ থেকে ছাত্রছাত্রী আসা ক্রমশ কমতে থাকে।
শতাব্দী প্রাচীন গ্রাহামস হোম স্কুল তার হেরিটেজ সংরক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য রয়েছে ১৮টি কটেজ, ৪৫০০ ফুট উঁচুতে বিশাল চত্বর জুড়ে রয়েছে স্কুল কটেজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্ম বিল্ডিং, চ্যারিটি হাসপাতাল, ম্যাকলিয়ড সুইমিং বাথ, রোনাল্ডসে পার্ক, শিশুদের নার্সারি, বেকারি, ওয়ার্কশপ, খেলার মাঠ, মিউজিয়াম। ভবনগুলির বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর অনবদ্য নিদর্শন। আর রয়েছে সুন্দর একটি চ্যাপেল। ‘চ্যাপেলটি ১৯২৫ সালে ধূসর স্লেট পাথরে তৈরি। কে ডি প্রধান রো-এর থেকে ৪ কিমি. উপরে এর অবস্থান। বিভিন্ন ধরনের ফর্মাল ট্রেনিং দেওয়া হত দুই থেকে আঠারো বছরের ইউরোপীয় ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছাত্রছাত্রীদের। আজ সব ধর্ম ও জাতির ছেলেমেয়েরা পড়ার সুযোগ পায়।
প্রথমে গ্রাহামস হোম স্কুলের নাম ছিল সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কলোনিয়াল হোম। পরে ‘ফাদার অব কালিম্পং’, রেভারেন্ড জন অ্যান্ডারসন গ্রাহামের নামে নামকরণ হয়। কালিম্পংয়ের ডেলো পাহাড়ে কয়েক হাজার একর জমির উপরে গড়ে ওঠা স্কুলটি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার অর্থ সাহায্যে চলে। স্কুলটি পঠনপাঠনের গুণে গোটা বিশ্বেই জনপ্রিয়। কালিম্পংয়ের এই স্কুলটি বেসরকারি হলেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর উদ্যোগে চার্চের অধীন স্কুলটির ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। তাঁর নির্দেশে স্কুলের একটি রাস্তাও তৈরি করে দেয় পূর্ত দপ্তর।
গ্রাহামের হোমস তার দীর্ঘ এবং বিশিষ্ট ঐতিহ্যের জন্য গর্বিত। প্রতি বছর অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তারিখ উদযাপন করা হয় হোমে। মে ফেয়ার একটি প্রচলিত কার্নিভাল দিন যেখানে প্রচুর আকর্ষণীয় স্টলে শিক্ষার্থীরা তাদের শিল্প, কারুশিল্প এবং রান্নার ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে এবং স্কুল ব্যান্ডের মাধ্যমে পারফরম্যান্স করতে পারে। মেলায় প্রধান অতিথি থাকেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সম্মানীয় ব্যক্তি। সমস্ত বাবা-মা এবং বাচ্চাদের উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বছরের এই সময়টিতে বার্ষিক পুষ্প প্রদর্শনীও হয়। দ্বিতীয় ইভেন্টটি ১৯০০ সালে বিদ্যালয়ের ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত বার্ষিক জন্মদিন উদযাপন। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এই উদযাপনটিতে বাবা-মা, প্রাক্তন ছাত্র, বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা মিলিত হন। এছাড়াও, বছর জুড়ে ডঃ গ্রাহামের হোমস স্থানীয় স্কুলগুলি দ্বারা যৌথভাবে আয়োজিত ক্রীড়া ইভেন্টগুলির একটি বিস্তৃত ক্যালেন্ডারে অংশ নেয়।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শব্দটা শুনতে যতটা রাশভারী মনে হচ্ছে, আদপেই তা নয়। বরং এইসব বাচ্চাদের জন্মের ইতিবৃত্তটাই বড় করুণ। স্থানীয় লেপচা, নেপালি, ভুটিয়া, অবিবাহিতা মহিলারা ব্রিটিশ প্রভুদের ভোগ লালসা পরিতৃপ্তির শিকার হতেন। সেই অন্ধকারের ফল হিসাবে পৃথিবীর মুখ দেখত হতভাগ্য এই শিশুরা। বলাইবাহুল্য, তাদের জন্মের পর তাদের কোনোরকম দায়িত্বই পালন করতে চাইত না সাহেবরা। ‘অবৈধ’ তকমার অন্ধকার থেকে তাদের মুক্তির আলোয় আনার জন্যেই জনের এই মহৎ উদ্যোগ।
শৈলশহরের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক চার্চ অব স্কটল্যান্ডের জেনারেল অ্যাসেম্বলির নির্বাচিত মডারেটর ড. গ্রাহামসের কালিম্পঙে আগমন ঘটে মিশনারি কাজকর্ম করার সুবাদে। দার্জিলিঙ ও ডুয়ার্সের চা-বাগানে কর্মরত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শ্রমিক পরিবারের অবহেলিত শিশুদের লালনপালন ও শিক্ষাদানের জন্য তিনি গড়ে তুললেন এই প্রতিষ্ঠান ১৯০০ সালে। ছ’জন অনাথ শিশুকে নিয়ে যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, সেই সংখ্যা আজ দেড় হাজার ছুঁয়েছে। মূলত স্থানীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাচ্চাদের জন্যেই স্কুলটা তৈরি করেছিলেন জন।
১৯০০ সালে স্কটল্যান্ডের ধর্মপ্রচারক ডাঃ জন অ্যান্ডারসন গ্রাহাম স্থাপন করেন গ্রাহামস হোম নামে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা শিশুদের যত্ন নিচ্ছে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। কালিম্পংয়ের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে দরিদ্র ও অভাবী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিশুদের আশ্রয় হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই স্কুল। কালিম্পঙে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ একদিন তাঁর স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেন্ট অ্যানড্রুজ কলোনিয়াল হোমসে তখন ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাতশো। স্কুলের পরিবেশ, পঠন-পাঠনের ধরনে নিজের ভাবনাকে খুঁজে পেতে দেখে খুশি হয়েছিলেন কবি। গ্রাহামের আশ্রমে বসেও বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেন।
বেরোবার সময় স্থাপনকালটা দেখলাম। ১৯০০। ২৪শে সেপ্টেম্বর। কির্নেন্ডার কটেজ ভাড়া নিয়ে মাত্র ছ’জন ছাত্র। যাদের মধ্যে দুজন ছিল ওই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের। তাদের নিয়ে সেন্ট অ্যানড্রুজ কলোনিয়াল হোম নামে শুরু হয়েছিল পথচলা। সালটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার মনে হল, ঠিক এর পরের বছরই শান্তিনিকেতনের আশ্রমচত্বরে কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটা কো-এডুকেশনাল স্কুল খুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একই সময়ে যাত্রা শুরু করা দুটি শিক্ষাঙ্গন, ভাবনাতেও কত মিল। অথচ দুই শিক্ষাবিদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ শেষ জীবনে এসে।
তথ্যসূত্র
১) মলয় হোড়রায় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক - কালিম্পং কলেজ
২) আনন্দবাজার পত্রিকা - পেপার কাটিং
৩) ব্লগ- দুনিয়াদারি ডট কম
৪) রেক্টর রেভারেন্ড মার্টিন - গ্রাহামস হোম
৫) সাক্ষাৎকার - গনেশ ছেত্রী, রমন মিন্জ প্রমুখ
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴