মহীরুহ/অর্ণব ঘোষ
মহীরুহ
অর্ণব ঘোষ
ঠাকুমার মুখ থেকে শোনা - দ্বিতীয়বারে বাবা নাকি মেয়ে আশা করেছিলেন। একে তো পুত্রসন্তান, তাও আবার গায়ের রঙ চাপা! এই অনাকাঙ্খার আঁতুড়ঘরে জন্মেছিলাম আমি। শৈশব থেকেই প্রচেষ্টা ছিল ভালো হবার, ভালো কিছু করার, বাবার কাছে প্রিয় হবার। সেবার ক্লাস সিক্সে পড়ি, বাবা বলেছিল ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হতে পারলে পেট ভরে মিস্টি খাওয়াবে। ছয় নম্বরের জন্য প্রথম হতে পারিনি, দ্বিতীয় হয়েছিলাম। বাবা তারপর এনেছিল। সেই বয়সে টপাটপ মুখে পুরেছিলাম এগারোখানা লেডিকেনি।
কথায় বলে বাবাকে চিনতে নাকি প্রায় সারাজীবন লেগে যায়। একটু একটু করে চেনার চেষ্টা করেছিলাম। আত্মাসম্মানী, জেদি, রাগী লোকটার ভেতরটা ছিল আসলে কচি নারকেল শাঁসের মতো। সহকর্মীদের সাথে যতটা হাসিখুশি, সাবলীল, বাড়িতে ততটাই কঠোর অনুশাসন। এই অনুশাসনেই হয়তো আমরা কেউ বিপথগামী হইনি। আর ছিলেন স্পষ্টবাদী ও নির্লোভ। কত অল্পেই একটা মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারে তা বাবাকে দেখেই শেখা। মা বলে বিয়ের সময় বাবার নাকি স্রেফ দুখানা আকাশী রঙের জামা আর দুখানা প্ন্যান্ট ছিল। তবু জীবন সম্পর্কে, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো আক্ষেপ বা অভিযোগ কোনোদিনই ছিল না।
খেলাধুলায় যেমন পারদর্শী ছিলেন তেমনি স্কুলের হিসেবনিকেশ কাগজপত্রও ছিল নিখুঁত। স্কুলের বাচ্চারা হেডস্যারকে যেমন সমীহ করত তেমনি ভালোওবাসত। তোষামোদ করা পছন্দ করতেন না একদম। মন্ত্রী বন্ধু থাকতেও কখনো বড় ছেলের চাকরীর জন্যে তদবির করতে দেখিনি। মাকে বরং সান্ত্বনা দিতেন- তোমার তো এক ছেলে তবু চাকরী করে, কারোর যে কোনো ছেলেই পায়নি।
মধ্যবিত্ত সংসারে বাবার মিতব্যয়ী স্বভাবকে অনেকে কটাক্ষ করত, কৃপণ আখ্যা দিত। আমরা যদিও কোনোদিন কোনোকিছুর তেমন অভাববোধ করিনি। সুন্দর হাতের লেখায় ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতেন সংসারের প্রতিটা হিসেব। মায়ের প্রতি ছিলেন কেয়ারিং, ঠাকুমার প্রতি সশ্রদ্ধ। কোনোদিন ঠাকুমার মুখের ওপর কিছু বলতে শুনিনি কিংবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। মেধাবী ছিলেন বটে তবে কিছুটা আয়েশী ছিলেন। পরপর দুটো সরকারী চাকরী ছেড়ে অবশেষে স্কুল মাস্টারী বেছে নিয়েছিলেন।
খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন বাবা। ধৈর্য্য আর সহনশক্তিও ছিল অশেষ। শত আঘাতেও ভেঙে পড়তেন না। আনন্দে যেমন উৎফুল্ল হতেন না, বিষাদে বা বিপদেও তেমনি বিচলিত হতেন না। এমনই এক মহীরুহের ছায়াতলে বড় হয়েছিলাম আমরা।
আজও বাসে, ট্রেনে যেতে যেতে মিস করি বাবার ফোন কল, আড্ডা দিয়ে দেরী করে ফিরলে মিস করি তার ধমক, জীবনের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে মিস করি তার পরামর্শ।
বারোটা বছর পেরিয়ে গেছে বাবা প্রয়াত হয়েছেন। শেষ শয্যায় বলে গিয়েছিলেন সকলকে দেখে রাখতে। এতটা বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলাম, এতটা দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে পরলোকে পাড়ি দিতে পেরেছিলেন - এটাই আমার পরম প্রাপ্তি!
আজও প্রায় মাঝেমধ্যেই, কখনও বা পরপর কয়েকটা রাতে বাবার সান্নিধ্য পাই, পরামর্শ করি, নির্দেশ পাই। কাকতালীয়ভাবে সেইসব নির্দেশনা মেনে সাফল্যও আসে। যেন মনে হয় তিনি আজও বেঁচে আছেন, আমাদের আশেপাশেই আছেন আর সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন আড়াল থেকে। আমার স্বপ্নে যেন তাঁর অবাধ বিচরণ, আমার অনুভবে তাঁর অমরত্ব!
মহীরুহরা আসলে মারা যায় না, তার শক্তি, তার ত্যাগ, তার আদর্শ সঞ্চারিত করে রেখে যায় অপর কোনো বৃক্ষে যাতে আগামীতে সেও মহীরুহসম হয়ে উঠতে পারে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴