মমতা পাল চন্দ -এর আলোচনায় অমিত কুমার দে -এর বই 'রাজেশ্বরী তুমি'
Lord Macaulay একসময় বলেছিলেন সভ্যতার প্রসারের সঙ্গে নাকি সংস্কৃতির সঙ্কোচন ঘটে। অথচ সাহিত্য সংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় কাব্যলক্ষ্মী কিম্বা দেবী সরস্বতী কিন্তু ঠিক কিছু মানুষের মনোবীণার তারে নিরন্তর এক সুর ঝংকার ধ্বনিত করে চলেন। তাই প্রকৃতির উদার সান্নিধ্যে আর নিবিড় ভালোবাসায় বেড়ে উঠা মানুষের ভেতরে প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ নাড়ীর টান তৈরি হয়। তবে সে ভালোবাসার অস্ফুট অভিব্যক্তি বা নাড়ীর টানকে ভাষার ভাস্কর্যে বাগ্মময় করে তোলা সবার দ্বারা সম্ভব না হলেও কিছু মানুষের মনোভূমিতে যে ফুল নিত্য ফুটে চলে তা দিয়ে কাব্য কবিতার বাগিচা সাজিয়ে যারা জীবনের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে নিবিড় চিত্তে নিমগ্ন থাকেন তাদেরই একজন উত্তরবঙ্গের প্রাণের মানুষ - সাহিত্যসাধক কবি অমিত কুমার দে। যিনি তাঁর জীবনের দোতারায় উত্তরবঙ্গের নির্বিরোধী নীরব অভিমানী বিচরণভূমি আর বনজঙ্গলের ভিতরে প্রবাহিত শীতল জলস্রোতের অনাবিল সৌন্দর্য্যকে খুঁজে খুঁজে তার নৈবেদ্যর ডালি সাজিয়ে তোলেন যা দেখে মনে হয় যেন জীবনের ফেরিঘাটে এক দক্ষ সাঁতারু পায়ে পায়ে অজস্র জলজ শেকল দিয়ে ওই বৃষ্টির টুংটাং আনন্দ শব্দ শোনা পাঠককুলকে ক্রমান্বয়ে বেঁধে চলেছেন এক অদ্ভুত সাংস্কৃতিক কাব্যিক সম্মোহনে। কবি পাঠকের প্রচন্ড কুঁড়েমীর কুয়াশায় জড়িয়ে দিচ্ছেন এক ভালোবাসার উষ্ণ আলোয়ান। তাঁর অনুরোধ "রাজেশ্বরী কুয়াশার গায়ে ভালোবাসা লেখো/ আমি কুয়াশা হয়ে মিশে আছি কুয়াশার ভিড়ে।" আবার কোথাও প্রেম পিয়াসী কবি তাঁর সোহাগী 'রাজেশ্বরী'কে বলেন "তোমার বৃন্ত ছুঁয়ে আমি হব শীতের বাতাস।" কবির ভালোবাসার উঠোনে প্রচন্ড শীতেও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামে আর তার উপত্যকায় ফুটে উঠে কত নাম না জানা ফুল। আর সেই সব ফুলের পাপড়ি কুড়িয়ে উত্তরের সাহিত্য সংস্কৃতির বিবর্ণ শৈশব যেন কবিরই লালনে - জারণে ভেসে চলেছে কাব্যলক্ষ্মীর আনন্দ মেলায় - দূরে - আরও দূরে - গন্তব্য যার জ্বালাহীন দুধসাদা রডলাইটের মতো নির্ভেজাল সমুদ্র সফেন কিম্বা খোলা আকাশের নিচে দীপ্তি ছড়ানো সন্ধ্যাতারা। আর সে যাত্রা পথের নেপথ্য সঙ্গীতে নিরন্তর বেজে চলে ডুয়ার্সের জীবন প্রবাহের সহজিয়া প্রাণের সুর - বাতাসে ভাসে মাটির সোঁদা গন্ধ। অনুভবি কবির মনে আনন্দ লহরী "আমার প্রাণে বেজে উঠল কাল - অতিক্রমী লহরা/তুমি কি না নেচে থাকতে পারবে রাজেশ্বরী ?" আর তাঁর পরাণ প্রেয়সী 'রাজেশ্বরী' উত্তরের জীবন সুন্দরের বন্দনায় এক অপূর্ব নৃত্য বিভঙ্গে জোড়হাতে নত মস্তকে অনায়াসে যেন গেয়ে ওঠে "অঞ্জলী লহ মোর সঙ্গীতে ......, প্রদীপ শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম তোমারে সুন্দর বন্দিতে"। আর তাঁর স্বর্গীয় হাতের আঙ্গুল বেয়ে যেন অঞ্জলীর অর্ঘ্য ঝরে পড়ে অর্কিড বেলি গন্ধরাজ দোলনচাঁপা গোলাপ আর রজনীগন্ধার স্নিগ্ধ পুষ্পধারা হয়ে। কবি তাঁর সাহিত্য সাধনার জীবনপথে ক্যাকটাস বনসাইকেও যেন স্বযত্নে লালন করে ফুটিয়ে তোলেন মনোহারী ফুলের সম্ভারে। বিপর্যস্ত হয়েও কবির আনুগত্য "ওসব পোশাকি সুখ বেমানান আমার ভূগোলে/ তোমাকে উড়িয়ে দিয়ে আমি হাঁটি শুনসান বিপর্যস্ত দিনে/ তবু এক অলক্ষ্য সুতোয় তুমি বেঁধে রাখো মৃত্যুর ঋণে।' আমি কবির সৃষ্টি কালজয়ী রাজেশ্বরী সিরিজের বহু কবিতা পড়েছি - পড়েছি প্রশান্ত রায়ের প্রচ্ছদে আর বিস্তার মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড পাবলিকেশনের প্রকাশনায় 'রাজেশ্বরী তুমি' কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাগুলি। যেখানে কবি হয়ে উঠেছেন এক আদ্যন্ত আভূমি প্রকৃতি প্রেমিক। ডুয়ার্স রানীর এক আত্মজার যেন উত্তরবঙ্গকে ভালোবেসে তার বাঁধনহারা মনের ভাষা সুরে গানে কবিতার অজস্র ধারায় ঝরে পড়েছে এই নীল মলাটের ভেতর। কবি অমিত দে-র এই শত কবিতার সংকলন সত্যি কৃত্রিমতাহীন বহুমুখী প্রতিভারই সাক্ষর। কবির ভাষায় "একটা সীমানা বিহীন প্রান্তর / যার কোথাও কোনো কাঁটাতার নেই/ তাকেই আমি রাজেশ্বরী বলে ডাকি।" তার আবদার "আমি তোমার পায়ের পাতায় আলতা পরাব আজ রাজেশ্বরী, আমার জন্য আজ তপস্বিনী হও.…..... তোমার পুজোয় বসে নিজেকেই আনন্দে পোড়াই।" আসলে এখানে কবির মনের ভাব আর ভাষার মনি কাঞ্চনযোগ - সৌন্দর্য্যসুধা- আত্মসমীক্ষা - আত্মসত্তা - সমর্পণ আর আত্মনিবেদনের অমূল্য উপলব্ধি আর জীবনবোধের হীরে মানিক ঠিকরে বেড়িয়েছে এই 'রাজেশ্বরী তুমি' নামক কবিতা গুচ্ছের ছত্রে ছত্রে। আর সেখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন এক অন্যমাত্রার সাহিত্যসাধক - সত্যিকারের সংস্কৃতির প্রসারক - ধারক বাহক - এক নিঃসীম প্রকৃতি প্রেমিক - মানবতার পূজারী।
প্রায়শই কবি তার রাজেশ্বরী সিরিজের তিন শতাধিক কবিতার ডালিতে উত্তরের সমতল আর পাহাড়ি নদী ঝরনাকে যেন বিনিসুতোর রজ্জুতে বাঁধছেন আবার কোথাও নদীর প্রবল জলস্রোতকে পরিণত করছেন স্নেহময়ী স্রোততরঙ্গে। নদী হয়ে উঠছে কবির স্নেহময়ী স্তন্য দাত্রী জননী। রাজেশ্বরী আসলে কবির কথায় "জল দিয়ে কীভাবে লিখতে হয় মহাকাব্য / জানে বলেই সে আমার পদ্মপাতা/ আমি তার শিশির হই।" আসলে কবি রাজেশ্বরীকে নিয়ে এক পৃথিবী লিখতে চেয়েছেন - তোমাকে লিখে রাখছি রাজেশ্বরী /......তোমাকেই লিখব বলে নীল কালী/ মহাসাগরীয় জলে....../আমি এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান লিখি - রাজেশ্বরী, আমার বসুন্ধরা, পৃথিবী আমার তোমাকেই লিখে রাখছি/ লক্ষ কোটি আদিম গুহায়।"
আবার কোথাও তাঁর জীবন সাধিকা মানস প্রতিমা রাজেশ্বরীকে কবি হাহাকার করে বলেন "আমার আর কিছুই করার থাকে না রাজেশ্বরী/ তোমার বিহনে আমি চুরমার বসন্ত বাউল।" আবার কখনও ডুয়ার্সের নদীর সাথে গোপন বিপ্রতীপে গায়ে জ্যোৎস্না মাখেন কবি ছাতিম ফুলের সুগন্ধির মতো দুজনের শরীরে।
আবার কোথাও কবির নিত্য যাপনের নীল অভিমান ফুটে উঠেছে রাজেশ্বরীর প্রতি। ক্লান্ত কবি অক্লেশে বিষণ্ণ শ্মশানে বসে থাকেন তার প্রেয়সী রাজেশ্বরীকে দাহ করবেন বলে। এ দাহ যে সে দাহ নয়। এ দাহ - এ দহন যেন পতিত পাবনী পবিত্র নদীর জলে ধুয়ে চন্দন মাখিয়ে পবিত্র তুলসীর পাতায় দু'চোখ ঢেকে ফুল মধু জলে অনির্বাণ অগ্নিতে নিজেকে পবিত্র করে এক অবোধ শিশুর তার আরাধ্যাকে নিয়ে চির অভিমানী আত্মসমর্পণ।
রাজেশ্বরী আসলে কবির বিনাশর্তের অধিগ্রহণ - এক অধিকারবোধ। তাই রাজেশ্বরীকে তিনি নিজের কাছে আগলে নিজের করে রাখতে চেয়েছেন। রাজেশ্বরীকে বলেছেন : জহিন মানুষদের সমঝে চলো রাজেশ্বরী" তাঁর রাজেশ্বরীর অন্যমনস্ক হওয়াও মানা। রাজেশ্বরীকে স্বার্থপরের মতো বাইরের গেটে তালা দিতে বলেছেন। কবি চেয়েছেন জল পিঁড়ি পাতা থাক শুধু তারই নামে। এই হল কবির দুরন্ত আবদার - একান্ত চাওয়া। রাজেশ্বরী যেন কবির কাছে কখনও প্রেয়সী কখনও কন্যা, দেবী মাতৃকারই এক এক রূপ। আর কবি যেন হয়ে ওঠেন চির পিপাসার্ত এক বৌদ্ধ ভিক্ষু : দ্বিধাহীন আবদারে কবি বলে ওঠেন :
তুমি মন্ত্রোচ্চারণ করলে আমার দিনটি সুন্দর হয় রাজেশ্বরী ......সলতে পোড়ার ঘ্রাণ আমার কলমকে ছুঁয়ে যায় - আমি ক্রমাগত পরিশুদ্ধ হই - তখন শব্দেরা সব স্নান করে আসে।
প্রতিটি বাক্যের ঠোঁটে যেন এক পূজারীর হাসি। কবিও পবিত্র পরিশুদ্ধ বাক্যের ডালি সাজিয়ে তার পুজো সমর্পণ করেন।
কবির ডুয়ার্স বন্দনার পরিবর্তিত সব শৈল্পিক বাঁকে বনজঙ্গল ডুয়ার্সের মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকতেই চেয়েছেন কবি"। তার নাছোড় মন বলে উঠে: "যাই বললেই কি যাওয়া যায় রাজেশ্বরী"? / যাই বলে ফিরে আসি পুনরায় তোমার বুকেই।" মাধুকরী গানে কবি লেখেন "আর কত বসে থাকি জটিলের পাশে? আমার প্রশাখাগুলো অভ্যন্তরে নিস্তেজ হয়/ আমার পত্ররাজি গেয়ে ওঠে মাধুকরী গান/ তোমাকে স্পর্শ করে হোক আজ আত্মশুদ্ধস্নান।" কবি অমিত দে-র সাহিত্য স্থাপত্যের সপ্ত প্রদীপের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ যদি হয় তাঁর আত্মনিবেদন - এক পরিব্রাজক বিশ্বপথিকের সমর্পণ তাহলে অন্যগুলো হল তাঁর বিনম্রতা - আত্মানুভূতি - সৌন্দর্য্যপ্রিয়তা - আত্মোপলব্ধি - সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা - আত্মশক্তি এবং জীবন সম্পর্কে বিশ্বজনীন প্রজ্ঞা এবং আর্ট সম্পর্কে সুনিপুণ পরিচর্যা। জীবনের এমন শিল্প গড়া - যে শিল্প মানুষের মনে প্রশান্তি দিতে পারে - মানুষের চিন্তা চেতনায় জন্ম দিতে পারে এক মানবিক মূল্যবোধের। তাঁর জীবন সুধারসের মাধুকরী মদিরাহীন - গরলতা বিহীন। তাই তিনি প্রকৃতির বুকে নিজের সত্তা খুঁজে পাওয়া এক বটবৃক্ষ।
যে বোধীবৃক্ষের নিচে সব অমানবিক আগাছা নিমেষে বস্তুলীন হয়ে যায়। তাই তাঁর সৃষ্টি রাজেশ্বরী বাংলা সাহিত্য জগতে চির অক্ষয় অমলিন সম্পদ হয়ে থাকবে যুগ যুগান্তর ধরে। কবির রাজেশ্বরী সিরিজের কবিতা সমগ্র আবেগের তীব্রতা আর ভাষার প্রাঞ্জলতায় এক সাধন মার্গীয় সঙ্গীতসম। যদিও কবিতার ক্রম পর্যায় আরও গোছানো হতে পারত। তবে ওই নারী প্রতিভূ রাজেশ্বরীর প্রতি যখন যেমন মনের টান প্রাণের স্পর্শ আদরে সোহাগে প্রেম ভক্তিতে স্বতস্ফূর্ত মাধুরী অজস্র ধারায় গীতিময় হয়ে উঠেছে। এ যেন মনকে পরিতৃপ্ত করা এক আত্ম চরিতের চিত্রশালা যেখানে অশুচি ভাষার স্পর্শ নেই - জাতপাতের ভেদাভেদ নেই "- উপমার বাড়বাড়ন্ত - অসামঞ্জস্যতা নেই। আছে শব্দ আর বাক্যের গাঁথুনি। আছে দক্ষ হাতে চিত্রকল্প আর উপমার নিটোল শীতলপাটির মতো বুনোট। সত্যিকারের ভালোবাসার সাবলীল ছবির লিখন আর চিত্রণ। সত্যদ্রষ্টা কবির আবেদন : মিথ্যে নয় রাজেশ্বরী, মিথ্যেদের বড় ভয় পাই / যাই হোক যেটা হোক শুদ্ধ হাতে সত্যকেই বুনো।' বৌদ্ধীয় দর্শনে আত্মজ্ঞান - নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান সমৃদ্ধ আত্ম সমর্পণের আর্তি - সাহিত্য সুষমা। কবি অমিত দে যখন জীবনের প্রতি সরল বিশ্বাস আর অধ্যাত্মবাদ নিয়ে তাঁর আনন্দী কবিতায় বৈদিক সুক্তের মতো নির্দ্বিধায় বলে ওঠেন : সমস্ত রোদের ঠোঁটে লেগে আছে বৈদিক রঙ/......সকালে পরেছ তুমি কী দারুন সন্ন্যাসিনী শাড়ি!/ আমি -- শুধুমাত্র আমি, একমাত্র আমিই তোমাকে দিতে পারি/ আনন্দ - আকাশ আঁকা প্রদীপের গন্ধ মাখা শুদ্ধ অশ্রুবারি "।
কবি অমিত দে-র রচনার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হল তাঁর নিরলঙ্কার নিরাভরণ সহজ সরল ভাষা অথচ চিন্তা চেতনার কি অপরিসীম গভীরতা! রাজেশ্বরী কবির কাছে কখনও রাজকন্যা কখনও দেবী : বলছেন বিগত শোকের কাছে ফিরিও না ওই দেবী মুখ/ তোমার পায়ের পাতায় পুজো লেখা থাক"।রাজেশ্বরী তাই এক কালোত্তীর্ণ কাব্যগ্রন্থ।
তাঁর রাজেশ্বরী সিরিজ নিয়ে যত গবেষণা অন্তরতদন্ত - মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে অদূর ভবিষ্যত জীবনে এই সিরিজ কিন্তু প্রেম পিয়াসী কবির আনন্দ শিহরণই নয় - হয়ে উঠবে এক জীবন নির্বেদে মহৎ আত্মোৎসর্গের সাধন মার্গীয় ঐতিহ্যের ধারক। গীতবিতান কবিতায় কবি লেখেন "যেভাবেই প্রতিদিন তোমাকে পাঠ করি রাজেশ্বরী / পুজো প্রেম মিলে মিশে হও একাকার"।কারণ তাঁর প্রেয়সী রাজেশ্বরী আসলে তাঁর জীবনদেবী - তাঁর প্রেয়সী - তার ভালোবাসার ডুয়ার্স - উত্তরবাংলার খাঁটি মৃত্তিকা। যাকে তিনি বিমূর্ত করে তুলেছেন মাতৃরূপে - নদীরূপে - সর্ব সৃষ্টির আদি অন্তহীন শক্তি - সর্ব পাপ হারিণী দেবী রূপে। তারই পায়ে তাঁর নৈবেদ্য - আত্ম নিবেদন। কবি কখনও escapist নন - ডুয়ার্সের প্রকৃতির সৌন্দর্য্য পিয়াস তাঁকে চুম্বকের মতো সর্বত্র ছেয়ে থাকে। তাই ডুয়ার্স থেকে দূরে গেলেও কবি ডুয়ার্সকেই অবলোকন করেন। কলকাতা গিয়েও রাজেশ্বরীর ল্যান্ডস্কেপ তাই কবির ভাষাতেই "রাজেশ্বরী তোমার ঘ্রাণ মিশে যাক শহুরে বাতাসে/ এতকাল রেখে গেছি নদী বন ঝোরা আর বাগিচার ঘাসে/ চোখ বন্ধ করে থাকুক ব্যস্ত নগরী/ রাজেশ্বরীর ঠোঁটে আজ আমি মহাকাব্য পড়ি" আবার "আমি ফিরছি রাজেশ্বরী" বলে আকুল হয়ে উঠেন কবি শেকড়ের টানে । আবার তার রাজেশ্বরীকে নিয়ে কখনও পাখি হয়ে যেতে চান কবি। যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে ঘুমোতে যাবার আগেও তাঁর আদুরে গ্রাম কলাপাতা মাথায় দিয়ে এসে কবিকে বলে "আজ সারারাত বৃষ্টি হবে / কবি উৎকর্ণ হয়ে শোনেন যেন "পিচ রাস্তায় বেজে চলল মেঘের নূপুর" কবি রাজেশ্বরীকে গুছিয়ে রাখেন যেমন করে "কষ্ট গোছায় রাত্রিগুলো..."। তাই কবির কাছে রাজেশ্বরী শালুকপুকুর, শরৎ ঋতুর দিন, কিশোর বাতাস শিউলিতালুক, কী নয়? কবি তাই অঙ্গীকারবদ্ধ "লক্ষ কাঠা শিউলি তালুক কিনে ডুয়ার্সের মাটির কাছেই ফিরতে চান"। রাজেশ্বরীর কাছে তাই কবির আবেদন পুজো শেষ হয়ে গেলেও / অনন্ত সুতো নিয়ে অপেক্ষা করো, রাজেশ্বরী"। মানব সন্তানের রক্তের ভেতর এমন করে প্রবাহিত ভালোবাসা জারিত রস - প্রাণে মিশে আছে মাটির টান- ডুয়ার্সকে তাই কবি তাঁর জীবনের পূজার বেদী আর দেবভূমি হিসাবেই তো প্রণাম জানিয়েছেন। যে কবি কখনও ফুল ছেঁড়েন না তিনি 'স্থলপদ্ম' কবিতায় রাজেশ্বরীর উদ্দেশ্যে বলেন "এই দেখো আমি ফুল ছিঁড়লাম / তোমার পদ্ম পায়ের জন্য/গাছ আমায় ছাড়পত্র দিয়েছে বলে তোমাকে পুজো করে আজ আমি ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছলাম।" এখানেই আসলে কবির মানবত্ব থেকে দেবত্বে উত্তরণ ঘটে যায়। আসলে আদর্শের জন্য সারাজীবন উৎসর্গ করা এ শিক্ষক কবি - সাহিত্য সেবক আলোকবর্তিকা হাতে দেখিয়ে চলেছেন - নিজেকে কীভাবে দেবতুল্য করে তুলতে হয়- কীভাবে আলোর কাছে রেখে যেতে হয় নিজের ঠিকানা আর তার পথনির্দেশ। ডুয়ার্সের বুকে বেঁচে থাকতে চাওয়া কবি 'তোমার সন্তান' এ রাজেশ্বরীর উদ্দেশ্যে লেখেন "সমস্ত পূর্ণিমা এসে বসে আছে পায়ের পাতায় / তোমার পায়ের ছাপ ফুটে উঠে আমার খাতায় - তোমাকে প্রণাম করে আমি হই তোমার বালক .../ গত জন্মে প্রেমিক ছিলাম ব'লে/ আজ রাতে তোমার সন্তান।" 'মা' কবিতায় কবির আদুরে আবদার "আমার মা হও রাজেশ্বরী/ শরীরে ছড়িয়ে দাও ঈশ্বরের আলো / দেবতুল্য অন্ধকারে উদ্বেগ ছাপিয়ে বলো: ঘুমো।" আবার যখন কবি বলেন "স্বর্ণবর্ণা হও মেয়ে/ যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে তাকে আগুনে পোড়াও/ বসন্ত পতাকা বুনে অনন্তের উঠোনে ওরাও...."। এখানেই মুহূর্তের বোঁটায় যেন অনন্ত প্রস্ফুটিত করে রাখলেন কবি। অনন্য সৃষ্টি হিসাবে রজেশ্বরীর নাম সোনার আখরে জ্বল জ্বল করবে বাংলা সাহিত্যের কালের কপোল তলে। আর এই ডুয়ার্স সন্তান বহু পথ ঘুরে 'শিকড়' এ ফেরেন এই বলে "ফিরে এসো রাজেশ্বরী/ নতুন জ্যোতিষ্ক দিয়ে সাজিয়েছি জ্যোতির্বলয় / অরণ্যে পুঁতেছি আজ স্বর্গের গাছ/..... শিকড়ে ছিলাম আমি - শিকড়কে ছুঁয়ে যেন রই। কবির এই দেবভূমি - পূজার বেদী নানারূপে ডুয়ার্স প্রেম আর ভক্তির 'রাজেশ্বরী' তাঁকে আভূষিত করুক উত্তরের মাটির কবি হিসাবে। আর উত্তরের সাহিত্য সাধনার যে প্রসার তিনি ঘটিয়ে চলেছেন তা বন্দিত হোক বিশ্ব বীণার তারে তারে আর তাঁর কাব্য তরঙ্গের বাঁকে বাঁকে।