মনের ঘরে প্রাণের মানুষল/উমা দত্ত
মনের ঘরে প্রাণের মানুষ
উমা দত্ত
তখন আমার বয়স কতই বা হবে আমি তখন সবে ক্লাস ফাইভের ছাত্রী।
আমাদের রেল কোয়ার্টারের তিন কামরা ঘরের একটিতে যেখানে বসে লেখাপড়া করতাম সেই ঘরে পড়ার টেবিলের ঠিক ওপরের দেয়ালে রবি ঠাকুরের পরিণত বয়সের মালা শোভিত লম্বা আলখাল্লা পরিহিত বেশ বড় একখানা ছবি টাঙানো থাকতে দেখেছি, পড়তে বসলেই ওই ছবির দিকে অজান্তেই আমার চোখ চলে যেত তাঁর সম্মন্ধে জানবার আগ্রহে মনে প্রশ্নের পাহাড় জমে যেত। সুযোগ পেলেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম দিব্যকান্তি মানুষটির ছবির দিকে।
সেই সময়ের অপরিণত শিশুমনে ছবির মানুষটি সম্বন্ধে কৌতূহল এবং হাজারো প্রশ্ন আমার মনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত আর তার যথাযথ উত্তর জানবার বাবাই ছিল আমার একমাত্র মুশকিল আসান ।
যত আবদার যত বায়না যত প্রশ্ন সব কিছুই ছিল বাবার কাছে । প্রায় দিনই বাবার কাছে বসে ছবির শশ্রূগুম্ফধারী দিব্যকান্তি জোর্তিম্ময় মানুষটি সম্মন্ধে খুঁটিনাটি জানবার জন্য উতলা হয়ে থাকতাম এবং সেই বয়সে এতটুকুই বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনি আমাদের অহংকার তিনি আমাদের গর্ব।
সেই বছরই আমাদের কো- এড স্কুলে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন রাবীন্দ্রিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রবীন্দ্র বিষয় ভিত্তিক স্বরচিত কবিতা লিখন প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হয় পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একটি বিভাগই ধার্য হয়।
আমার স্মৃতির পাতায় আজও সেই আনন্দঘন মুহূর্তটি উজ্বল হয়ে আছে , সকল প্রতিযোগিদের মধ্য থেকে আমি সেদিন দ্বিতীয় হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম ।
একরত্তি বয়সের ক্লাস ফাইভে পড়া ছোট্ট মেয়েটির কবি গুরুর প্রতি অপার শ্রদ্ধা যুক্ত কাঁচা হাতের সেই প্রথম লেখা কবিতাটির প্রথম লাইনটি আজও মনে আছে ....
"বিশ্বের কবি ভারতের রবি আজি এসেছে দুয়ারে পঁচিশে বৈশাখ "
তারপর থেকে একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে বাবার কাছ থেকে রবি ঠাকুর সম্মন্ধে জানবার আগ্ৰহ যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল । তাঁকে জানতে বুঝতে পড়তে যেন নিত্য অভ্যাসে পরিনত হল আর তখন থেকেই অদ্ভুত অনুভূতি আমার ভেতরের আমি টাকে আচ্ছন্ন করে রাখত । তাঁকে যে পুজো না করে ভালো না বেসে থাকা যায়না। তিনি যে আমার হিয়ার মাঝে নিভৃত আসনে বেশ আয়েস করে জাঁকিয়ে বসে আছেন তাঁকে টলানোর কোনও সাধ্যিই আমার নেই।
শুভ চিন্তা সুস্থ ভাবনার অন্তর উৎসারিত বারি ধারার শুচি স্নানে নিজেকে শুদ্ধ করে বাহ্যিক আড়ম্বরের চোখ ধাঁধানো উপাচার ছাড়াই তাঁরই রচিত সঙ্গীত কবিতা ছড়া গীতি আলেক্ষ্য নাটিকা নৃত্য নাট্য তাঁর চরণে নিবেদনের করেই তাঁকে স্মরণ বরণ ও পূজনের মধ্য দিয়েই যে নির্মল আনন্দ অনুভব করা যায় সেই দিন থেকে এই সারমর্ম আজ পর্যন্ত অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পারছি।
লিখব বলেই যে শুধু মাত্র অক্ষর বিন্যাস তেমন ভাববার কোন অবকাশ নেই। রবীন্দ্রনাথ আমার আবেগ আমার বিবেক আমার বোধোদয় আমার চিত্তের প্রগাঢ় অনুভূতি শান্তির সমিধ সকল বেদনার স্বচ্ছ নির্ঝর।
"তাঁহার আসন খানি পাতা আছে আমার হিয়ার মাঝে"
তাঁর অসামান্য অতুলনীয় সৃষ্টি মণি মাণিক্যের চেয়েও মূল্যবান রচনাসম্ভারে পরিপূর্ণ। তাঁর অকৃপণ দান ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর মানুষের কাছে চির স্মরণীয় চির বরণীয় চির উজ্বল চির ভাস্বর।
তাঁকে আশ্রয় করে অক্ষরের মেল বন্ধনে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তাঁর চরণে নিবেদন করবার চেষ্টা করে চলেছি। আজ যতটুকু অক্ষর চাষ করবার সাহস জোগাড় করতে পেরেছি আক্ষরিক অর্থে তার প্রধান উৎস একমাত্র তিনি। তাঁর নাম উচ্চারণে তাঁকে শ্রবণে অন্তরে অদ্ভুত এক অনুরণনের সৃষ্টি হয় । তিনি আমার আত্মার আত্মীয় প্রাণের ঠাকুর হয়ে হৃদয়ের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে বিলীন হয়ে আছেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴