মনকেমনের খোয়াই/সমাপ্তি চৌধুরী
মনকেমনের খোয়াই
সমাপ্তি চৌধুরী
প্রিয় খোয়াই,
কেমন আছো তুমি? অনেকদিন তোমার খোঁজ নেওয়া হয় নি। কতদিন হয়ে গেল তোমার কোলের কাছে গিয়ে বসা হয় নি। মনে পরে সেইসব দিনের কথা? যখন নিস্তব্ধ দুপুরগুলো তোমার সাথে একান্তে কাটিয়েছি। তোমার ধারে ধারে নীরবে হেঁটেছি। আমার কিশোরীবেলার প্রথম ভাললাগার মুহূর্ত তোমার সাথে যাপন করেছি। মনখারাপের দিনে তোমার আশ্রয় খুঁজেছি। আবার বন্ধুরা মিলে হৈ হৈ করে তোমার ধারে সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছি। সোনাঝুড়ির জঙ্গলে আতিপাতি ঘুরে বেড়িয়েছি।
তোমার ওই অদ্ভুত ভূ-দৃশ্য দেখতাম আর মুগ্ধতায় আপ্লুত হয়ে যেতাম। বিশ্বকবিকে তুমি তোমার ওই অপরূপ সৌন্দর্য দিয়েই মুগ্ধ করেছিলে। বড় বড় শিল্পীরা তাঁদের চিত্রশিল্পে তোমাকে অমর করে রেখে গেছেন। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন---
"রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে
গ্রামের লোক যাবে হাট করতে
পশ্চিমের আকাশপ্রান্তে
আঁকা থাকবে একটি নীলাঞ্জনরেখা। "
----- আজ তোমার হাট বহুল প্রচলিত 'খোয়াইয়ের হাট ' নামে। নানা জায়গার মানুষজন আসেন এখানে। এটি এখন এক বৃহত্তর মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কত মানুষের রুজি রুটি চলে তোমাকে ঘিরে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের বিকিকিনি চলে এখানে। যোগ্য সঙ্গত করে লোকগান। বীরভূমের হস্তশিল্পের বড় নিদর্শন হয়ে উঠেছে তোমার এই হাট। ------
তবে বড্ড ভির, বড় কোলাহল। চারিদিক জুড়ে আধুনিকীকরণের ছোঁয়া। এখন আর তোমাকে একলা করে পাওয়া যায় না। কবিগুরুর সেই শান্ত, স্নিগ্ধ সবুজ মাখা পরিবেশ এখন অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কত মনকেমনের রোদেলা দুপুর, বৃষ্টি ছোঁয়া সোনাঝুরি জঙ্গলের কাঁচা মাটির পথে এলোমেলো হাঁটা, অলস বিকেল গড়িয়ে প্রবল সন্ধ্যা নামা, ঝোড়ো হাওয়ায় সোনাঝুরি গাছেদের সাঁওতাল নাচ দেখা----- কত স্মৃতি তোমাকে ঘিরে।
লালমাটির পথ ধরে প্রিয় মানুষের সাথে হেঁটেছি বহুদূর পথ। কখনও বা বেসুরো গলায় গেয়ে উঠেছি ফাগুনের গান। আমার মেয়েবেলার অনেকটা জুড়ে ছিলে তুমি। সব ভাল লাগা, মন্দ লাগায় তুমিই তো ছিলে পাশে।
আজ ভৌগলিক দূরত্ব বিচারে হয়ত তোমার থেকে অনেকটা দূরে আছি, তবে মনে মনে তোমার কাছে মাঝে মাঝেই পৌঁছে যাই।
এক মজার কথা বলি তোমায়। একবার আমার আত্মজ কে নিয়ে গেলাম শান্তিনিকেতন। ভাবলাম আমার মেয়েবেলার সব প্রিয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখাই। ঘণ্টাঘরের সেই সুদৃশ্যমান ঘণ্টা, গৌরপ্রাঙ্গনের সেই স্টেজ,আমাদের পুরনো ভবন, সেই পরিচিত শিমুলতলা, আমলকী বন, পূর্বপল্লীর মাঠ, অমর্ত্য সেনের বাড়ি, আমাদের ছাত্রীনিবাস(শ্রীসদন, মৃণালিণী)---- এরপর পা বাড়ালাম সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটির উদ্দেশ্যে।আগের মত তো আর সাইকেল নিয়ে যেতে পারব না, অগত্যা টোটোয় চড়ে তোমার কাছে রওনা দিলাম। দুরু দুরু বক্ষে ভাবছিলাম তুমি কী আমায় চিনতে পারবে?আগের মতোই আপন করে নেবে?
কিন্ত কোথায় কী, কিছুদূর যাওয়ার পর বুঝলাম, তোমার কাছে এখন আর সহজে পৌঁছানো যায় না। অনেক ভিড় ঠেলে, যদিও বা পৌঁছালাম, দেখলাম তুমিও আর আগের মতো নেই। সময়ের সাথে সাথে তোমারও পরিবর্তন হয়েছে। ভাবলাম পরিবর্তনশীলতা জগতের নিয়ম। গুরুদেব তো গতিশীল জীবনের কথা বলে গেছেন। সেই গতিতেই আমরা ছুটে চলেছি।
তবে মন যখন বিশ্রাম চায়, তখন মনরথে পৌঁছে যাই সেই পুরাতন খোয়াই এর ধারে, সেই সোনাঝুরির জঙ্গলের মাঝে। আবার হবে সাক্ষাৎ তোমাতে আমাতে, নিভৃতে-নির্জনে, অন্য কোনো দিন, অন্য কোনো সময়ে। ভাল থেকো তুমি তোমার মতো করে।
তোমার রূপমুগ্ধ
আমি
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴