মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস-এর আলোচনায় অমিত কুমার দে-র 'উড়ো শাড়ির টিলা'
ব ই আলোচনা
উড়ো শাড়ির টিলা : অমিত কুমার দে
আলোচনা : মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
---------------------------------------------
যাকে রাজেশ্বরী নামে ডাকেন কবি তাকেই উৎসর্গ করেছেন'উড়ো শাড়ির টিলা'।প্রায় এগারো খানা কাব্যগ্রন্থের পর এ প্রেম কোন মায়া আঁচলের কথা বলে!পাঠক এই কাব্যগ্রন্থের ৪০টি কবিতার পংক্তির স্তবকে স্তবকে অনন্ত ভাবনায় বসেন।খুব বেশি দূর যেতে হয়না মননশীল পাঠককে।কোথায় যেন বাঁশি বাজে চৌরাশিয়ার,দূর সেই আঁচলের মায়াবী টান।সবুজ ছায়া ঘেরা চা বাগানের ভিতর দিয়ে কেবলই হেঁটে যান কবি অমিত কুমার দের পাঠক তৃণে তৃণে,চা বাগানের সরু মেঠো রাস্তায়...এ কোন ডুয়ার্স!পাখির মত ডানা মেলে দেয় মন।লেপচাখার বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ মনে পড়ে।মনে পড়ে বক্সা পাহাড়ের অন্ধকার রহস্যময়তা।নৈ:শব্দ খেলা করে উত্তরের প্রকৃতি জুড়ে। পাঠক দরজা খুলেই এক"খামার বাড়ি"র ভিতর নির্জনতা খুঁজে পান।সেই যে নিভৃত নিজস্ব একখানা সাঁকো আছে কবির,সেখানে দাঁড়ালে শোনা যাবে বাঁশির সুর,ডাহুক পাখির ডাক আর টিলার পাশে একখানা গেরুয়া রঙের উড়ো শাড়ি,শাড়ির অন্তরে লুকোনো আছে মায়া আর ভালবাসা।
কবির সঙ্গে পৌঁছে গেছি কখন কোন কুয়াশায়,শুনছি বসে পাইন জঙ্গলের খাদ ছড়িয়ে যাওয়া ফুল মায়া তামাং এর গান। পাতা প্চার গন্ধ এসে লাগে।ধাক্কা দেয়।'পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে নেমে আসছেন গৌতম বুদ্ধ।' মায়াবী সে কাফের গাঁও,ত্রিপিটক পাঠ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে গ্রাম।যশোধরা,শাক্যমুনি,ফুলমায়ার সঙ্গে কবি জ্যোৎস্না মাখেন অনন্ত আবেশে।
প্রকৃতির দিন রাত ছড়িয়ে থাকে অমিতের কবিতায়।"বোগেনভেলিয়ার বাসা" দেখেন কুয়াশার দরজায় দাঁড়িয়ে।"ভুটিয়া বস্তি"র অমলতাস,জয়ন্তী নদী,ঝিঁঝিঁ পোকাদের'আহির ভৈরব' গেয়ে চলা রেওয়াজ ছবি হয়ে ওঠে।এ যেন জীবনানন্দের চিত্ররূপময়তা।প্রকৃতির হলদে রঙ আর এক ঝাঁক বার্কিং ডিয়ার একাকার তখন।এভাবেই উঠে আসে'কোদাল বস্তি'র আনাচ কানাচ।তিস্তাচরের'বাথান'কথা।কবি অসাধারণ মায়ায় বলেন,
'আমি গোধূলি দেখব,না যূথবদ্ধ মোষেদের দেখব ভাবতে ভাবতে/সন্ধ্যার অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম।...আধমরা তিস্তার পাশে পাশে আজ বাথানেরা নেই'।(বাথান)
বন্ধ চা বাগানের যন্ত্রণা কথা শ্রমজীবী শ্রমিকের বুকের আগুন যেন লক্ষ্য করি'তালা খোলো' কবিতায়।'নরেন রায়ের দোতারা'র কথা একতারা বেজে যাওয়ার সুর শোনায়।'শ্রাবণ সঙ্গীত' কি সুর শুনিয়ে'খড়িমাটির' আলপনা আঁকে।পুরো উত্তর জুড়েই অমিতের পড়শি ছড়িয়ে আছে।তারা বসত করে কবির বুকের মধ্যেই।"আমাদের আরশিনগরে সন্ধে নেমে এলে/আমি আর লালন পড়শির ভিটে পাহারা দিই'* * *আমরা দুজন অবিকল বাউল গান হ ই।" 'সারিন হাতির' জঙ্গুলে স্বভাবে কবি কি মাহুতের মানবসত্তার ছায়া দেখেন?বলেন,'সারিন হাতি যখন সঙ্গমে যায়
তখন বন পাহারায় গিয়ে মাহুতের ও শরীর জাগে।'
জয়ন্তী নদী কথা,পাকদন্ডি পথ মাড়িয়ে কবির সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও হয়ে ওঠে'আস্ত পদাবলী'।
'বুবু','লুনা','পরকিয়া' কবিতা গুলিতে কি যেন মিষ্টিক বোধ জেগে আছে প্রকৃতির চুপ কথায়।'লন্ঠনজ্বলা গ্রামে'র ছবি দেখতে দেখতেই কোন 'দাবানলে''মাষাণ ঠাকুরকে' খোঁজেন কবি।সে গল্প উপকথা সত্যি হয় যেন।
'সুইসাইড','মা','বাবা',দাহ','চিঠি' কবিতা গুলোয় পাঠক খুঁজে পান ছবির পর ছবি।কাহিনি খুঁজতে ভালবাসেন তাঁরা।
এক অনন্য উদাসীন কবি অমিত চলেছেন কোন অলৌকিক মায়ায়! যেখানে ডুয়ার্সের হাটকে নিয়ে চলে গেছেন কলকাতার ধর্মতলায়।লেখেন,"ইচ্ছে করে ধর্মতলায় একদিন ডুয়ার্সের হাট বসিয়ে দেব/..."সেখানে ছবির পর ছবি।'কলকাতা হাইকোর্টের গা বেয়ে ঝুলতে থাকবে স্কোয়াশ লতা/সমস্ত কংক্রিট ধুয়ে মুছে ধর্মতলায় গজাবে ঢেকিয়াশাকের ঝোপ'...(ধর্মতলায় ডুয়ার্স)
এই না হলে মহাবিশ্বের আলোকময় পথে ভেসে চলা একজন কবি অমিত! সে চলায় রূপময়তা আছে,তাঁর নি:সঙ্গ প্রেম উত্তরের প্রকৃতি থেকেই উড়িয়ে এনেছে শাড়ি...সবুজ আর লালচে মাখা রঙ তার উড়ছে টিলার উপর।
স্থানিক পরিভাষা যেমন উঠে এসেছে তেমনি অদ্রিজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদ মন কেমনের আকাশ ছুঁয়ে যায়।আমাদের আত্মভোলা প্রিয় প্রকৃতির চেনা কবি পৌঁছে যাবেন অনায়াসেই পাঠক মননে,গভীরতায়।
চিকরাশি প্রকাশন
মূল্য:১৩০/
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴