সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
27-August,2023 - Sunday ✍️ By- রণজিৎ কুমার মিত্র 294

ভোরাই/রণজিৎ কুমার মিত্র

ভোরাই 
রণজিৎ কুমার মিত্র

এই সাত সকালে আবার কে এলো ? দরজায় কড়া নেড়ে শুধু হচ্ছে না, জোরে ধাক্কা মারছে। আরে বাবা খুলতেও তো একটু সময় লাগবে। বাবা বাজারে গেছে। মনে আছে শুভ র  তখন  ক্লাস ফোর। বিছানায় শুয়েই ছিল। মা রাগে গজগজ  করছিল। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে এখনো পড়তে বসেনি বলে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুভ সবকিছু টের পাচ্ছিল। মা দরজা খুলে দিতেই দুটো ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলে দুটো , "কাকিমা, বাঁচান বাঁচান আমাদের, কাকু কোথায়? আরে কে তোমরা, কি হয়েছে? এভাবে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লে যে। মার চিৎকার শুনে শুভ বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বাইরের ঘরে চলে এসেছিল। দুজনের মধ্যে একটি ছেলেকে শুভ চিনতে পেরেছিল, কয়েকদিন আগে ছেলেটি তার বাবার সাথে তাদের এই বাড়িতে শুভর বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। শুভর বাবার বন্ধুর ছেলে,  কলকাতার ওদিকে কোথায় যেন থাকে। বাবা ঐ দাদা টার সঙ্গে শুভকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, খুব ভাল রেজাল্ট করে এখানকার সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে, হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে। শুভ বেশিক্ষণ ওদের গল্পের মধ্যে না থেকে সরে  এসেছিল। মা চা- মিষ্টি খাইয়ে ওদের বিদায় করেছিল ,যাবার সময় হাসি হাসি মুখে বলেছিল হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে, মাঝেমধ্যে চলে এসো আমাদের বাড়ি। ছেলেটি তার বাবার সাথে হাসিমুখেই চলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ আবার সেই ছেলেটি আরেকজনকে সাথে নিয়ে তাদের বাড়িতে এভাবে এলো কেন? মা ওদের  সব কথা শুনছিল। সোফায় না বসে দুজনে মেঝেতেই বসে পড়েছিল ওদের জামাপ্যান্ট এ কাদার দাগ, ধুলোবালি লেগে খুব নোংরা, একজনের তো জামা ছিড়ে গেছে। ছেলে দুটো হাপাচ্ছে, কাঁপছে কি সব যে  বলছে তার কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। জামা খুলে দেখালো সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছে কারা, ওদের পিঠে লাল বড় বড় ফোসকা পড়ে গেছে। গতকাল রাতে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু খাওয়া হয়নি। ওদের কারা  যেন খুঁজছে। ওরা লুকিয়ে থেকে আজ সকালে শুভদের বাড়িতে এসেছে। ছেলে দুটো খুব কাঁদছিল। বাবা বাজার থেকে ফিরে এসে ওদের সাথে কথা বলল, মাকে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করতে বলল। সেদিনটা ওদের বাড়িতেই থেকে গেল ছেলে দুটি। পরেরদিন ছেলে দুটিকে বাবা বুঝিয়ে সুুঝিয়ে কোথায় রেখে এলো জানে না। রাগিং  শব্দটা সেই প্রথম শুনেছিল শুভ। এর অনেকদিন পরে ও বুঝতে পেরেছিল শব্দটার মধ্যে কত যন্ত্রণা দুঃখ-কষ্ট  আর নির্যাতন লুকিয়ে রয়েছে।
           মা চাইছিল শুভ এখানকার কলেজেই ভর্তি হোক। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাবা রাজি হননি। শুভর জয়েন্ট এন্ট্রান্সে যা রেংক হয়েছিল তাতে ওই কলকাতার প্রথম সারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই বাবা তাকে ভর্তি করে দিল ,তদবির  করে হোস্টেলেও জায়গা হয়ে গেল। শুভর খুব মন খারাপ হয়েছিল, মনে হচ্ছিল বাবা যেন শুভর পরিচিত নরম জায়গা থেকে একটা চারা গাছকে তুলে নিয়ে অনেক দূরে এক রুক্ষ শুষ্ক  জায়গায় পুঁতে দিলেন। চারাগাছটা মাটি জল আলো হাওয়া কতটুকু পাবে? বাবা তার খোঁজ খবরই রাখলেন না। হোস্টেলে রেখে আসবার সময় বলেছিল ও একটু-আধটু রর হয়েই থাকে। এত নামিদামি কলেজে একটা চান্স পেয়েছ, এখান থেকে বেরোলে দেখবে সাফল্যের সব কটা দরজা তোমার সামনে খুলে গেছে। শুভর মনে পড়ছিল জলপাইগুড়ির বাড়িতে সেই সকালে ভীত সন্ত্রস্ত হোস্টেল থেকে পালিয়ে আসা দুই দাদার কথা। বাবা তাকে এ কোন  বধ্যভূমিতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
      রাতে ডাইনিং হলেই একজন সিনিয়র দাদা তাদের চয়েস করলেন।
শুভ জলপাইগুড়ির, সুদীপ্ত মালদার, অঞ্জন পুরুলিয়ার, আর বাঁকুড়ার প্রহ্লাদ। সবকটা শালা গাঁইয়া ভূত। জানিস আমার পিতামহ শোভাবাজার রাজবাড়ির ছেলে। এই তোদের বাড়ির পাশের জঙ্গলে নাকি গন্ডার হাতি ঘুরে বেড়ায়। তুই তো বোকাচোদা পুরুলিয়ার, ছৌ নাচ নেচে দেখা তো। এই শালা মালদার ফজলি, বাপের বিয়ে দেখেছিস। মুখে জুতোর কালি মাখিয়ে, মাথায় সাবানের গুঁড়ো ঢেলে দিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে সকলের নাম ঠিকানা বলে আসার আদেশ জারি হল। ওটা ছিল ইন্ট্রো পর্ব, একটু সফট ধরনের রাগিং। পরের রাত থেকে শুরু হলো অন্য আরেক দলের হাতে চড় ঘুসি, কান ধরে উঠবস করানো। সঙ্গে নানা প্রশ্ন উত্তর পর্ব। জন্ম রহস্য কথা বর্ণনা ,দুজনে মিলে বাবা-মার বেডরুমের মিলন দৃশ্য অভিনয় করে দেখানো। দুনিয়ার সব থেকে কুৎসিত ভয়ংকর নিষ্ঠুর গালিগালাজ। পরেরদিন চূড়ান্ত পর্ব, নগ্ন করে প্যারেড করানো। একে অপরের পুরুষাঙ্গের মাপ নিয়ে চেঁচিয়ে বলতে হবে কত ইঞ্চি।  একজন এসে অন্ডকোষ চেপে ধরতেই শুভ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। গামছা পরিয়ে শুয়ে রেখে দিয়ে গেছিল। সকালে চোখ খুলতে পারছিল না প্রচন্ড জ্বর। পাশের ঘরের একজন সিনিয়র দাদা আলাপ হয়েছিল জলপাইগুড়ির ছেলে । বিশেষ কথা বলতো না এড়িয়ে যেত। সেই তাকে লুকিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আর বলেছিল বাড়িতে এসব কিছু না জানাতে ,ভুলে যেতে এইসব ঘটনা। গত কয়েক বছরে শুভ  এসব ঘটনা ভুলে যেতে পারেনি। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে মনে হয়েছিল গতবারের সব শোধ তুলতে হবে। সিনিয়র দাদাদের উস্কানিতে যোগ দিয়েও শেষ অব্দি আর ভালো লাগেনি। মনে হয়েছিল এসব থামানো দরকার। প্রতিবছরই এসব ঘটনা ঘটে যায়। কত চাপা কান্না, কত দীর্ঘশ্বাস যে জমা হয়ে থাকে, কত ছেলে - মেয়ে দের যে মানসিক চিকিৎসালয় যেতে হয়, সেসবের খবর কেই বা রাখে ? ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্য পেয়েছিল ২০০৭-এর ইউজিসির প্রতিবেদনে রেগিংয়ের ৪২ টি শারীরিক আঘাতের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। বিগত সাত বছরে ৩০ টি মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের এন্টি রেগিং সেল এর তথ্য অনুযায়ী 2021 সালে ভারতে ৫১১ টি রেগিংয়ের অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি কলেজ ইউনিভার্সিটিতেই এন্টি র‍্যাগিং কমিটি গঠন করা হয়। তারপরেও তো এসব বন্ধ হয়নি। পশ্চিমী ধারার এই সামাজিক  ব্যাধির নিরাময় করানোর দায়িত্ব কার?
    দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর পার করে কলেজ জীবন শেষ হয়ে এলো। এক সপ্তাহ পরে শেষ পরীক্ষা দিয়ে কলেজ ছেড়ে চলে যেতে হবে। ক্যাম্পাসিং ও হয়ে গেছে। বাবার কথা মতো ও সফল হয়েছে, বেশ বড় অংকের একটা মোটা মাইনের চাকরি অফার পেয়েছে একটি বড় কোম্পানি থেকে। বাবার সব সাধ পুরনো হয়ে যাবে এবার। বাবা কিন্তু টের ই পেল না এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে শুভ বাবা - মায়ের কাছ থেকে কত দূরে চলে গেল। মায়ের খুব কষ্ট হয়, বাবার কোন বোধহয় তাপ উত্তাপ নেই। বাবা এখন আশা করেন তার ছেলে বিদেশে গিয়ে ডলার পাঠাবে। শুভর এখনো মনটা পড়ে থাকে সবুজে ঘেরা আর স্বচ্ছ তোয়া নদী, শহরের মধ্যে । শহরটাতে  কত আদরের, কত ভালোবাসার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। ক্রমশ সেসব কেমন অস্পষ্ট আর ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর ডিপার্টমেন্টের থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ে একটু ঝিমুনি আসছিল, সারাদিন ল্যাবরেটরীতে খুব ধকল গেছে। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরা এসেছে, বাইরে খুব হল্লা   হচ্ছে। ঘরের অন্যান্য রুমমেটরা সবাই গেছে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের বাৎসরিক নির্যাতন উৎসবে। বন্ধুরা বলে শুভ কেমন ম্যাদামারা হয়ে গেছে, এসবের আর তেমন উৎসাহ পায় না। শুভ শুধু টের পায়, তার বুকের মধ্যে  স্বচ্ছতোয়া যে সব অনুভবের স্রোত ছিল তা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। আর কয়েকদিন পরেই তো হোস্টেল ছিড়ে দিতে হবে। চলে যেতে হবে অনেক দূর। শুভর মত ছেলেরা বোধহয় চিরকালই অনিকেত থাকে, তাদের ঘর নেই ঠিকানা নেই, পরিযায়ী মতো ঘুরে বেড়ানো।
   ঘরের মধ্যে কান্নার আওয়াজ তুলে কে যেন ঢুকে পড়েছে। শুভ দেখল বিবস্ত্র একটি ছেলে ঘরে ঢুকেই ছিটকিনি বন্ধ করে দিয়ে তার পায়ের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।" বাঁচান দাদাভাই, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। আমি পালিয়ে এসেছি।
আমি পারব না কিছুতেই পারব না, আমি  কিছুতেই নীচে ঝাঁপ দিতে পারব না। ভীত পশুর মতন ছেলেটা শুভর পায়ে ধরে কাঁপছে, অস্থির হয়ে খাটের নীচে ঢুকে যাচ্ছে। "আমি ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছি দাদা, খুলবেন না দরজা, খুলবেন না। আমাকে বাঁচান"। দরজায় দড়াম দড়াম করে লাথি পড়ছে। এই শুভ শালা!  ঢ্যামনা! দাদাগিরি হচ্ছে। তুই শালা কার বাপ হয়েছিস! খোল দরজা! খোল! ভেঙে ফেলব দরজা। শুভ শক্ত হয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। রাতের অন্ধকার ক্রমশ  গাঢ় হচ্ছে  । শুভ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বাকি রাতটুকু দাঁড়িয়ে রইল, কখন ভোর হবে? 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri