ভুলভুলাইয়া
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
নিজের মোবাইল ফোনটির হোয়াটসঅ্যাপের ঠিক মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।তার বাঁদিক ঘেঁষে টানা কিছু মুখের সারি। সব তার চেনা। হ্যাঁ, নিশ্চিত চেনা তার সব। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি একেকবার একেকটি মুখের কাছে গিয়ে মুহূর্তে কিছু বার্তা পাঠিয়ে ফিরে আসছিলেন অনায়াসে। প্রত্যুত্তরে মুখগুলি থেকে ফিরে আসছিল 'বাহ্', 'সাবাস', ' অভিনন্দন'.....আপ্লুত তিনি, বিগলিত তিনি আরো আরো মুখের দীর্ঘ তালিকার দিকে এগিয়ে চলেছিলেন সাহসী পদক্ষেপে। প্রবল করতালিতে মুখর তখন তার মুঠোফোন। 'সব পেরেছির' মালা গলায় ঝুলিয়ে দন্তবিশকিত তিনি তখন আহ্লাদে আটখানা থেকে আশিখানা হয়ে গাইছেন 'আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে....'
গানের সুরটা কেটে গেল হঠাৎই অতি পরিচিত এক গলার ধমকে। আহা, এমন মিষ্টি স্বপ্ন ভেঙে দিতে আছে! এমন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন! আরমোড়া ভাঙলেন ভুলুবাবু। সকাল হলো? নাকি ছুটির দুপুরের ভাত ঘুমের পর বিকেল? চোখ রগড়ে ভালো করে ঠাহর করবার চেষ্টা চালাতে চালাতে কিছুটা অস্পষ্ট ভাবে গিন্নির কড়া গলা কানে এল। তার গিন্নি আবার রেগে গেলে ছড়ায় কথা বলেন...
' রেশন বাজার আনতে হবে
শূন্য ভাঁড়ার ঘর
চাও কি তুমি সকাল সকাল
উঠুক বেদম ঝড়?......
আচ্ছা আচ্ছা..সকাল তবে।তা সে ঝড় উঠেছে, উঠুক। বরং ভালোই হলো। মাছের একখানা লিস্টি মাছওয়ালাকে পাঠিয়ে রবিবারের ছুটির সকালটা খানিক হোয়াটসঅ্যাপে কাটিয়ে নেওয়া যাবে'খন। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় যদি!
চশমা চোখে এঁটে চারিদিক দেখেশুনে নিয়ে সকালের নিত্যপুজোর মতো মুঠোফোনটি নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে চোখ রাখলেন ভুলুবাবু। আবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেমন! এত এত ছবি, আর এত এত নাম.. কি যে ভয়ানক গোলকধাঁধা! এই তো, সেদিন তাদের স্বামী স্ত্রীর বেশ অনেকদিন আগের একখানা ছবি আ্যালবাম থেকে উদ্ধার করে ছবি তুলে গিন্নিকে পাঠালেন।গিন্নি তখন তার বাপের বাড়ির পথে।সেই ছবি সটান চলে গেল....কি যেন নাম! কি যেন! অফিসের সেই যে..'মধু' দিয়ে নাকি 'মৌ' দিয়ে.... মনেই পড়ছে না.. যাক্, ছবি তো চলে গেল উদোর জায়গায় বুধোর কাছে..তারপর সেই বুধো অর্থাৎ সেই মধুবতী না মৌপিয়া রাগে ফোঁস ফোঁস করা মাথায় শিং গজানো ভয়ানক সব ইমোজি ছুঁড়তে লাগলো আর ভুলুবাবু ভাবতেই থাকলেন পুরোনো এই স্মৃতি দেখে গিন্নির এত রাগের কারণ কি।নাম আর নাম্বার..এই দুইয়ের ভুলভুলাইয়ার জেরে একেকজনের নাম্বার অন্যজনেদের নামে বেশ আঁটোসাঁটো ভাবে গেড়ে বসে গেছে ভুলুবাবুর হোয়াটসঅ্যাপে।
ঠান্ডা মাথায় মাছওয়ালা যতীনের কালো চশমা আর দশ আঙুলে আংটি পরা ছবিতে এসে মাছের সাপ্তাহিক এক ফর্দ বানালেন। তারপর চালান।যদিও আগে এমন ফর্দ পেয়েও যতীন মাছ পাঠিয়ে দেয়নি তবুও দেখা যাক।উদভ্রান্ত তরঙ্গে হোচট খেতে খেতে সেটি সটান পৌঁছে গেল অফিসের বড়বাবুর ব্রেকফাস্ট টেবিলের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটিতে। বেশ কিছুদিন যাবত মাঝে মাঝেই ভোলানাথের পাঠানো এমন মাছের লিস্ট আসছে ওনার কাছে।অফিসে ওনাকে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলবো বলবো করেও বলা হয়ে ওঠেনি আর। ভোলানাথকে বেশ সজ্জন বলেই জানা ছিল ওনার।শেষে কিনা ঘুষ দেওয়ায় নাম লেখালো।তাও আবার মাছ!
মৌপিয়া বা মধুবতী যেই হোক না কেন, অফিসের এই মেয়েটিকে বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন ভুলুবাবু।তবে মেয়েটি বেশ রাশভারি। কাজের সময় খেজুরে আলাপ তার না-পসন্দ।রবিবারের ছুটির সকালে একটা গুড মর্নিং তো পাঠানো যেতেই পারে।আবার সকাল সকাল গন্ডগোল করে ফেললেন ভুলুবাবু। ফুলের ছবি দেওয়া সেই গুড মর্নিং তো আসলে চলে গেল গিন্নির কাছে ।একেই তিনি রেগে আগুন, তেলে বেগুন হয়ে আছেন ভুলু এখনও বাজারে যাননি বলে। ওদিক থেকে শুরুতে এল মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ইমোজি। তারপর এল ব্যাগ,ছাতা আর সাইকেলের ইমোজি। সংক্ষিপ্ত মেসেজ,' এক্ষুণি বাজারে যাও...' পরিশেষে রাগে গনগনে ছড়া,
'ভেবেছো কী 'ফুল' পাঠিয়ে
করবে আমায় 'ফুল'( Fool)?
জপের মালা( মোবাইল) ভাসবে জলে
নেইকো তাতে ভুল।'
এতো মহা মুশকিল! তার মেয়ের বয়সী একটি মেয়ের এত ঔদ্ধত্য! 'আর আমাকে বাজারে যেতে বলার ও কে?'.. ভাবলেন ভুলুবাবু।তবে.. তবে ছড়ার ধরণটা যেন ঠিক গিন্নির মতো!এই তো সক্কাল সক্কাল রেগে গিয়ে তেড়েমেরে যেমন বলছিল বাইরে থেকে। তবে কি!!! মাথার ঘিলুগুলো যেন প্রবল বেগে নাড়াচাড়া খেল একপ্রস্থ।গিন্নি,অফিস কলিগ, বড়বাবু, মাছওয়ালা এমন আরো অনেক সংযোগ ঘেঁটে ঘ হয়েছে তার হোয়াটসঅ্যাপে উপলব্ধি করলেন অসহায় ভাবে। কান শনশন, মাথা বনবন আর চোখে তখন তার সরষে ফুল।কানে গোঁজা তুলো বের করে শুনলেন ঝড়ের লেশমাত্র নেই কোথাও। গিন্নির বাক্যবান থেকে বাঁচতে রাতে কানে তুলো গুঁজেছিলেন। সেজন্যই সকালে তার বলা কবিতা অস্পষ্ট ভাবে কানে এসেছিল।শ্রীমতী ভয়ঙ্করীর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস নেই এখন।'তার চাইতে বরং গিন্নিকে করজোরের ইমোজি পাঠাই আগে..' এই ভেবে কাঁপা হাতে হাত ফস্কে গিয়ে অন্য কার এক ছবিতে চলে গেল সেই হাতজোড়। ডিপির ছবিটা দেখলেন মনোযোগ দিয়ে।আরে! এ তো ঝুমার ছবি। সকালে ঘুম ভাঙলেই ঠাকুর দেবতার মুখ মনে করার আগে এই সেলেব্রিটির মুখ মনে পড়ে।ভুলুবাবুদের বাড়ির কাজে সাহায্যকারী ঝুমা।মহা ফাঁকিবাজ। প্রতিদিনের জায়গায় মাসে মাত্র কদিন দেখা মেলে তার। অসুখবিসুখের ছুঁতো দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে অধিকাংশ দিনই কামাই করে কাজে।তাই মাঝে মাঝে ওর ফোনে হানা দিয়ে ওকে ডেকে নিতে হয়।চোখ ছানাবড়া করে ভুলুবাবু দেখলেন হাতজোরের ইমোজিগুলো সব ঝুমার কাছে চলে গেছে। এবার ঝুমার পালা। ওর দিক থেকে অবিরত আসতে লাগলো ইঞ্জেকশন, ওষুধ, থার্মোমিটার, স্টেথোস্কোপ, ডাক্তার আর নার্সের ইমোজি। পরিশেষে দুঃখ দুঃখ মুখ আর চোখে জল মুখসহ একটি ভিডিও।টাচ করতেই বেজে উঠলো, 'মানুষ মানুষের জন্যে/ জীবন জীবনের জন্যে/ একটু সহানুভূতি কি/ মানুষ পেতে পারে না....'
ঝুমার চালাকি বুঝে নিয়েও ওর কাছে কৃতজ্ঞ হতে হতে ভুলুবাবু ওনার হোয়াটসঅ্যাপের যোগাযোগের প্রায় পুরো তালিকায় এই ভিডিওটি ফরোয়ার্ড করলেন একবুক আশা নিয়ে। মনের কোণে আবারও উঁকি দিয়ে গেল ভোরে দেখা স্বপ্নটি।
ঠিক সেই সময় ভুলুবাবুর গিন্নি তার স্বামীর পাঠানো গুড মর্নিং - এর ফুলটিকে হাসিমাখা চোখের সামনে ধরে কপট রাগে বলে চলেছিলেন -
'ছুটির দিনে মনের মাঝে
ফুটলো যখন ফুল,
ঝগড়াঝাঁটির মিথ্যে খেলায়
করবো না আর ভুল।
রেশন বাজার থাক, তোলা থাক
খিচুড়ি ডিমভাজা,
তেঁতুল পাতার সুজন হবো
গল্প নিয়ে তাজা।'