ভাষার ডাক্তারিয় ডায়াগনসিস/সাধন পাল
ভাষার ডাক্তারিয় ডায়াগনসিস
সাধন পাল
সেই বৃহস্পতিবার চা-বাগানের ডিভিশন হাসপাতালে সকাল থেকেই ভিড়।আজ মেইন গার্ডেন হাসপাতাল থেকে "নয়া ডাক্টার" আসবেন। নতুন হলেও ডাক্তারবাবু ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেছেন "আচ্ছা ইলাজ" করেন বলে।
শহুরে কম বয়েসি ডাক্তার তাদের চেক আপ করছেন, নিদান লিখছেন মাঝেমাঝে টেস্টের কথাও বলছেন। রোগীদের মধ্যে বাচ্চা বুড়ো মহিলা সব রকমই আছে।
শহুরে ডাক্তার বাবু চা বাগানে শ্রমিকদের প্রচলিত সাদরী ভাষা মোটেও জানতেন না। কিছুটা বাংলা কিছুটা ভাঙ্গা হিন্দি মিশিয়ে কাজ চালাচ্ছিলেন। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সী এক আদিবাসী মহিলা এবার এগিয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন
-কি হুয়া হ্যয় তুমকো?
মহিলা একরাশ হতাশা আর আক্ষেপের সুরে..
- কা কাহাবু ডাক্টারবাবু... রাইত্ মে শান্তিবাবু দিনমে খোকনবাবু! জিয়েক্ মুশকিল.! ত্বয় কোনো উপায় কৈর দে। ঠিকসে কামায়েক্ নি সাকোন্....
সাদরী ভাষা না জানা ডাক্তারবাবু
রোগীনির মুখে "রাইত" আর "দিনে" শব্দ দুটি আন্দাজে বুঝলেন, সাথে শান্তিবাবু আর খোকনবাবুর নাম দুটি শুনে আচমকাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
এ-কি কথা!
ছি: ছি: শান্তিবাবু আর খোকনবাবু তো ভীষণ বাজে লোক তাহলে! ঘটনাক্রমে ঐ চা বাগানে শান্তিবাবু আর খোকনবাবু নামে দু'জন বাবুস্টাফ কাজ করতেন। ডাক্তারবাবু অফিস সুত্রে জানতেন।
- আরে এইসব কথা হামকো কিউ বোলতা হ্যয়?
বোলনা হায় তো বড়সাহেব কে বলো গিয়ে।
এসব কেস থোড়াই আমি দেখবো- কেচ্ছা কেলেংকারী বড় সাহেবরা বুঝুক গিয়ে।
- তানিক খোকি লাগিন বড়া সাহেব কে বাতাবু? কা যে কাহিস্ ডাগ্তার...
ওরে বাবা... কেস তো ভয়ানক! এরমাঝে খুকিও আছে তাহলে! কার যে কে জানে!
- যাও.. যাও -আমি এইসব নেই জানতা হায়।
একপ্রকার তাড়িয়েই দিতে চাইছেন যেন! ডাক্তারের মুখে এধরনের কথা শুনে রুগীদের মধ্যে চাঁপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
- কেইসান ডাক্তারবাবু? আপনে বিমারী নি দেখি তো কে দেখি..?!
সেই মহিলা তো এবার রীতিমতো চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে।
- মোর বুড়হা কের বাগানমে পারমিন কাম আহে..মোকে কাঁহে ইলাজ নি করি ডাক্টার?
এবার আরও কয়েকজন উঁচু গলায় নানা কথা বলাবলি করছিল। বেশ একটা কোলাহল মতন। এরমধ্যে আরও কিছু লোকজন চেম্বারে ঢুকে পড়েছে। মরদরাই বেশী। ডাক্তার এবার বেশ ঘাবড়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে বুড়ো কম্পাউন্ডার বাবু কি একটা কাজে অফিসে গিয়েছিলেন। ঠিক ঐ সময়েই অফিস থেকে ফিরছিলেন। এই কোলাহল শুনে শশব্যস্ত হয়ে ডাক্তারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ডাক্তারের চোখমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কিছুটা ঘামছেন যেন।
- কি হয়েছে স্যার? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
কম্পাউন্ডার বাবু বহু পুরনো লোক। এই চা বাগান আর লোকজনকে হাতের তালুর মতন চেনেন! লোকজনও ডাক্তারের চেয়ে কম্পাউন্ডার বাবুকেই নিজেদের আপনজন বেশী মনে করে। ডাক্তার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ঠিকমতো কথা বেরুলো না। এবার কম্পাউন্ডার বাবু ভিড়ের দিকে ঘুরে
- এ্যাই কা হলাক্ রে ফাগ্নি?
ফাগ্নিকেই সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকেই জিজ্ঞেস করলেন। ফাগ্নি হাত-পা নেড়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে..
- আরে বাবু মোয় ডাক্তার সে খোকি কের দাওয়াই মাঙ্গলো তোহ্ উহ্ মোকে বড়া সাহেবঠিন্ ভেজোথে! এ্যায়সান হোয়েল কা?
"দাওয়াই" শুনে এবার ডাক্তারের অভিব্যক্তি কিছুটা পাল্টে গেল। কম্পাউন্ডার কিছুটা রাগতস্বরে..
- আপনি একে মেডিসিন দেননি?ও তো ডিপেনডেন্ট হিসেবে ট্রিটমেন্ট পাবে। ওর হাজব্যান্ড তো পার্মানেন্ট ওয়ার্কার বাগানের!
- ও তো মেডিসিন চায়নি! অন্য কথা বলছিল যে..!
ডাক্তার ইশারায় কম্পাউন্ডার কে চেয়ারের কাছে ডেকে কানে কানে বাংলায় কিছু বলাতে কম্পাউন্ডারের চোখমূখ অন্যরকম হয়ে গেল। আন্দাজ করলেন কোথাও একটা ভারী গন্ডগোল হয়েছে।
ফাগ্নি কে জিজ্ঞেস করলেন নিচু গলায় প্রায় ফিসফিসিয়ে
-- কা কইকে তোয় দাওয়াই মাংগলে ডাক্তারঠিন্? শান্তিবাবু খোকনবাবুকের নাম লেলে ক?
ফাগনি'র উত্তর শুনে এবার কম্পাউন্ডার হাসিতে গড়াগড়ি যায় আর কি!কিছুতেই হাসি আর থামে না তার।
- আপনি হাসছেন যে.. এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপার!!
-- বলছি,বলছি.. এরা ফাঁকা হলেই বলছি।
এরপর ফাগনি সহ বাকি পেশেন্টেদের দেখানো হয়ে গেলে তিনি মুখ খুললেন,
- ডাক্তারবাবু আপনাকে কিন্তু সাদরী ভাষাটা শিখতেই হবে এবার!
-- 'কেন? কেন?' ডাক্তারের গলায় প্রশ্ন।
- দেখুন ফাগ্নি আপনাকে বলতে চেয়েছে যে ওর খোকি অর্থাৎ কাশি হয়েছে। দিনের বেলায় শান্তি মানে আরাম থাকে আর রাত হলে খোকন বা কাশি আসে..! আপনি মশাই শান্তিবাবু আর খোকনবাবুকে এর মধ্যে নিয়ে এনে কি বিপদেই না ফেলছিলেন! হা হা হা!
ডাক্তার কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে এবার নিজেও জোরে জোরে হাসতে লাগলেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴