ভালোবাসার অরণ্য/শিখা সরকার
ভালোবাসার অরণ্য
শিখা সরকার
----------------------
আমার প্রথম দেখা আর ভালোবাসার অরণ্য নিমাতি ফরেস্ট । বন, জঙ্গল, অরণ্য যে নামেই অভিহিত করি না কেন - তার রূপ-সৌন্দর্য একই থাকে । আমি কিন্তু এখনকার সাজানো-গোছানো ফরেস্টের কথা বলছি না। কারণ ষাটের দশকের সেই অরণ্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত।
খুব কাছ থেকে দিনের পর দিন পেয়েছিলাম সেই গভীর অরণ্যের সাহচর্য। বেশ কিছুদিনের জন্য আমাকে দাদুর ( মাতামহ ) বাড়ি নিমতিঝোড়া চা - বাগানে থাকতে হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমাকে ভর্তি করা হল বাগান থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত কালচিনি ইউনিয়ন একাডেমি স্কুলে। ভাগ্যিস! তাই তো প্রতিদিন (ছুটি বাদে) ঘন বনবেষ্টিত পথে স্কুলে যাওয়ার সুবাদে প্রকৃতির অপরূপ অরণ্য শোভা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ।
যাতায়াত যদিও ছিল ত্রিপল ঢাকা ট্রাকে, তাতে কি? ত্রিপলের ফাঁকফোকরও তো ছিল।
মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তার দুপাশে শিমুল গাছের সারি যেন আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত। রাস্তায় ছড়িয়ে থাকত শিমুল ফুল। ভারি ভালো লাগত দেখতে। আমি অধীর আগ্রহে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে থাকতাম বনের গভীরে কি রয়েছে দেখার আশায়। গাড়ি তো খুব জোরে ছুটত না, রাস্তা ভালো নয় তায় আবার গাড়ি ভর্তি ছাত্রছাত্রী নিয়ে পথ চলা।
প্রতিদিনের চেনা পথ তবুও লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে ঢোকামাত্র একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। প্রতিদিন নতুন লাগতো জঙ্গলের ঝোপ -ঝাড় , বৃক্ষরাজি আর আরও ভেতরে প্রায়ান্ধকার জায়গা। ঐ এলাকার বাসিন্দাদের দেখেছি বার কয়েক। ওরাও দূর থেকে দেখত আমাদের। দিবালোকে দেখা মিলত বাঁদর, হরিণ, ময়ূর, বনমোরগ আর হরেকরকম পাখি।
প্রতিদিনের দেখা, চেনা, রকমারি গাছগুলো কেমন করে যেন আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিল। ঋতুভেদে ওদের পরিবর্তন সবাই দেখতে পায়, আমি দেখতাম ওদের প্রতিদিনের পরিবর্তন। কোন্ গাছে কুঁড়ি এসেছে, কোন্ গাছ ফুলে ছেয়ে আছে, কোন্ গাছের ডালপালা ভেঙেছে বাঁদরের দল, সারাটা পথ এসব দেখতে দেখতে কখন যে জঙ্গল শেষ হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। পথ ছিল একদম জঙ্গলের গা ঘেঁষে, তাই দেখার কোনো অসুবিধে হত না। বড়ো গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো যেন গাড়ির মাথায় আদরের পরশ বুলিয়ে দিত।
সবুজ বর্ণেরও যে পার্থক্য বা তারতম্য হয়, অরণ্য না দেখলে তা বোঝা যায় না। কালচে সবুজ, পীতাভ সবুজ, ঘন সবুজ, হালকা সবুজ, নানা বর্ণের সবুজের সমারোহ ।
বর্ষাকালীন অরণ্যের শোভা রাজকীয় মনোমুগ্ধকর । ঝকঝকে, তকতকে পাতায় সূর্য রশ্মির ঝলমলে হাসি, সে এক অপূর্ব দৃশ্য । অফুরন্ত পাতার সমাবেশে জঙ্গলের গভীরে দৃষ্টি চলে না, সেখানে শুধুই অন্ধকার। বুনো ফুলের সুগন্ধ আর ভিজে মাটির সুবাস মিলেমিশে এক আরণ্যক সৌগন্ধের উদ্ভব হত, যার ঘ্রাণ নিতাম বুক ভরে।
ঝাঁক বাঁধা রঙ-বেরঙের পাখি আর তাদের সমবেত কূজন যেন প্রকৃতি মায়ের বন্দনা গান। শাখা-প্রশাখায় শাখামৃগের দলের হুটোপুটি এ তো নিত্য দিনের ঘটনা। গরবী ময়ূরের কর্কশ কন্ঠস্বর অবশ্য ভালো লাগত না।
রাস্তার ধারে বড়ো বড়ো গাছের ওপরে মাচা বাঁধা। সেখানে বসে হাতি তাড়ানো হতো কখনো বা বাঘ। পথের একপাশে যেখানে জঙ্গলের ঘনত্ব কম, সেখানে ফসল রোপন করতো আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ফসল ক্ষেতের কিছুটা দূরে মেচ জনজাতির বসতি। গাবুরপাড়া নামেই খ্যাত ছিল এলাকাটি।
অরণ্যের শীতকালীন সৌন্দর্যও কিছু কম নয়, রিক্ত রূপের মধ্যেও ছিল কল্পচিত্রের ছোঁয়া। অবশ্য আমার চোখে। পত্রবিহীন ডালপালাগুলোর মধ্যে আমি দেখতে পেতাম হরেক চিত্রমালা। হয়তো বা পাখির রূপ, হাতির ছবি, বাঘের মুখের আদল কিংবা ময়ূরের অবয়ব। চিরহরিৎ গাছগুলো বহন করত নিজ গরিমা। লাল পাতার গাছ, ছোট ছোট নিষ্পত্র লতাগুল্ম সাদা, বেগুনি, নীল ফুলের সম্ভারে অরণ্য সেজে উঠত। তার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো ছুটে যাওয়া হরিণ কখনো বা দূর থেকে অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা এ দৃশ্য ভোলার নয়।
শীতের সকালে অরণ্য জেগে উঠতোএকটু উষ্ণতার জন্য। শিশিরকণা ঝিকমিক করত হীরের নাকছাবির মতো ঘাসের ডগায়। কচুপাতায় টলমল করত একফোঁটা মুক্তোদানার মতো শিশিরবিন্দু। ঐ যে বৃক্ষরাজি, যারা সারারাত কুয়াশার জলকণা মেখে অপেক্ষায় ছিল সূর্যোদয়ের? পাতাগুলো থেকে টুপটাপ জলকণা পরে অরণ্য ভূমি স্যাঁতসেঁতে , সূর্যের উত্তাপে তাদেরও বড়ো আনন্দ। সমস্ত পত্ররাজি দিয়ে শুষে নেবে রবি রশ্মির কিরণ। সারারাত ধরে যে নিশাচর প্রাণীগুলো জঠর জ্বালা মেটাতে একছত্র আধিপত্য করেছে বনে, জঙ্গলে এবার তাদের যেতে হবে গহীন আঁধারের কোলে। সূর্যালোকে যে তাদের বিষম ভয় । ভাবতে অবাক লাগতো , যে সূর্য তাপ ছাড়া প্রকৃতির অস্তিত্ব অচল, সেখানে উত্তাপহীন চন্দ্রাতপে নক্তচরের দলকেও অরণ্য সযত্নে লালন করছে তার স্নেহের অঞ্চল ছায়ায়।
আর একদিন হাতি পথ রোধ করেছিল আমাদের। কোনো কারণে সেদিন ফিরতে দেরি হয়েছিল। জঙ্গলের মাঝ বরাবর এসে হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। চারিদিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার, আমরাও অন্ধকার ত্রিপলের ঘেরাটোপে বসে। গাড়ির জোড়ালো হেড লাইটের আলোয় দেখা গেল শাবকসহ মা হাতি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা পেরিয়ে গেল। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে হাতি পথ ছাড়ল। ভয় এবং কৌতূহল মিশ্রিত সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।
এমনই কত বিচিত্র ঘটনা উপহার পেয়েছি অরণ্যের কাছ থেকে। যেদিন রাত হয়ে যেত ফেরার সময়, সেদিন দেখা পেতাম নক্তচরের। জঙ্গলের ভেতর তাদের জ্বলন্ত চোখ।
আর দেখেছি সহস্র জোনাকির আলোয় আলোকিত অরণ্যের রাতের সজ্জা। সারাটা বন যেন সোনালী চুমকি দিয়ে সাজানো। জ্যোৎস্না রাতের অরণ্য? সে তো আরও মোহময়ী।
ঋতুতে ঋতুতে বিস্ময়কর সাজে সেজে ওঠে যে আরণ্যক প্রকৃতি মাতা, তার রহস্যময়তা, সহনশীলতা, পালন ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব যে আমাদেরও নিতে হবে ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴