ভারতীয় সিংহিনী : ভগিনী নিবেদিতা/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতীয় সিংহিনী : ভগিনী নিবেদিতা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বামী বিবেকানন্দ যদি একটা মহাকাব্য হয় তাহলে ভগিনী নিবেদিতা সেই মহাকাব্যের প্রকান্ড একটা অধ্যায়।আয়ারল্যান্ডের সমাজসেবী, বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রী,লেখক তথা শিক্ষিকা মার্গারেট নোবেলের জীবনকে বিশ্লেষণ করলে, আজ আর তাঁকে কখনোই বিদেশিনী বলে মনে হয় না। ধর্মপিপাসু মার্গারেট মনের মধ্যে ধর্ম নিয়ে একটা সংশয় নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের পথ অনুসরণ করে আর্তের সেবায় সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষে পাড়ি দেন। সেদেশে রাগবি, রেক্সনচেষ্টারের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করবার পর, উইম্বলডনে ডিলিউস স্কুলে শিক্ষকতা করার কাজেও যোগ দিয়েছিলেন। তিনি নিজে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন, " দ্যা কিংসলেস স্কুল। সব ছেড়ে দিয়ে স্বামীজীর আহ্বানে আর্তের সেবায় এদেশে এলেন মার্গারেট নোবেল।
প্রথাগত শিক্ষায় খুব বেশি আস্থা তাঁর ছিল না। লেখার হাত ছিল খুব সুন্দর। নানান সামাজিক বিষয় নিয়ে লিখে চলেছেন নিরন্তর । লেখার বিষয়ও অন্যরকম। ক্ষমতা ও চাকচিক্যের বাইরে তিনি একদমই আলাদা মানুষ। কয়লাখনির শ্রমিকদের নিয়ে লিখেছেন তাদের করুন কাহিনি। খৃষ্ট ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করে ধর্মের খুঁটিনাটি জানবার পরেও তার নিজের মনে ধর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর, খৃষ্ঠ ধর্মের মধ্যে পাচ্ছিলেন না। পরে তিনি এই সংশয় দূর করবার জন্য বৌদ্ধ ধর্ম নিয়েও অনেক পড়াশোনা এবং গবেষণা করেন। তার বসবার ঘরে ছিল এক বুদ্ধমূর্তি। ধর্ম নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেও, ধর্ম নিয়েই তার মনে সংশয় দেখা দেওয়ায়, তিনি তাঁর মনের সংশয় দূর করবার জন্য, ১৮৯৫ এবং ১৮৯৬ সালে দু দুবার লন্ডনে স্বামীজীর সাথে দেখা করেন। স্বামীজী ১৮৯৭ সালে মার্গারেটকে ভারতে এসে নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। মার্গারেটের বাবা ও ঠাকুর দা ধর্মযাজক ছিলেন। আশৈশব সেই পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়েই বড়ো হয়েছিলেন মার্গারেট। ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপিপাসু। মার্গারেট স্বামীজীর শিকাগো ধর্ম মহাসভার বক্তৃতায় তিনি আকৃষ্ট হন এবং চমৎকৃত হন তাঁর জ্ঞান ও দৈবী সারল্য দেখে।
স্বামীজীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৮৯৮ সালের ২৪ শে জানুয়ারি ভারতের মাটিতে পা দিলেন। প্রথমে তিনি এলেন মাদ্রাজে। সেখানে কিছু কাজ সেরে কোলকাতায় এলেন ২৮ শে জানুয়ারি। কোলকাতায় এসে তিনি একটি হোটেলে উঠেছিলেন। তাকে বাংলা শেখানোর ভার পড়েছিল স্বামী সদানন্দের ওপর। সেই সময় মা ভবতারিণীর মন্দির ছাড়া মায়ের মন্দির, শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দির, স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দির কিছুই তৈরী হয় নি। বাংলা ভাষাশিক্ষা চলাকালীন স্বামীজী তাঁকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর নাম দিয়েছিলেন নিবেদিতা। তাঁর সাথে তার সমাজসেবার কাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু, নন্দলাল বসু, ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর সহ অনেক বিশিষ্ট মানুষ সহায়তা করেছিলেন। অরবিন্দ নিবেদিতা র লেখা বই " কালি দ্যা মাদার " বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। জাপান থেকে এসেছেন ওকাকুরা। ওকাকুরা ভালো ইংরেজি জানেন না। নিবেদিতা ওকাকুরা কে "আইডিয়াল অফ দা ইষ্ট " বইটি লেখার জন্য সহায়তা করলেন। আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু নিবেদিতার কাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
স্বামীজী মার্গারেটকে অকপট চিঠিতে লিখেছিলেন ভারতবর্ষের দারিদ্র্য এবং কুসংস্কার নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, ভারতীয়রা জাত-ধর্ম, ছোঁয়াছুয়িতে ডুবে আছে। ভারতীয়রা সবসময় শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে। মুমূর্ষু এই দেশকে বাঁচাতে তাঁর মতো একজন মহীয়সীকে প্রয়োজন। এদেশে আসবার পর স্বামীজী নিবেদিতাকে বললেন বৃটিশ সাহেবদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। নিবেদিতা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। সম্পর্ক স্থাপন সম্ভবও হয়েছিল। কিন্তু সেই সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয় নি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় প্রকাশ্যে লর্ড কার্জন ভারতীয়দের সম্পর্কে কটাক্ষ করলে নিবেদিতা লর্ড কার্জনের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিলেন।
স্বামীজী তার চিঠিতে নিবেদিতাকে লিখেছিলেন, ইউরোপের সাচ্ছন্দ্য এদেশে পাওয়া যাবে না। মুম্বাসা জেটিতে জাহাজ পৌঁছতেই নিবেদিতা দূর থেকে দেখেছিলেন স্বামীজীর স্বপ্নের ভারতবর্ষকে। স্বামীজী তাকে এদেশের মাটিতে বরণ করে নিলেন। ১৮৯৮ সালে যখন প্রথম ভারতে এলেন তখন তাঁকে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়েছিল। জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখ অর্থাৎ কোলকাতায় আসবার তৃতীয় দিনে তিনি এরিক হ্যামন্ডকে চিঠিতে লিখেছেন তাঁর শোয়ার ঘরের কথা। ঘরের লাগোয়া বাথরুমের কথা, যেখানে আলাদা কোনো ঘেরা নেই। যেখানের লোহার মগে করে তাকে স্নান করতে হতো। এক এক সময় তাঁর মনে হত তিনি কোলকাতার চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মগে করে স্নান করছেন।
দক্ষিনেশ্বরে স্বামীজীর সাথে গেরুয়া বসন পরে, সুরেলা কণ্ঠে সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করতেন, গালে মশার কামড়ের দাগ। অত্যন্ত কঠিন কৃচ্ছসাধনায়, অনেক আগুনে পুড়ে তিনি হয়েছিলেন খাঁটি সোনা।
তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পান নি। কিন্তু তাঁর সহধর্মিণী মা সারদাকে পেয়েছিলেন নিজের মা'য়ের মতো করে। প্রথম দর্শনেই শ্রী শ্রী মা সারদা তাকে খুকী সম্বোধন করে কাছে ডেকে নেন। পাশ্চাত্যের মানুষদের তখনকার সমাজ 'ম্লেচ্ছ' আখ্যায় ভুষিত করতো। কিন্তু মা সারদা তাকে কাছে ডেকে নিয়ে ফল প্রসাদ খাইয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথায় তিনি লিখেছেন, সাদা ফিনফিনে শাড়ি পরিহিত মা আমাকে সনাতন হিন্দু সমাজে প্রবেশের অধিকার দিলেন।
উত্তর কোলকাতায় তাঁকে থাকতে দেবেন কে? তিনি ইউরোপ দেশের নাগরিক বলে কাজের লোক অবধি পেতেন না। কাজের লোক পেলেও যারা বাড়ির কাজের লোক তারা নিবেদিতা'র কাছাকাছি আসতো না। এই সমস্যার কারণে তিনি পার্ক ষ্ট্রীট ছেড়ে ১০/২ বোসপাড়া লেনে চলে আসেন মায়ের বাড়িতে। লাল মেঝের ঘরে মাদুরের ওপর ঘর আলো করে বসে আছেন মা। নিবেদিতা মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ। তিনি তো ম্লেচ্ছ নন। নরেনের সাথে বিদেশের বাড়িঘর ছেড়ে এদেশে মানুষের সেবা করতে এসেছেন। পাড়া প্রতিবেশীরা অবশ্য ছি ছি করছে। তারা মা সারদাকে না একঘরে করে দেয়। মা সারদা অবশ্য নির্বিকার। নিবেদিতা বুঝতে পেরে চলে নিজেই মা'য়ের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন ১৬ নম্বর বোস পাড়া লেনে। ঘর তো পাওয়া গেল, কাজের লোক অমিল হয়ে গেল। কাজের লোক পেলেন তো তারা তাঁকে স্পর্শ করে না।
কোলকাতায় প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তিনি নিজের হাতে ঝাঁটা তুলে নিয়েছিলেন। ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর সেই সময় প্লেগ রোগেকে নির্মুল করবার প্রয়াসে ব্রতী হন। নিবেদিতা ডাক্তার আর জি করের সাথে সমান ভাবে এই কাজে ঝাপিয়ে পড়েন। একদিন ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর দেখেন নিবেদিতা একটা স্যাঁতসেতে ঘরে একটি মুমূর্ষু শিশুকে কোলে করে তাকে খাওয়াচ্ছেন। ডাক্তার কর তার চিকিৎসা করলেন, কিন্তু প্লেগ আক্রান্ত সেই শিশুকে বাঁচাতে পারলেন না।
স্বামীজীর শরীরটা ভালো না। নিবেদিতা এসেছেন দেখা করতে। স্বামীজী নিবেদিতা কে খাওয়ালেন। একাদশী বলে নিজে খেলেন না। নিবেদিতাকে হাত ধোয়ার জল দিলেন। তোয়ালে দিয়ে ভগিনী নিবেদিতার হাত মুছিয়ে দিলেন। ইতিপূর্বে শুরু শুরুতে কখনো কোনো ভুল হলে স্বামীজী নিবেদিতাকে বকাও দিতেন। আর আজ এহেন আচরণে নিবেদিতা খুবই বিড়ম্বনা বোধ করলেন। বললেন এমন সেবা তো তাঁর নিজেরই করা উচিৎ। স্বামীজী স্মরণ করিয়ে দিলেন, প্রভু যীশু ও তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। নিবেদিতা জানালেন , সেটা তো ছিল 'দ্যা লাষ্ট সাপার'।
কে জানে এই দিনটিই হবে স্বামীজীর জীবনেও শেষ দিন। ১৯০২ সালে চলে গেলেন স্বামীজী। নিবেদিতার কথায় স্বামীজী দেহটাই ত্যাগ করলেন মাত্র।সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দিয়ে গেলেন ভগিনী নিবেদিতাকে।
তখন জলন্ত চিতায় শায়িত স্বামীজী। নিবেদিতা ভাবলেন এক খন্ড গেরুয়া বস্ত্র পেলে ভালো হতো। তিনি সযত্নে তার কাছে রেখে দিতেন। হাওয়ায় জলন্ত চিতা থেকে একটুকরো গেরুয়া বস্ত্র উড়ে তার কাছে এসে পড়ল।
সালটা ১৯১১, কিছু দিন ধরেই সিস্টার নিবেদিতার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বন্যা এবং দু:ভিক্ষ পীড়িত এলাকায় কাজ করতে করতে তিনি শারীরিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছেন। ম্যালেরিয়াতে এবং ম্যানেনজাইটিস তাকে আরও দূর্বল করে দিয়েছে। দার্জিলিঙে কিছু কাজে এসেছেন, সাথে হাওয়া বদলও। মেঘ কুয়াশায় ঢাকা দার্জিলিং এ কমলা রঙের পোশাক পরেছেন নিবেদিতা। শরীরটা তাঁর ভালো যাচ্ছে না বলে ড: নীলরতন সরকার প্রতিদিন এসে দেখে যাচ্ছেন। এর মাঝেই হঠাৎ করে জীবনের সবটা উজার করে ভারতকে অর্পণ করে ১৩ই অক্টোবর শিলিগুড়ির রায় ভিলায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন সিস্টার নিবেদিতা। স্বদেশী গ্রহণ বিদেশি বর্জন, গোপনে গুপ্ত সমিতিতে টাকা পাঠানো, মেয়েদের জন্য বিশেষ স্কুল চালানো, স্বামীজীর নতুন ভারত গড়বার এক আকাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে ভারতবর্ষের জন্য নিবেদিত প্রাণ সিস্টার নিবেদিতা চিরতরে চলে গেলেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴