সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
30-March,2025 - Sunday ✍️ By- অমিতাভ গোস্বামী 50

ভরা থাক স্মৃতিসুধায়/অমিতাভ গোস্বামী

ভরা থাক স্মৃতিসুধায় 
অমিতাভ গোস্বামী 
---------------------------

'কেন এই আনাগোনা 
কেন মিছে দেখাশোনা 
       দু দিনের তরে,
কেন বুক ভরা আশা, 
কেন এত ভালোবাসা 
    অন্তরে অন্তরে....'

অনিন্দ্য সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে বসে আজ রবীন্দ্রনাথের লেখা এই লাইনগুলো মনে এল। মৃত্যু যে কত অমোঘ এবং অনিবার্য সেটা আরো একবার উপলব্ধি করলাম পাঁচই ফেব্রুয়ারি রাতে অনিন্দ্যর অকালে চলে যাওয়ার খবরে। কে এই অনিন্দ্য ? তার সঙ্গে কি আমার রক্তের কোন সম্পর্ক আছে ? নাকি সে আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত কেউ ? না এর কোনোটিই না হয়েও সে আমার বন্ধু স্বজন একান্ত আপনজন। আসলে জীবনের যাত্রা পথে কখনো কখনো এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শে আমরা আসি যাঁদের স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরকালীন সঞ্চয় হয়ে থাকে। তেমনি একজন মানুষ ছিল অনিন্দ্য।

ফেসবুকের মাধ্যমেই অনিন্দ্যর সঙ্গে আমার যোগাযোগ জীবনের এক চরম উৎকণ্ঠার রাতে । বাড়ি থেকে বহু দূরে কেরালার ত্রিবান্দ্রম শহরে সে রাতে আমি একা। পরদিন আমার স্ত্রীর মস্তিষ্কে জটিল অস্ত্রোপচার হবে। কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালে বন্ডে সই করে এসেছি। গেস্ট হাউসে ফিরে কিছুই ভালো লাগছিল না। গভীর দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য অন্যমনস্কভাবে ফেসবুকের পাতায় চোখ রেখেছিলাম। সেই সময় ফেসবুকে অনিন্দ্য আমাকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই সে আমার দুঃসময়ের বন্ধু।

ফেসবুকের সঙ্গে আমার সখ্যতা করোনাকাল থেকে। কখনো কখনো দু একটি লেখা পোস্ট করি। সেগুলোর ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। তেমনি একটা লেখা অনিন্দ্যর খুব ভালো লাগে এবং ক্রমশ ফেসবুক , মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ এর মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বয়সে অনেক ছোট হলেও দুজনের পছন্দের মধ্যে অনেক মিল থাকাতে বন্ধুত্ব নিবিড় হতে সময় লাগেনি। ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ২০২৪ এর মার্চে চিকরাশি সাহিত্য উৎসবে। আমি হলে প্রবেশ করা মাত্র ও এমনভাবে আমাকে সম্বোধন করল যেন কত দিনের পরিচিত আত্মজন। ওর সহজ সরল আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

অনিন্দ্যর জন্মস্থান বীরপাড়াতে আমার যাতায়াত দীর্ঘ দিনের। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে বীমা শিল্পের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে বারবার গেছি বীরপাড়াতে। এর অনেক পরে ২০১৪ থেকে ২০১৬ কর্মসূত্রে বীরপাড়াতে পোস্টেড ছিলাম। তাই বীরপাড়াতে আমার অনেক বন্ধুই রয়েছে। এসব কথা জেনে অনিন্দ্য খুব আনন্দিত হয়েছিল। আমার সেসব বন্ধুদের অনেককেই ও চেনে। অনিন্দ্য নিজে ছিল বিনয়ী,  মিতভাষী ও প্রচারবিমুখ। ওর অসাধারণ মেধা এবং বহুমুখী গুণের কথা জেনেছি বন্ধুদের কাছে।

মেধাবী অনিন্দ্য স্কুল এবং কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছিল। ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করাতে সরাসরি পোস্ট অফিসে চাকুরীর সুযোগ পায়। অনেকেই বলেছে অনিন্দ্য নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অনেকটাই উদাসীন ছিল। ওর মত মেধা সম্পন্ন ছেলে চাইলে অনেক দিকে যেতে পারতো কিন্তু ও সেদিকে দৃষ্টি দেয়নি। কারণ ও আত্মকেন্দ্রিক ছিল না। ওর উদ্দেশ্যই ছিল 'বহু জন হিতায়, বহু জন সুখায়।' পাড়া-প্রতিবেশী সকলের বিপদে আপদে ও ছিল পরম ভরসাস্থল।

 সাহিত্য সংস্কৃতিতে অনিন্দ্যর ছিল স্বাভাবিক টান। গদ্য লেখার হাত ছিল আকর্ষণীয়। অমিত কুমার দে  সম্পাদিত 'সহজ উঠোনে'র সংস্পর্শে এসে অনিন্দ্য যেন নতুন দিশা পায়। ওর সাহিত্য প্রতিভার স্ফুরণ দেখা দেয় যা অমিতবাবু সহ অন্যান্য উঠোনিয়াদের সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু অনিন্দ্য তো নিজেকে নিয়ে মেতে থাকার ছেলে নয়। বীরপাড়ার মতো প্রান্তিক ছোট্ট জনপদে অনিন্দ্য তার শিক্ষক প্রয়াত কবি তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাংলা সাহিত্য চর্চার আগ্রহ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন কবি অমিত কুমার দে মহাশয়। গড়ে ওঠে  'রোববারের সাহিত্য আড্ডা।' আত্মপ্রকাশ করে 'তাতাসি' পত্রিকা।

এই পত্রিকার জন্য অনিন্দ্য প্রথম আমার কাছে লেখা চায় ১৩ই এপ্রিল ২০২৪ তারিখে। আমিও আনন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার অনুভবের কিছু কথা লিখে পাঠাই। আমার কাছেই ও পার্থ দার (বন্দ্যোপাধ্যায়) ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করে এবং পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। সেটা ছিল ১৯ শে মে ২০২৪। জলপাইগুড়ি থেকে আমি পার্থদা এবং গৌতম গুহরায় একসঙ্গে যাই বীরপাড়ার জুবিলি ক্লাবে আয়োজিত সেই সাহিত্য সভায়। সেখানে উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করি অনুষ্ঠানকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য সমস্ত দিকে অনিন্দ্যর কত তীক্ষ্ম নজর । ওর সাথীরা শুনেছি ওকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকে। সেই ডাক যে কতটা যুক্তিযুক্ত সেটা সেদিন উপলব্ধি করেছি।যেহেতু সেদিন বীরপাড়া যাওয়ার পথে এক স্থানে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল তাই অনিন্দ্য আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। নিরাপদে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত ও খবর নিয়েছে। এতটাই ভালোবাসা ও সহমর্মিতা ওর হৃদয়ে সঞ্চিত ছিল। সেই সাহিত্য সভার আনন্দের রেশ আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল। গত ৯ই ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে অনিন্দ্য আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানাল 'তাতাসি'র পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হবে এবং আমার কাছে একটি কবিতা চাইল। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সেই কবিতা পাঠানোর অনুরোধও জানালো। আমি ৩১শে ডিসেম্বর রাত্রে সেই কবিতা পাঠালাম। সেটা ছিল একটা প্রেমের কবিতা। অনিন্দ্যর খুব পছন্দ হলো কবিতাটি। আমি ওকে ইংরেজি নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা জানালাম। তখন কি আর জানি বিধাতা অন্যরকম ভাবছেন! ৫ই জানুয়ারি'২০২৫ চিকরাশি উৎসবে ওর সাথে আবার দেখা হল। সেখানেও ও যথারীতি ক্যাপ্টেনের ভূমিকায়। বীরপাড়ার সবাইকে নিয়ে দলবেঁধে এসে অংশগ্রহণ করলো। বিদায় নেওয়ার আগে আমাকে বলল, এবারও কিন্তু আমাদের সাহিত্য সভায় আসতে হবে। আমি সানন্দে সম্মতি জানালাম। সেই শেষ দেখা।

দীর্ঘ দেহি অনিন্দ্যর চোখ জোড়া ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। চলনে বলনে ছিল নিরহংকারী। কথাবার্তা ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ মায়াময়। এমন একটি ছেলে যার সংস্পর্শে এলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে অথচ সে বিয়ে করেনি। অকৃতদার। আমার জানতে খুব ইচ্ছে ছিল যে, ওকে কি কোন মেয়ে প্রেম নিবেদন করেনি নাকি সবাইকে নিয়ে ওর অনেক বড় স্বপ্ন ছিল বলে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত স্বপ্নের দিকে ফিরে চায়নি। বয়সে অনেক ছোট বলে লজ্জায় আর সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আর আজ তো ভাই দূরদেশে। শুনেছি ভালো মানুষেরা নাকি পৃথিবীতে বেশিদিন থাকে না। ভগবান দ্রুত তাদের নিজের কাছে ডেকে নেন। অনিন্দ্য নিজেও কি ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিল? তাই কি জাগতিক মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে অমৃতলোকে পারি দিল ! 'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু , তোমার পানে , তোমার পানে , তোমার পানে..।'

 সাহিত্যের পাশাপাশি অনিন্দ্য সঙ্গীতও বড় ভালোবাসতো। মনে আছে একবার লাটাগুড়ির এক হোমস্টেতে বসেছিল সারারাতব্যপী গান, বাঁশি ও দোতারা বাদনের আসর। আমি হাজির সেখানে। শুনলাম অনিন্দ্যরও আসার কথা। পরে অবশ্য কোন কাজে আটকে গিয়ে ও আর আসতে পারেনি। পরদিন ফেসবুকে আমি অনুষ্ঠানের কিছু অংশের ভিডিও পোষ্ট করি। তাই দেখে অনিন্দ্যর সে কি আফশোস। আমাকে বললো, ' দাদা, পরের অনুষ্ঠানে আমার মিস হবে না ।' সবই আজ স্মৃতি। অনিন্দ্য হয়ত আজ সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই তবে আপনজন ও অসংখ্য গুণমুগ্ধদের স্মৃতিপটে ও চির অম্লান । দেবলোকের সভায় আজ নক্ষত্ররূপে বিরাজ করছে অনিন্দ্য। সেখানেও হয়তো  তার স্বভাবসিদ্ধ সমাজসেবা ও সাহিত্যসেবার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।শুধু আমরাই তার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত। 

মহাপ্রাণ অনিন্দ্য তার মহৎ গুণাবলীর অসংখ্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছে আমাদের কাছে। যেগুলো ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে অনুশীলনের মাধ্যমেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করা যাবে ।ক্যাপ্টেনের দেখানো পথে তার সাথীরা নিশ্চয়ই অগ্রসর হবে। উপনিষদ থেকে জানা যায় সৃষ্টির মূলে আছে আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। এক থেকে বহু হবার আকাঙ্ক্ষা। অনিন্দ্যও মিশে থাকবে বহুর মধ্যে।

আজ প্রান্তবেলায় এসে উপলব্ধি করি যে ,জীবনকে  আটকে রাখা যায় না। 'জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।' এই পরম সত্যকে মর্মে ধারণ করেই সত্য, শিব ও সুন্দরের সাধনায় রত থাকতে হবে ।

 ' হে পূর্ণ তবে চরণের কাছে 
  যাহা কিছু সব আছে আছে আছে -
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তর গ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার 
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার রাখিবারে যদি পাই।
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই-
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।।'

           ----------000---------

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri