বোধ-দ্বয়/রাজর্ষি দত্ত
বোধ-দ্বয়
রাজর্ষি দত্ত
(এক: সৃষ্টির নিয়ম)
শ্রীময়ী দরজা খুলে বেরিয়ে এল বেগুনী রঙা সাটিনের হাউসকোটের সাইড ফিতায় নট বাঁধতে বাঁধতে। কটেজের লাগোয়া চিলতে বারান্দায়।
এসে বসলো প্রিন্টেড কভার কুশনের গদি ফেলা বেতের চেয়ারে, সৃজনের মুখোমুখি। সামনের কেইন সেন্টার টেবিলের উপর ওর চা-টা ঢাকা দেওয়া।
সৃজনের চা খাওয়া শেষ, ওর হাতে একটা সিগারেট – সেটা ধরায়নি এখনও।
“আমি ব্রাশ করিনি –পরে চা খেয়ে নেব গরম করে” শ্রীময়ী জানায় ওর আদুরে গাঢ় স্বরে। তারপরে হাত দুটোকে সোজা করে আড়মোড়া ভেঙে সামনের দিকে তাকায়।
ওদের কটেজের সামনে মেশিনে ছাঁটা ঘাসের একফালি লন। সাদা ছিট ম্যাজেন্টা রঙের পাতাবাহার গাছ দিয়ে ঘেরা। অদূরে আরও কয়েকটা এমন কটেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাউণ্ডারি ঘিরে আছে উঁচু ফেন্সিং দিয়ে। ফেন্সিং-এর ওপারে ঘন বন- শাল, পিপুল, শিশু, বহেরা, পাকুর, ছাতিম, অর্জুন…এমন আরও কত কি গাছ যেন একরাশ সবুজ মেঘের মত ঘন সন্নিবিষ্ট। সেখান থেকে একটানা ঝিঁ ঝিঁ ডাক ভেসে আসছে।
নিবিড় অরণ্য দিয়ে ঘেরা এই অফবিট রিসর্টটি হনিমুন কাপলদের জন্য একদম পারফেক্ট। গতকাল পৌঁছে বিকেলে একবার হাঁটতে বেড়িয়েছিল যুগলে…হাত ধরাধরি করে। রিসর্টের মেইন গেট দিয়ে বেড়িয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিলে জোড়া শিমুলগাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে রূপালি ফিতের মত একটা পাহাড়ি নদী। সেখানে পৌঁছতে হলে বনের মধ্য দিয়ে আছে সরু পথ…কিন্তু সেদিকে ওদের যেতে মানা করেছে এখানকার সিকিউরিটি গার্ড।
আকাশের রঙ এখন ধীরে ধীরে স্লেটের মত কালো হচ্ছে। একটা রাধাচূড়ার মাথায় ভর্তি থোকা থোকা হলুদ ফুলের সাথে আকাশের কালোর অদ্ভুত কম্বিনেশন! শ্রীময়ী ভাবতে থাকে। তার মুখেও এসে পড়ছে এই মেঘলা সকালের ভিনদেশী আলো। ওর অবিন্যস্ত কিছু চুল আলগোছে পড়ে আছে প্রসাধনহীন মুখের উপরে। সৃজন অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে…সে দেখায় আছে অনন্তকালের ছোঁয়া। এই একান্তে নিবিড় করে পাবার যেন শেষ নেই…
শ্রীময়ী সেটা খেয়াল করে সলজ্জভাবে মাথা নিচু করে। তারপর একটু আগের কথা ভুলে গিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে পুরোটা খেয়ে বলে – “বাঃ, দারুণ ফ্লেবার তো!”
-“দ্যাখো ওদিকে!...” সৃজন আঙুল তুলে দ্যাখায়।
এবার হাল্কা ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি, এবার দেখলো লনের ঘাসে বসে থাকা সাদা সাদা পোকারা উড়ছে। মিনিট খানেকের মধ্যেই অজস্র ফিনফিনে টুকরো কাগজের মত পাতলা পোকাগুলি লনের জমির উপর উড়তে লাগলো। উড়তে গিয়ে তারা বসছে পাতাবাহার গাছের উপরে…এক-দুটা পথ ভুলে তাদের দিকেও এসে পড়ল। দমকা হাওয়ার ছাঁট শ্রীময়ীর মুখে চুলগুলি নিয়ে খেলা করছে, সেটা সামলে ও বলে –“কি সুন্দর!”
বৃষ্টিটা আবার চট করে থেমে গেল। এবার গাছের আড়ালে বসে থাকা পাখিগুলি উড়ে এসে পোকাগুলিকে কপ্ কপ করে গিলতে লাগলো। লনের ঘাসে লাফিয়ে লাফিয়ে খুঁটতে লাগলো তাদের…
-“এঃ মা, কেমন খেয়ে ফেলছে গো!” শ্রীময়ী কথাটা বলে চলে গেল ঘরের ভেতরে।
সৃজন ভাবছে। ভাবতে ভাবতে সিগারেটটা ধরায়। একটা চমৎকার দৃশ্যের পর এই ছন্দপতনটা তার ভালো লাগলো না। শেষমেশ এটাই বুঝি সব! দুনিয়ার প্রত্যেক সম্পর্কগুলিই কি ‘খাদ্য-খাদকের’? আলিঙ্গনের মধ্যে, ভালোবাসার মধ্যে, সৃষ্টির মাঝে কিংবা যেকোন সামাজিক রিলেশনের ভেতরেও এই ‘খাদ্য-খাদক’ সম্পর্কটি যেন ফল্গুধারার মত বয়ে চলছে। বেচারা ‘প্রডিউসার’-কে নিয়ত রাক্ষসের মত গিলছে ‘কনসিউমার’। খিদেও কি খালি পেটের? না তো...যশের, সেক্সের, নেশার, পাওয়ারের, সেলফ ইমেজের…
মুখটা তেতো লাগছে। দূর থেকে ভেসে আসছে একটা কর্কশ ডাক –ময়ূরের…
আধখাওয়া সিগারেটটা ও অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিল।
(দুই: বিপন্ন বিস্ময়)
“যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই-তাহা চাই না…”
প্রবীণা হেসে বললো “খুব কবিতা আওড়াচ্ছ দেখছি!”
প্রবীণ মাথা নেড়ে বলে “জায়গার গুণ হবে…”
নির্জন সরু বনপথের ভেতর দিয়ে হাঁটছে দুজনে। রাস্তাটি পিচের কিন্তু ভাঙাচোরা। আধঘণ্টা আগে বৃষ্টিতে ভিজে পিচের কালো রং আরও ঘন হয়েছে। ডাইনে-বাঁয়ে জংলী লতা, আগাছা, ঘাস, ফার্ন বর্ষার জলে ফুলেফেঁপে জমে রয়েছে ডাঁই করা সবুজ স্তুপের মত। পথের ধার ঘেঁসে উঁচু বা নিচু জমি ছেয়ে আছে অসংখ্য পাইন-থুজা-ধুপি গাছে। তাদের বাদামী অমসৃণ ভেজা কাণ্ডে ঝুলছে নানা জাতের অর্কিড। কোন কোন গাছের গোড়াগুলি সবুজ হয়ে আছে আচ্ছাদিত শ্যাওলায়।
বৃষ্টি থামায় মেঘ কেটে গিয়ে শেষ বেলার রোদ পাইনের মাথায় একঝলক দেখিয়ে আবার ম্লান হয়ে গেল।
কিছু কথা দুজনেরই দুজনকে বলার আছে। বহুদিনের জমানো কথা। তা অভিযোগ বা অভিমান যা কিছু হতে পারে। তাই আসা এই নিরিবিলি ঘেরাটোপে।
এখনই সেসব কথায় না গিয়ে প্রবীণা একটু জোরে শ্বাস টেনে উপরে তাকায় –“উফ, অনেকদিন পর! সত্যি, যতবার এসে পড়ি এই গাছের সমুদ্রে, ততবার মনে হয় আমরা কত দিকভ্রষ্ট, কতখানি জটিল, জীবনের সার্থকতা থেকে কতটা সরে যাওয়া…”
মাথার টুপিটা ঠিক করে নিয়ে প্রবীণ বলে- “যাক! দার্শনিকতা শুধু আমার একচেটিয়া নয়!”
অপরজন হেসে ফেলে “হ্যাঁ গো...আমরা বেশ কিছুদিন যে একসাথেই ছিলাম…সংক্রমণ তো হবেই”
রাস্তার পাশে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে ধপ করে বসে বিপরীতজন বলে “তুমিও বস পাশে! আজকাল একটু হাঁটলেই হাঁফ ধরে যায়…”
তারপর পাশ থেকে একটা ফার্ন ছিঁড়ে নিয়ে উল্টিয়ে ধরে বলে “ দেখেছ-এর তলার দিকটা সবুজ না…রূপালি-এটার নাম সিলভার ফার্ন…”
-“আমরাও বয়সে তলানিতে পৌঁছে গেছি- সিলভারের মত দাম থাকতে পারে, কিন্তু শরীর কি মন আগের মত সবুজ নেই!” সংক্রামিত দার্শনিকের মন্তব্য!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবীণ বলে “সবাই একটা কথাই বলেছিল তখন। দ্যাখো, সমাজের কাছে আমরা দুজনেই ভালমানুষ। তেমন রাগারাগি, মন কষাকষিও কি হয়েছে কোনদিন? কিন্তু তবুও আমাদের বিচ্ছেদটা আটকানো গেল না!”
-“কেন বল তো? আমারও হয়তো কিছু ভুল ছিল…পরে বুঝতে পেরেছি…”
-“ঠিক বা ভুলের কথা নয় গো! দোষগুণ নিয়েই তো মানুষ…তবুও এমন হয়…আমিও ভেবেছি অনেক… সময়ের বা সিচুয়েশনের দাবি মেনে অপরের পরিপূরক হওয়া…সহজ নয় মোটেও। অথচ অনেকেই এসব নিয়ে ভাবে না…কি সুন্দর কাটিয়ে দিচ্ছে যুগ…”
-“আসলে কখন যে ইগো আমাদের ভালবাসা, সহমর্মিতাকে ছাপিয়ে যায়…নিজেরাও বুঝতে পারি না…"
প্রবীণার গলা ঈর্ষৎ ভেজা শোনায়।
খানিকক্ষণ নীরবতার পর পুরুষকণ্ঠটি অনেকটা স্বগতোক্তির মত বলে ওঠে “…অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় - আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে…”
-“ক্লান্ত–ক্লান্ত করে…” নারীকণ্ঠ যোগ দেয়-“তখনই মন চায় চিরতরে মুক্তি…সম্পর্ক থেকে…জীবনের থেকেও…” শেষদিকে তার গলা ফিসফিসের মত শোনায়।
-“হুঁ…” সম্মতিটা যেন বহু দূর থেকে এসে বাতাসে মিলিয়ে যায়।
দুজনে পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকে। ধীরে ধীরে নামে সন্ধ্যা। পাখিদের কিচকিচানি বেড়ে যায়। দমকা হাওয়ায় গাছের খসখসানির সাথে নিঃসৃত জংলী গন্ধ কুয়াশার পিঠে সওয়ারি হয়ে ঘিরে ঘিরে পাক খেতে থাকে। নানাজাতের অর্থহীন বিক্ষিপ্ত শব্দের প্রতিধ্বনিও স্থিমিত হয়ে আসে। দূরে পাহাড়ের গায়ে সাদা হলুদ ফুটকির মত আলো জ্বলে ওঠে…এই আলোকবর্তিকা এক একটি ছোট ছোট ঘরের, কোন না-চেনা সুখী মানুষের গল্প…
কেউ কোন কথা বলে না। বলার কথা বুঝি সব ফুরিয়ে গেছে।বা সব কথাই অর্থহীন!
নির্জনতা আবিষ্ট করে ফেলে দুজনকেই। ভেতর থেকে হয়তো ওরা আরও নির্জন…
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴