সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
25-June,2023 - Sunday ✍️ By- শুক্লা রায় 722

বৃষ্টি দেখতে পাহাড়ে/শুক্লা রায়

বৃষ্টি দেখতে পাহাড়ে
শুক্লা রায়

মেয়ে বলল, 'মা চল দার্জিলিঙ।'
আঁৎকে উঠলাম। এই বৃষ্টিতে দার্জিলিঙ! লোকে শুনলে হাসবে। মেয়ে অবাক গলায় বলল, 'কেন! মা, বৃষ্টি হয়েছে বলে রোজকার শিলিগুড়িটাই কত সুন্দর লাগছে দেখতে। সেখানে দার্জিলিঙ! মা ভাবতে পারছ?'
ওর বাবা শুনেই বেঁকে বসল। অসম্ভব! যে কোনোদিন ইলেকশন ডিউটি চলে আসবে। এ সময়ে কোনোভাবেই বাইরে যেতে পারবে না। কিন্তু মেয়ে তো শুনবে না। অতএব দার্জিলিঙ গামী সরকারি বাসে মা-বেটির টিকিট কেটে ফেলল। বুকিং ডট কম থেকে ঘরও একটা দুদিনের জন্য বুক করা হয়ে গেল। আমি ঝোঁকের মাথায় যাব বললেও ঠিক জুতের লাগছিল না ব্যাপারটা। অবশেষে চাপা টেনশন নিয়ে জংশন থেকে বাসে রওনা হলাম। কিছুদূর গিয়েই সব ভুলে মনটা ভালো হয়ে গেল। এ পথের সিনিক বিউটি নতুন করে বলার মতো নয়। প্রতিটা বাঁক একেকটি বিষ্ময়। দুজনে বুঁদ হয়ে পথের সৌন্দর্য্য পান করতে করতে চলেছি। মেয়ে জানলা দিয়ে ঘন ঘন ছবি তোলায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আমার দিকে ফিরে আমাকে একটু ছুঁয়েই আবার বাইরে চোখ। এ খুশি বোঝানোর নয়। আর মা হিসেবে আমার আনন্দটাও তখন অসীম। দার্জিলিঙ থেকে ঘন্টা খানেকের দূরত্বে এসে একটা ছোট্ট দোকানের বারান্দায় গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। খাওয়ার ব্রেক। তবে ড্রাইভারের ড্রাইভিং শিল্প দেখে আমি মুগ্ধ। অতবড় গাড়িটাকে ওইটুকু ছোট জায়গায় কীভাবে ঢুকিয়ে দিল। মেয়ে নামতে নামতে বলল, 'পারফেক্টলি দাঁড় করিয়েছে মা, দেখেছ?'
 আমি আর মেয়ে কিছু খেলাম না। আমাদের ধারণা ছিল হোটেলে পৌঁছেই ভাত-টাত পেয়ে যাব অনায়াসে। আমি এককাপ চা নিলাম। হিন্দি বলায় আমার দারুণ দক্ষতা। সে যে একবার শুনবে তারই অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আর যিনি সত্যিই  হিন্দি বলতে পারেন তিনি আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছেন আমার জন্য চিঁড়ে ভাজা নাও। তুমি পাঁপড় ভালোবাসো, এক প্যাকেট নাও। অতএব আমি, 'ভাইয়া এক কাপ চায়ে দিজিয়ে, তারপর হ্যানা দিজিয়ে, ত্যানা দিজিয়ে করে অতি কষ্টে দোকানদারকে মনের কথা বোঝালাম। টাকা দেব গুগল পে তে। সেটাও জম্পেশ করে বলে ফেললাম, 'ভাইয়া গুগল পে হোগা?' দোকানদার QR কোডটা সামনে এনে দিলেন। স্ক্যান করে নাম দেখি 'অংশুমান চক্রবর্তী! আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, 'আপনি বাঙালি?' ভদ্রলোক হেসে মাথা নাড়ল। 
'বাঙালি। এখানে দোকান করেছি।'
কী কান্ড! এর থেকে দুঃখজনক কিছু হতে পারে! আগে জানলে কত আনন্দে বাংলা বলা যেত।
যত দার্জিলিঙের পথে উঠছি ঘন কুয়াশা আর মেঘে ভরে যাচ্ছে চারদিক। কখনো বা হালকা বৃষ্টি। আমরা তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে। কোনো কিছু মিস করতে চাই না। একসময় উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক দূরে উঁচু পাহাড়ের মাথায় চারদিকের মেঘ ধীরে ধীরে সরে একটা উঁচু চূড়াসহ বাড়ি ভেসে উঠল। যেন কোন রূপকথার রাজপুরী। এখনই কোনো রাজকন্যা তার বিশাল গাউন দু হাতে ধরে লনে হাঁটতে বেরোবে, অথবা কোনো রাজপুত্র টগবগ টগবগ করতে করতে ঘোড়ায় চেপে ছুটে আসবে। আমার কল্পনাকে নস্যাৎ করে মেয়ে বলল, 'মা, দেখেছ কতবড় স্কুল!' ভালো করে তাকিয়ে দেখি তাইত!
তবে বর্ষাকাল বলে বাড়তি পাওনা হল মাঝে মাঝেই প্রাণবন্ত পাহাড়ি ঝোরাদের পাহাড়ের গা বেয়ে লাফিয়ে নামার দৃশ্য। যেন কিশোরী মেয়ে খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। অসাধারণ লাগছিল। সাধারণত এযাবৎ কাল শীতের মরসুমেই পাহাড় পাহাড় করেছি। তখন এই ঝোরাগুলি ছিল শীর্ণকায়া, মরা মরা। আর আজ তারাই সুন্দরী উচ্ছল কিশোরী।
 অবশেষে দার্জিলিঙ পৌঁছে তো গেলাম। কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের আশংকা সত্যি প্রমাণ করে হোটেল নিয়ে ঝামেলা বাধল। যে হোটেলটার দার্জিলিঙে থাকার কথা ছিল, সেটা চলে গেল বাতাসিয়া লুপ। মেয়ে ফোন করে আচ্ছা ঝাড় দিল। কারণ আমার পক্ষে স্বল্প ভাষাজ্ঞানে ঝগড়া করা অসম্ভব। কিন্তু ঝাড় তো দিল থাকি কোথায়! একজন পরিচিতের ফোন নাম্বার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আবার আমার চেনা নন। কিন্তু ফোন করে রেফারেন্স দিতেই সানন্দে তাঁর একটা চেনা হোটেল ঠিক করে দিলেন। একঘন্টার বিশ্রাম শেষে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টিভেজা পথঘাট দেখতে দেখতে ম্যালের দিকে। ঘন ঘন পাল্টে যাচ্ছে চারপাশের পরিবেশ। এই বৃষ্টি তো, এই কুয়াশা। কেমন একটা রহস্যময় পরিবেশ। হাল্কা রোদ গায়ে চলকে উঠেই চারপাশ ঘন অন্ধকার। মা-বেটি আবছা আবছা পথটাতেই হাঁটছি। হঠাৎ অন্ধকার কেটে সোনালী আলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি গুঁড়ো গুঁড়ো কুয়াশা নানা আকারে হীরের মতো ফুটে উঠেছে ওর চুলের উপর। মেয়েও তাকিয়ে, 'মা তোমার মাথায় কুয়াশা! খুব সুন্দর!
আমি চা খোর পাব্লিক। বেশ কয়েকবার খেয়ে নিলাম। মেয়ে খুশি খুশি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে, 'মা, ভালো লাগছে?'
পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ম্যালে চলে এলাম। আমার উদ্দেশ্য আর একটা দল পেলে শেয়ারে গাড়ি নিয়ে চারপাশটা একটু ঘুরে দেখা। অবশেষে কলকাতা থেকে আসা একটা দলের সঙ্গে আলাপ হল। ওনারা দুটো পরিবার একসঙ্গে। ওনাদের সঙ্গেই জুটে গেলাম আমরাও। আমাদের দুজনের জন্য আমি দিলাম চোদ্দোশ টাকা। মোটামুটি দার্জিলিঙ গেলে সবাই যে জায়গা গুলোতে যান আমরাও তার ব্যতিক্রম হলাম না। সাতটা পয়েন্টের সবশেষে ছিল রকস গার্ডেন। আহা! কী অসাধারণ পথটা। ভয় ও রোমাঞ্চ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত আনন্দময় অনুভূতি। তবে অনেক জায়গায় পথটা বিজ্জনকভাবে ভাঙা, এবড়োখেবড়ো। নেপালি ড্রাইভার অসম্ভব দক্ষতায় ওই ভাঙা খাড়াই পথটা দিয়ে আমাদের নিচে নামিয়ে আনলেন। প্রতিটি গাড়িই খুব সাবধানে এগোচ্ছে। এখানে কেউ কারো সঙ্গে অযথা ঝগড়া করে না। কোনো বাঁকে দুটো গাড়ির মুখোমুখি দেখা হলে একজন স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়ে অন্যজনকে যাওয়ার জায়গা করে দেয়। ফেরার পথে খাড়াই বেয়ে ওঠার সময় আর এক কান্ড। আমাদের সামনে একটি ওয়াগনর ছিল। হঠাৎ দেখি সেটি আর এগোয় না। আমাদের ড্রাইভার ওই ড্রাইভারের সঙ্গে আমাদের দুর্বোধ্য নেপালিতে কথোপকথন সেরে আমাদের জানালো ছোট গাড়িটা আর খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে পারছে না। তখন শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টি। চাকা স্কিড করছে। নীরুপায় ড্রাইভার ওই বৃষ্টির মধ্যেই সওয়ারীদের নামাতে বাধ্য হলেন। তারপর ফাঁকা গাড়ি নিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। আমরা তার পেছনে।
পরদিনই ফেরা বলে ওইদিন আমাদের ইচ্ছে ছিল অল্প বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় নাইটিংগল পার্কে গিয়ে বসা। কিন্তু তা আর হল না। প্রবল বৃষ্টি। 
পরদিন একটু দেরি করে বিছানা ছাড়লাম। আস্তে ধীরে রেডি হয়ে হোটেল ছেড়ে আবার বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাত্রা। অলসভাবে হাঁটতে হাঁটতে মেয়ে বলল, 'মা দেখ দেখ কীভাবে উপরে উঠছে।' তার গলায় তখন প্রবল উত্তেজনা। তাকালাম। একজন মাঝবয়সি পাহাড়ি মানুষ দু দুটো ভরা সিলিন্ডার পিঠে নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে বানানো সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছেন। পাহাড়ের সৌন্দর্যের বিপরীতে পাহাড়ের মানুষদের এই কষ্টকর জীবন যাত্রা। আমরা তো দুদিনের জন্য ঘুরতে এসে আনন্দ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি। যারা এখানে থাকে তারা প্রতিটা মুহূর্তে বোঝে পাহাড়ে থাকার কঠিন দিকটা। একজন বয়স্ক মহিলা থাকে থাকে কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতলের পেটি পিঠে নিয়ে যখন কুঁজো হয়ে ম্যালের পথ ধরে ক্রমাগত উপরে উঠতে থাকেন আমরা অবাক বিষ্ময়ে দেখি। মনটা খারাপ হয়ে যায়। সাত সকালে আর এক পাহাড়ি রমণী টুকরিতে সব্জি সাজিয়ে পিঠে নিয়ে হন হন করে হেঁটে চলেছেন। অথচ আমরা সমতলের মানুষরা সহজলভ্য টোটোতে আয়েশে বসে শহরের যানজট বাড়িয়ে চলেছি। 
বাসস্ট্যান্ডে এসে আগের দিনের গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্টেটবাসের টিকিট কাউন্টার চিনি না বলতেই সানন্দে দেখিয়ে দিল। এখানে এসে অবধি কোনো নেপালি মানুষের কাছে কোনোরকম অসহযোগিতা পাইনি। মেয়েকে বাসের কাছে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম। দুশো দশটাকায় দুজনের দুটো টিকিট করে বাসে উঠে বসলাম। আবার সেই পাহাড়ি বাঁক। কার্শিয়াঙের মায়াবী পথ। কুয়াশার ভেতর দিয়ে এক অনিন্দ্য সুন্দর যাত্রা।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri