বুধুয়া, তোকে আমি ভুলিনি/প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
বুধুয়া, তোকে আমি ভুলিনি
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
আমার জন্ম সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে। ডুয়ার্সের বেতগুড়ি চা বাগানে। আমি চা বাগানে ব্রিটিশ ম্যানেজার দেখেছি। চার পাঁচ জন ম্যানেজেরিয়াল স্টাফ, কিছু বাবু পদের কর্মচারী ও বাদবাকি শ্রমিক। শ্রমিকদের মধ্যে নানা স্তর বইদার, দফাদার, চৌকিদার , ড্রাইভার, কাঠমিস্ত্রী, ইত্যাদি ইত্যাদি। বাগানে একটি দুটি মাড়োয়ারি বা বিহারীদের দোকান ছিল, সেগুলো শপিং মলের ক্ষুদ্র সংস্করণ। ভূষি থেকে ছাতা সব পাওয়া যেত। ওই দোকানের টক ঝাল মিষ্টি লজেন্স আর চানাচুরের বোয়মের প্রতি ছিল আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ। সে সময়টাতে শিশুদের হাতে কেউ পয়সাই দিত না। চোখের দেখায় ছিল রসনা তৃপ্তি।
সপ্তাহে একদিন বাগানে ছোট্ট একটা হাট বসত। সেই হাটের মধ্যিখানে আমাদের প্রাইমারী স্কুল। বাগানের চারজন শ্রমিক পুত্র আমার সহপাঠী। ওদের মধ্যে বুধুয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কচি তেঁতুল, পাকা ডাউয়া ফল, কাঁচা আম ওর পকেটে থাকবেই থাকবে। ও একদিন দেখিয়েছিল জবাফুল গাছের ঝোঁপে ঘুঘুর বাচ্চা। দুটো বাচ্চাকে ওদের মা কিছু একটা খাওয়াচ্ছিল। আমাদের দেখে মা ঘুঘুটার সে কি রাগ!
চা বাগানে ছিল লেপার্ডের ঘোরাঘুরি। তবে আমরা প্রচুর ঘুরেছি চা বাগানের ভেতর, বালি ও কুচি পাথরের রাস্তায়। শীতের প্রারম্ভে লেপার্ড মায়েরা চা বাগানের ভেতরে শুকনা নালা গুলোতে বাচ্চা প্রসব করত। অনেক শ্রমিককে লেপার্ডের হানায় আহত হতে দেখেছি। গুরুতর আহতদের জলপাইগুড়ি পাঠানো হত চিকিৎসার জন্য।
বেতগুড়ি ছিল ডানকান কোম্পানির বেশ বড় চা বাগান কিন্তু দুর্গা পূজা হত না। মহালয়ার দিন সকালে আমাদের মুলার্ড রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের অনবদ্য কন্ঠস্বরে দেবী বন্দনা শুনে এক মোহময় অনুভব সৃষ্টি হতো। বুঝতাম দেবী আসছেন। আর আমাদের চা বাগানের বাসায় মা তৈরি করতেন নারকেলের নাড়ু, চিড়া ও মুড়ির মোয়া এবং মুড়কি। অন্য দিনগুলোতে আমাদের পেটেন্ট ব্রেকফাস্ট ছিল সেদ্ধ ভাত ও বাড়িতে তৈরী ঘি। ওই চা বাগানের সব বাড়িতেই পয়লা বৈশাখ পায়স তৈরি হতো।
আমরা বাবুবাড়ির লোকজন ট্রাকে চেপে দূর্গা ঠাকুর দেখতে যেতাম। এদিকে মেটেলি অপর দিকে বাগরাকোট পর্যন্ত ছিল আমাদের পূজা পরিক্রমা। মাকে দেখতাম অন্য চা বাগানের মহিলাদের সঙ্গে খুব খাতির। ওরা গল্প করত। পেট প্রায় ভরা থাকত প্রসাদের নানা রকম ফলে অথবা খিঁচুড়িতে। অন্য চা বাগানের মহিলাদের সঙ্গে মায়ের দেখা হতো বছরে মাত্র এক-দুবার কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব ছিল গভীর।
রাতে ওই ট্রাকে চেপে ফেরার সময় আমাদের পাশে আকাশে ভেসে বেড়াত লাজুক চাঁদ। আমরা, শিশু ও কিশোরের দল ঘুমিয়ে পড়তাম ট্রাকের নিদারুণ ঝাঁকুনি উপেক্ষা করে। সেকালে বেতগুড়ি চা বাগানে কালীপূজাও হতো না। চোদ্দো বাতি, চোদ্দ শাক বাবুদের বাড়িতে হতো। আমরা শাক খুঁজে বেড়ানোর অজুহাতে পড়ায় ফাঁকি দিতাম। তবে আমরা মেটেলি কালীবাড়িতে পুজো দেখতে গিয়েছি বার কয়েক। সেই সময়ের কালি মন্দিরের শ্রী তেমন মনে রাখার মত হয়ত নয়। কিন্ত মন্দিরটিতে আমার প্রথম শৈশবের মাথার চুল উৎসর্গ করা হয়েছিল। মা বলতেন মন্দিরের দেবী সদা জাগ্রত। এখন মন্দিরটির নতুন নির্মাণের পর চাকচিক্য ও ভক্তদের আনাগোনা বেড়েছে।
আমার যেটা খারাপ লাগত তা হল শ্রমিক পরিবারের প্রতিমা দর্শনের জন্য কোন গাড়ির বন্দোবস্ত ছিল না। শ্রমিক পল্লীতে আলোর উৎসব তখন দেখিনি। বিদ্যুতের আলো তখনও শ্রমিক পল্লীর মুখ দেখেনি। একবার আমার বন্ধু বুধুয়া বলেছিল সে আমাদের চা বাগানের গাড়ি চেপে দূর্গাঠাকুর দেখতে চায়। আমাকে সে ব্যবস্থা করে দিতে বলে। আমি গভীর প্রত্যয়ে বলেছিলাম 'তুই চলে আসিস। আমি গাড়ির পাশে থাকব। আমরা একসঙ্গে ঠাকুর দেখে আসব'।
সপ্তমীর দিন বিকেল চারটায় বুধুয়া গাড়ি পার্কিংয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। পরিস্কার জামা প্যান্ট ও একটা খাকি কাম্বিস কাপড়ের জুতো পড়ে এসেছিল। ওর মুখে একটা উজ্জ্বল আনন্দের ছাপ, আমিও বুধুয়াকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম। মা বারবার বলেছিল সামনেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা ঠান্ডা যেন না লাগে। ড্রাইভার ছিল বুধুয়ার আপন মামা। যে বুধুয়াকে আড়ালে ডেকে কিছু বলছিল, এবং একটা সিকি অর্থাৎ চার আনা দিয়েছিল। সবাই গাড়িতে উঠছিল। আমিও গাড়িতে উঠে বুধুয়াকে ডেকে বলেছিলাম 'দেরি করছিস কেন? গাড়িতে উঠে পড়'। বাগানে চাকুরে এক কাকু আমাকে বেশ ধমকের সুরে বলেছিল 'লেবার লাইনের ছেলেটি গাড়িতে উঠবে না'। যেন কেউ সজোরে আমার গালে চাঁটি মারল।
গভীর ব্যথা হৃদয়ে নিয়ে ধনুকের ছিলার মত ছিটকে চলে গিয়েছিল বুধুয়া। আমার উচ্চগ্রামের ডাক উপেক্ষা করে চা বাগানের পথে সে হারিয়ে গেল। সেই কাকুকে আমি ক্ষমা করিনি।
বুধুয়া তারপর থেকে আর বিদ্যলয়ে আসেনি। আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে মালবাজার গিয়ে বুধুয়াকে খুঁজেছিলাম, যদি সে পরীক্ষা দিতে আসে। না, তার দেখা পাইনি। পরীক্ষা শেষ হলে আমি প্রতিদিন চা বাগানের নানা প্রান্তে বুধুয়াকে খুঁজেছি আর হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছি। মা আমার কষ্ট কেমন করে যেন বুঝতে পারত। একদিন মা বলেছিল বুধুয়া ডামডিম চা বাগানের স্কুল ভর্তি হয়েছে ওখানে তার মাসির বাড়ি।
অন্যদিকে আমি ফাইভে গিয়ে জলপাইগুড়ির স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম।
আমার বাবা এক সময় অন্য চা বাগানে বদলি হয়ে গেলেন। চা বাগানের জীবনে সমষ্টিগত আনন্দের বড় উৎস ছিল ইনফরমেশন ও পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত সিনেমা। তবে চা বাগানে সর্বদাই হিন্দি সিনেমা দেখান হতো ফ্যাক্টরির কাছে ছোট মাঠটিতে। কিন্তু লেবারদের পরিবারের সঙ্গে একসাথে বসে সেই সিনেমা দেখা তৎকালীন বাবু সমাজ সমর্থন করত না। তাই বলে আমাদের মতো শিশু কিশোরদের সিনেমা দেখা আটকানো যেত না। পর্দার অপর পারে বসে বহু সিনেমা দেখেছি। অসুবিধা হচ্ছে সব বাম হাত ডান হাত হয়ে যেত। পিছনে বসে অন্য কেউ সিনেমা দেখত না তাই বাড়িতে অভিযোগ পৌঁছাত না। বাগানে দেখা দু-একটা সিনেমার নাম মনে আছে যেমন দো বিঘা জমিন, নাগিন, কিসমত প্রভৃতি। বুধুয়া ছিল আমার সিনেমা দেখার সাথী। সে হারিয়ে যাওয়ার পর বাগানে আর কোন সিনেমা দেখিনি। হঠাৎ করে মালবাজারে গেলে খুঁজতাম বুধুয়াকে। চাকরি পেয়ে প্রথম সুযোগে ডামডিম গিয়ে প্রতিটি সাইকেল সারাবার দোকানে বুধুয়াকে খুঁজেছিলাম। কেউ হদিস দিতে পারেনি। বাড়ি ফিরে মাকে বলেছিলাম ডামডিমে যাওয়ার কথা মা জানতেন বুধুয়ার প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা। মা বলেছিলেন 'দেখিস একদিন তোর আর বুধুয়ার দেখা হবেই'। মা আজ নেই। কিন্তু মায়ের কথা আমি মনে রেখেছি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴