বিসর্জন না নিরঞ্জন?/দেবদত্তা বিশ্বাস
বিসর্জন না নিরঞ্জন?
দেবদত্তা বিশ্বাস
পেরিয়ে এলাম আবারও বাঙালি জীবনের বাৎসরিক শ্রেষ্ঠ সময়। দেবী দুর্গা উমা রূপে বাঙালি হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে পাঁচটা দিন তড়িৎ গতিতে মর্তলোকে আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ ছড়িয়ে এ বছরের মত বিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে। রয়ে গেল ঝরা শিউলি ফুল, উড়ে গেল বাতাসে থোকা থোকা কাশ, আর পেঁজা তুলোর মত মেঘেরা এবারে পাড়ি দেবে দূরের অজানা দেশে। পুজো পুজো ভাবের রেশ কাটতে না কাটতেই ঝুপ করে যখন দশমী চলেই আসে তখন বিসর্জন ঘটে মায়ের জলছবিতে পরিস্ফুট হয় বাঙালি মনের বেদনা। ঘাটে ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জনের ধুমের মাঝে ঢাকের কাঠি বেদনা মধুর সুর তোলে বারে বারে। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় মনে। দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন নাকি নিরঞ্জন হয় ঘাটে ঘাটে?
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় বিসর্জন কথাটি এসেছে 'সৃজ্' ধাতুর সাথে বি- উপসর্গ যোগে। 'সৃজ' অর্থাৎ সৃষ্টি, বি অর্থাৎ বিপরীত বা বিনাশ অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টির বিনাশ। অথচ ঈশ্বর নির্গুণ, নিরাকার। ঈশ্বরের বিনাশ এক অকল্পনীয় চিন্তা। বিপরীত দিকে নিরঞ্জন কথাটির মধ্যে অঞ্জন কথাটি রয়েছে যার অর্থ কাজল ।অর্থাৎ নিরঞ্জন কথাটির অর্থ 'নেই অঞ্জন যার' বা 'কাজল মুছে ফেলা'। দেবী দশভুজা এক সর্বকালীন সত্ত্বা। দেবীর আরাধনা কালে প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা প্রতীকি রূপে দেবীকে মাটির প্রতিমার মধ্যে পঞ্চভৌতিক চক্রে আবদ্ধ করার চেষ্টা করি। আর দশমীতে আমরা নিরঞ্জন করি সেই মাতৃপ্রতিমাকে। অর্থাৎ মায়ের মূর্তরূপ থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিমূর্তের অভিমুখে, তাঁর সর্বকালীন সত্ত্বার মাঝে। চোখের কাজল জলে মুছে দিয়ে।
বিসর্জন এক সমাপ্তিকে ব্যাখ্যা করলেও নিরঞ্জনের ব্যাপকতা অনেক বেশি। দর্শনগত চিন্তায় বিসর্জনের চাইতে নিরঞ্জন শব্দটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। আমরা চাই দেবী বারবার ফিরে আসুক আমাদের মাঝে, অশুভ দমন ও শুভের বিস্তার হোক বারে বারে জগতে। শুভ চেতনায় জাগুক বারে বারে এ মন। আর তাই বিনাশ নয় বরং ঈশ্বর বিস্তার লাভ করুন আমাদের পঞ্চ ভৌতিক শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণুতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴