বিষ্যুদবারের বারবেলা/শুক্লা রায়
বিষ্যুদবারের বারবেলা
শুক্লা রায়
-----------------------------
একেতে বিষ্যুদবার, তায় বারবেলা। মা পই পই করে বলে গেছিল, 'ওরে গোবিন্দ, বিষ্যুদ্বারের বারবেলা কোথাও যাত্রা করবি না, বড্ড অমঙ্গল হয়। গোবিন্দ সে সব শুনেওছে এতদিন। তা এবার আর হল না। মা গেছে মামাবাড়ি। ফিরবে আজকেই। বাপ তো থেকেও নেই। তার যে একটা ছেলে আছে সে খবর জানে কিনা গোবিন্দর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। থাকগে সেসব কথা। কথা হল বিষ্যুদবারের বারবেলা বড্ড মানে গোবিন্দ। কিন্তু ওই যে বলে সবদিন সমান যায় না! কখনো কখনো হঠাৎ ভুল হয়ে যায়। সে কী বুঁচিকে কম ভালোবাসত? বুঁচিকে হারানোটাও তো ওই বিষ্যুদ্বারের বারবেলা। পত্থমদিন দেখা করতে গিয়েছিল, তাড়াহুড়োতে মনে নেই, বের হল ঠিক বারবেলা। মনটা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। তা তখনই বাতিল কর! তা না, আনন্দে, উত্তেজনায় মা'র সাবধানবানী বেমালুম ভুলে গেল? আর তার ফলে শেষে বর না হয়ে বরযাত্রীর আপ্যায়নে কোমর বেঁধে লাগতে হল! তবে ওর সঙ্গে বিয়েটা হল না বলে বুঁচিকেও খুব দুঃখিত মনে হল না। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকেই দেখছে আয়নায় আর মোবাইলে টুকুস টুকুস মেসেজ করছে। গোবিন্দ দেখেছে, ওদিকে বরের হাতেও একখানা মোবাইল ফোন। বরেরও ঘন ঘন মোবাইলে চোখ। দুইয়ে দুইয়ে চার। বুঝতে অসুবিধা হল না। এদিকে গোবিন্দ যে কতবার ওর সামনে দিয়ে এল গেল সে ভ্রুক্ষেপ নেই, মাগো! মনের দুঃখে গোবিন্দ সেদিন একটু বেশিই খেয়ে নিল। তারপর ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছিল একা একা। সে দুঃখ তারও অবশ্য বেশিদিন টেঁকেনি। আকাশে বাতাসে গোবিন্দর হাহাকারটা থিতু হতে না হতেই নতুন করে দুঃখ পেল কল্পনার কাছে। সে যেন নবীন বসন্ত, আহা! সরস্বতী পুজোতে প্রথম শাড়িতে দেখল পাড়ারই খেঁদি কল্পনাকে। কী রূপ! কী রূপ! কবে এত রূপসী হয়ে উঠল খেঁদি? ভাবতে ভাবতে গোবিন্দ তখন এই মরে তো সেই মরে! ভুলে গেল নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। বুঁচির বিয়ের দিন প্রচুর কেঁদেকেটে শপথ নিয়েছিল, চিরকুমার থাকবে, তবু কোনো মেয়েকে আর হৃদয় দান করবে না। ভুলে গেল! বেমালুম ভুলে গেল। এক সরস্বতী পূজা তাকে প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত করল। মা সরস্বতী এ ভারী অন্যায় করেছিল গোবিন্দর প্রতি। বেশ তো ছিল বেচারা চিরকুমার। সব ভুলে টুলে কত ছন্দ মিলিয়ে তখন বলা 'কল্পনা, তুই মনের আল্পনা'। তা সে আল্পনাও থাকল না, কল্পনাও থাকল না। তবে কল্পনা যে ছেলেটার সাথে ভেগে গেল শেষমেশ, তার থেকে গোবিন্দ নিজেকে অনেক বেশি ভালো মনে করে। এটাই মনের শান্ত্বনা। ও চ্যাংড়া আবার চ্যাংড়া নাকি? মুখের যা ছিরি-ছাঁদ, দেখে প্যাঁচাও লজ্জা পাবে। সে কী আর কল্পনা বুঝল! ড্যাং ড্যাং করে ওই ছেলের সঙ্গেই পালাল। গব্বরের মতো চুল, গুটখা খাওয়া লালচে ছোপধরা দাঁত, দেখলেই ঘেন্না লাগে। তবে ছেলের এলেম আছে। হাতে দামী ফোন, গায়ে সুন্দর সেন্ট! কল্পনা তো এই দেখেই পটেছিল। গোবিন্দ ভাবে। অজান্তেই হাতটা মাথায় চলে যায়। একহাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল, অন্যহাতে মাথা চুলকাতে থাকে। মনে মনে ভাবল গোবিন্দ, সব ওই বিষ্যুদবারের বারবেলার জন্য। প্রথম মেসেজ করেছিল সেই বিষ্যুদবারের বারবেলাতেই যে! যতই ভুল বানানে হোক, কল্পনাও আবেগঘন ভাষায় সঙ্গে সঙ্গে তার রিপ্লাই দিয়েছিল। পরে মেসেজগুলো বারবার পড়তে গিয়ে সময় দেখে সেদিনই অজানা আশঙ্কায় গোবিন্দর বুকটা কেঁপে উঠেছিল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে গোবিন্দ প্যাডেলে চাপ দেয়। এতদিন নির্ঘাত তার একটা বিয়ে হয়ে যেত। বুঁচির সঙ্গে না হলেও কল্পনার সঙ্গে শিওর ছিল। কী আর করা! এখন তো প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে বিয়ে করবে না, আর কিছু করার নেই। এবার আর প্রতিজ্ঞা ভাঙবেও না। এখন কোনো মেয়েরই মুখদর্শন করে না গোবিন্দ। খুব শিক্ষা হয়েছে। ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায়! আর কোনো সরস্বতী পুজোয় গোবিন্দ ঘর থেকে বের হয় না।
তা আজ অবশ্য বড় কোনো মহান কাজে যাচ্ছে না। এই মোটে একটু হাট করতেই যাচ্ছে। বড্ড শুঁটকি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। মা আসছে মামাবাড়ি থেকে। মনভোলা মাছের শুঁটকি আর আলু, বেগুন এসব আনবে আর কি। প্যাডেল ঘুরাতে ঘুরাতে গোবিন্দ পুরনো দিনগুলো এখনও ভাবে। রাস্তায় এখন ওর মতোই সাইকেলে অনেক হাটুয়া আগে-পিছে। গোবিন্দ সেসব দেখে না, রাস্তার পাশের ভাটফুল দেখে, পাতাহীন মাদার গাছের গাঢ় লাল ফুল দেখে আর উদাস হয়। জীবনটার কোনো মানে থাকল না।
হাটে খুব বেশি ভিড় নেই। প্রথম গলিটা থেকে মোড় নিয়ে ডাইনে বেঁকে শুঁটকির দোকানগুলোর দিকে যেতেই গোবিন্দর বুকটা নড়ে গেল, মানে স্থানচ্যুত হল বোধহয়। বাঁকটা ঘুরে ভালো করে মুখ তুলে তাকাতেই দেখে একজোড়া ডাগর নয়ন তার দিকেই নির্নিমেষ চেয়ে। কেন? গোবিন্দ কোনো দিশা পেল না। এ আবার কী কান্ড! সার সার শুঁটকির দোকানের পাশে একটাই কাঁচা গুয়া-পানের দোকান। মেয়েটা দোকানী বুড়িটাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে। চোখদুটোতে যেন একটু কৌতুক। বুড়িটাকে ও দুচক্ষে দেখতে পারে না ও। কিন্তু কী করবে! বিষ্যুদবারের বারবেলা বলে কথা! অমঙ্গল না হয়ে যায় কোথায়! জেনেশুনেও তাই ওই দুই চোখের অমোঘ টান কিছুতেই এড়াতে পারল না গোবিন্দ। পতঙ্গের মতো পাখা মেলল। শুঁটকি কেনা মাথায় উঠল। পায়ে পায়ে এগিয়ে, অতএব মায়ের জন্য আগে ভাগা পান-সুপারী কেনাটাই জরুরী হয়ে উঠল। মেয়েটার চোখে মুখে তখন যুদ্ধজয়ের হাসি!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴