সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
06-October,2024 - Sunday ✍️ By- রাজর্ষি দত্ত 260

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু/রাজর্ষি দত্ত

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু
রাজর্ষি দত্ত

বৃদ্ধের ঘন সাদা ভুরুর নিচে ঘোলাটে চোখে জমা হয়েছে ক্রোধ। ব্যাকব্রাশ করা পাতলা চুল, মুখে বলিরেখার ভাঁজ, ঝুলে থাকা ঠোঁট, হাতাওয়ালা স্যাণ্ডো গেঞ্জি, ডান হাতের কনুই অবধি নেমে আসা তাবিচ, গলায় ছোট রুদ্রাক্ষের মালা, বুকের সাদা লোম সহ বিছানায় বসে থাকা লোকটিকে আমি দেখছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে। সকালের রোদ তার বাঁ গাল পিছলে খানিকটা পড়ছে পাশের ব্রিটিশ আমলের ড্রেসিং টেবিলের আবছা কাঁচে। তাতে আরও ঝাপসা লাগছে উল্টোদিকে দেয়ালের সামনে চেয়ারে বসা আমাকে। তিনি বসে আছেন একটি সিঙ্গল খাটে। খাটের চারকোণে মশারীর স্ট্যান্ড লাগানো। দুটি স্ট্যান্ডের সংযোগকারী কাঠে ঝুলছে সোয়েটার, চাদর আর গামছা। কাঠের খাটটিকে বলা যায় মঞ্চ। সেখানে একটা নাটকের দৃশ্য চলছে এখন।      
          এ মুহূর্তে ঘরে কেউ নেই – থাকবার কথা নয় বলেই জানি।
          বৃদ্ধের অপলক তাকিয়ে থাকার মধ্যেই বাইরে কাকের ডাক, সব্জিওয়ালার হাঁক, রাস্তায় ফেলা বালি ও কুচি পাথরের উপর বাইকের চলার আওয়াজ, নালার মধ্যে জল পড়ার শব্দ শোনা গেল। পাশের বাড়িতে কেউ গ্রিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো।
          শিলিগুড়ির ফুলেশ্বরী বাজার থেকে লেভেল ক্রসিং পার করে হেঁটে পূর্বদিকে কিছুটা গেলে বাঁয়ে একটা গলিতে ঢুকতে হয়। সেখানেই এই পুরোণো একতলা বাড়ি। তবে এ বাড়িতে নয়, ওনার থাকা উচিৎ ছিল একটু দূরেই যে জেলখানা আছে, তার ভেতর।
          রাগের মাথায় সেকথা বলেও ফেলেছিলাম, তাতেই বৃদ্ধের এই প্রতিক্রিয়া! উনি হয়তো এসব কথা শুনে অভ্যস্ত নন...অন্ততঃ এই বয়সে। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে নানা বিজাতীয় কুকর্ম তিনি অনেক করেছেন, সেকথা তিনি হয়ত নিজেই ভুলতে চান আজকের আপাত চলনসই জীবনে। তবে অতীত যখন কখনো বেআব্রু হয়, মানুষ তখন হকচকিয়ে অবিশ্বাসী চোখে তাকায়। পুরোণো কৃতকর্ম আজকের নিরিখে মেলাতে পারে না বলেই অপমানটাও গায়ে মেখে বসে।যেমন আজকে!
          সেটা দেখে আমার আরও মাথা গরম হয়ে গেল-“শুনুন, আপনি ছিলেন এ এলাকার একজন মার্কামারা ফ্রড লোক- নইলে আপনাকে খুঁজে পেতাম না। এইরকম জঘন্য কাজ আপনি অনেক করেছেন...অনেক!  আপনার কপাল ভালো যে আপনার ছেলে গোবরে পদ্মফুল।ওর ভালো চাকরির জেরে আপনি আজ ভদ্রলোকের ভেক ধরতে পেরেছেন। কিন্তু আপনার আসল রূপ অন্য...”
          বৃদ্ধের মুখ দিয়ে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ বের হল।
          আমি বললাম “আমার বাবা আপনাকে বিশ্বাস করেছিলেন...” বলতে গিয়ে আমার নিজের গলাই বুজে এল।
          এবার উঠতে হয়! সৌরভ এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ঐ আমাকে এ বাড়ির ঠিকানায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু কালপ্রিট যে উনিই এতে আমারও সন্দেহ ছিল।সামনাসামনি দেখার পর ওনার বাঁ গালের বড় আঁচিলটা...যেটার কথা বাবার কাছে শুনেছি-কিছুটা সিওর হই। আর পুরো ঘটনাটি বলার পর তার নীরব সন্মতি দেখে আর কিছুই বলার নেই।
          আমার বাড়ি মালদায়। সেখানে জব করতাম। মাস দেড়েক আগে ট্র্যান্সফার হয়েছে শিলিগুড়িতে। সৌরভ আমার কলিগ। কথায় কথায় গল্পটা ওকে বলেছিলাম, পাশে থাকা আরও কেউ কেউ শুনে থাকবে। সৌরভের কি চ্যানেল আছে কে জানে! এতবছর আগের একটা ঘটনার সুতো ধরে ও কিন্তু ঠিক ঠিক লোকের কাছেই আমায় নিয়ে এসেছে।

এটা গল্প হলেও সত্যি...আমার বাবার গল্প! তখন আমি পাঁচ বছরের শিশু। তিনি কাজ করতেন চালসার একটি ওয়ার্কশপে। টেকনিক্যাল হেড হিসেবে। ছুটিতে মালদা গেছেন।আমি তখন মায়ের সাথে মামাবাড়িতে ছিলাম। ছুটি শেষে ফেরার দিন আমার ঠাকুরদা পুকুরের মাছ ধরে নিজে ভেজে দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল পরোটা, আচার ও একবাক্স মিষ্টি। আমসত্ত্বের কয়েকটি প্যাকেটও ছিল সহকর্মীদের দাবীতে। ফোল্ড করে বাঁধা বেডিং, পিঠে-কাঁধে ব্যাগ –এই নিয়ে তিনি উঠলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। একটু লেটে ট্রেনটি এনজেপিতে পৌঁছল সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়।
          ব্রড গেজ প্ল্যাটফর্ম থেকে হেঁটে মিটার গেজ প্ল্যাটফর্মে এলে জানা গেল ডুয়ার্সগামী কোন ট্রেনই  এ সময় নেই। পরের ট্রেন কাল সকালে। বিধান মার্কেটের ডুয়ার্স বাসস্ট্যান্ডে গিয়েও কোন লাভ নেই এখন।
          সেটা মোটামুটি প্রত্যাশিত ছিল বলে প্ল্যাটফর্মে বেডিং খুলে বসে পড়লেন। ঐ সময় লম্বা, রোগা, সাদা পাজামা, হাত গোটানো বটল গ্রিন পাঞ্জাবী, বাঁ কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ নিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন একজন -  “নমস্কার, আমরা মনে হয় একই পথের পথিক, কোথায় যাবেন ?”
-“চালসা।আপনি?”  
-“হাসিমারা। আমি কন্ট্রাক্টারির কাজ করি। আপনি জীবনবাবুকে চেনেন? ট্রেড ইউনিয়ন করেন। মধু বাগানের লোক। ওনার একটি কাঠের দোতলা আছে,জয়গাঁর দিকে যে রাস্তাটি চলে গেছে...সেদিকে সামান্য এগিয়ে-ওখানেই আমি ভাড়া থাকি।”
-“নিজের বাড়ি কোথায়?”
-“হাঃ হাঃ, কথার টানে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়...গঙ্গার ওপারে...হুগলির লোক। তবে পেটের দায়ে এখন এদিকেরই হয়ে গেছি।”
          দুজনের আলাপ এভাবেই জমে উঠলো। সেখানে ঢুকে পড়লো ঘিসিং-এর গোর্খাল্যান্ড, মারাদোনার গোল, আজহারউদ্দিনের ‘ব্যাড প্যাচ’...। টিফিন কৌটো খুলে পাঁচটি পরোটা আড়াইটে করে ভাগ করে দুজনে খেল, মাছ ভাজা ও সব্জি সমেত। সময় কাটাবার এমন আমুদে সঙ্গী পেয়ে বাবাও খুব খুশি। সারা রাত আধা ঘুম, গল্পে কাটলো সময়। সঙ্গী লোকটি বার তিনেক উঠে স্টেশনের কফি কিনে খাওয়ালেন, নিজেও খেলেন।
          ভোরের দিকে একবার বোধহয় চোখটা বুজে এসেছিল, ন্যারো গেজ লাইনে টয় ট্রেনের ভেঁপু শুনে আমার বাবা ধড়মড়িয়ে উঠে দেখলেন লোকটি নেই। একটু পরেই অবশ্য তিনি মুখ মুছতে মুছতে এসে পড়লেন, একগাল হাসি নিয়ে। “ফ্রেশ হয়ে এলুম, যান আপনিও চোখ মুখ ধুয়ে আসুন- গরম গরম পুরি ভাঁজছে দেখলুম, ভরপেট খেয়েই প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠবো-রাস্তায় কি জুটবে কে জানে!”   
          টুথপেস্ট, ব্রাশ নিয়ে বাবা গেলেন মুখ ধুতে। মিনিট দশেক পরে এসে দেখলেন সব ফাঁকা। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। প্রথমে মনে হল লোকটি বুঝি অন্য কোথাও জিনিষগুলি সরিয়ে নিয়ে গেছেন – কুলীরা ভ্যানে মালপত্র টেনে নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু সারা প্ল্যাটফর্মে কোথাও উনি নেই। সামান্য দূরেই কজন গেরুয়া কাপড়ের বাবাজী বসেছিলেন-ওরাও প্ল্যাটফর্মে থেকে গতরাত কাটিয়েছে তাদের মত। জিজ্ঞাসা করাতে একজন জানালো-“ও আদমি যো আপকে সাথ মে থা? আপ উধার জানে সে তুরন্ত বিস্তার আউর সামান উঠাকে ছোটা টিরেইন কা বগীমে উঠ গয়া- হাম লোগ সোচা কে আপকা দোস্ত হোগা...” 
          ‘ছোটা টিরেইন’ মানে দার্জিলিংগামী টয় ট্রেনকে দূরে দেখা যাচ্ছে কালো ধোঁয়া উঠিয়ে চলে যেতে। ‘দোস্ত’-কে সঙ্গে নিয়ে। 
          বাবা ধপ করে বসে পড়লেন প্ল্যাটফর্মের উপর। তারপর হুঁশ এলেই ছুটলেন রেল পুলিসের ঘরে। পুলিশ সবকিছু শুনে জানালো ট্রেনটার পরের স্টপেজ ‘শিলিগুড়ি টাউন’। ওরা এখনই খবর দিয়ে দিচ্ছে- চেহারার বর্ণনা অনুযায়ী তেমন কাউকে পেলে আটকে রাখবে-“আপনি জলদি জলদি সেখানেই চলে যান”। 
          ছুটে বেরিয়ে একটা রিক্সা ধরে, অনর্গল তাগাদা দিতে দিতে পৌঁছলেন টাউন ষ্টেশন। সেখানে অ্যাসিস্ট্যান্ট ষ্টেশন মাস্টার থেকে জি.আর.পি. সবাই জানালো -না, সেরকম চেহারার কোন লোককে তারা ট্রেন থেকে নামতে দেখেনি...ট্রেনের ভেতরেও ছিল না। সম্ভবতঃ লোকটি আগেই কোথাও নেমে গেছে। টয় ট্রেন যে গতিতে চলে তাতে সেটা কোন ব্যাপারই না। ট্রেনও  শিলিগুড়ি জংশনের দিকে বেরিয়ে গেছে। 
          এক কাপ চা-ও খেতে ইচ্ছে করছে না। খানিক বাদে 'ঝুক' 'ঝুক' করে আলিপুরদুয়ারগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেন ঢুকলো ষ্টেশনে। বাবা হতবুদ্ধির মত খালি হাতে ট্রেনে উঠে বসলেন। পুরো ঘটনাটা তিনি মেনেই নিতে পারছেন না। সারা রাত একটা লোকের সাথে কাটিয়ে...তখন কিছু হল না...অথচ সকালে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য! কাকে করবেন ভরসা? এভাবে কেউ বিশ্বাসে ঘা দিতে পারে তা যে কল্পনার অতীত! জিনিসপত্র যা গেছে তার জন্য দুঃখ হচ্ছে না, কিন্তু এমন বিশ্বাসভঙ্গতা কি মেনে নেওয়া যায়? সরলতার, নিজের করে ভাবার এই কি প্রতিদান? এসব চিন্তায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে বার বার...চোখ দিয়ে আপনা থেকেই গড়িয়ে পড়ছে জল। বগিতে একদল জওয়ানও উঠেছিল। তারা নিজেদের কথা বন্ধ করে দেখছে একটা অচেনা লোকের কান্না!   
পঁয়ত্রিশ বছর আগের বাবার চোখের জল আজ ঘৃণার তরল আগুনের দৃষ্টিতে বদলে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। 
          উনি আবার ঘড়ঘড়ে স্বরে কিছু বললেন। তারপর দেখি খাট থেকে নেমে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরের কোণে রাখা একটি তোরঙ্গ খুললেন। দু-চারটে পুরনো কাপড় সরিয়ে বার করলেন একটি নীল স্ট্র্যাপ হলুদ সোয়েটার। এখনও রঙটা তত খারাপ হয়নি।
          চিনতে পারলাম! বাবার সাথে আমার ছোটবেলার একটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি আছে। তাতে বাবার গায়ে এই সোয়েটারটাই। যদিও জ্ঞানতঃ কোনদিন তাকে পরতে দেখিনি।      আজ সোয়েটারটা হাতে পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরলাম...সেখানে যেন চলে যাওয়া বাবার গন্ধ জড়িয়ে আছে। 

সেদিন ঠক লোকটিকে বিশ্বাস করে বাবা কিছু হারিয়েছিলেন...কিন্তু আজ আমি আমার চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া বাবাকে যেন পেলাম...খানিকটা হলেও...
.................................................

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri