বারেবারে নিজেকে হারাই/চন্দ্রানী চৌধুরী
বারেবারে নিজেকে হারাই
চন্দ্রানী চৌধুরী
এখনো এ ছাদ আমার, এখনো এ পুকুর পাড়, এ বারান্দা আমার। এখনো এ বাড়ির আসবাব ছুঁয়ে থাকলে কিশোরীবেলা খুঁজে পাই। কারণ এখনো বাবা নামের ছাদ মাথার ওপরে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর দামামা বাজিয়ে যায়। কে জানে কখন এক নিমেষেই সব হারিয়ে ফেলবো। সব থেকেও কোন কিছুকেই আর নিজের বলা যাবে না। আমার শৈশব যৌবনে অজস্র গাছগাছালির মাঝে বেড়ে ওঠা আমার এক বড় প্রাপ্তি। কত কত পাখপাখালির ডানা ঝাপটানোর শব্দে বুকে দোলা লাগত। খাতার পাতায় ঝরে পড়ত আবেগ। প্রতিবার বাড়ি গেলে সেসব জীর্ণ পৃষ্ঠা ছুঁয়ে ফিরে পেতে চাই কৈশোর ঘ্রাণ। এখনো সেসব আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই পায়নি কারণ মা নামের আঁচল আছে এখনো।
ইচ্ছে করে এই অমূল্য সম্পদ নিজের কাছে নিয়ে রাখি। ইচ্ছে হলেই ছুঁয়ে থাকতে পারবো। কিন্তু সত্যি কি আমার নিজস্ব জায়গা বলে কিছু আছে ? সারাজীবন ভবঘুরে হয়ে জীবন কাটিয়ে গেলাম। আজ অবধি এক জায়গায় থিতু হতে পারলাম না। প্রয়োজনের তাগিদে শুধু ছুটে বেড়াচ্ছি জীবনভর । এ সম্পদ কোথায় রাখবো ভেবে পাই না। আমার ঠাকুরদা অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখতেন। সেসব আজও যত্নে রাখা আছে আমাদের বাড়িতে। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কি আমাদের মতো সে আবেগ আছে ? ওদের মন খানিকটা আবেগ আর বেশিরভাগটা যন্ত্রে মুড়ে থাকে । যেখানে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা, নস্টালজিয়া, শেকড়ের টান।
ছোট থেকেই আমাদের বাড়ি নানা রঙের ফুলে ফলে ভরে থাকত। কত ফুলের নামও জানতাম না তখন। মা যত্ন করে নাম দিত সব গাছের। ইট পাথরের দালান বাড়তে বাড়তে মায়ের চোখের জলের সাথে সাথে কত গাছ যে হারাতে হয়েছে তার ঠি ক নেই। বাড়িতে কোন গাছ লাগানো হলে মা এখন আর নামকরণ করেন না। শুধু শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন । হয়তো হারানোর ভয়ে নিজেকে আর ওদের সাথে জড়াতে চায় না। পুকুরের পাড়ে বসে একটানা মাছরাঙা ডাহুকের জলকেলি দেখতে ইচ্ছে করে। এখন আর জলে নেমে তাড়া দিই না। আগে হুস হুস করে ওদের তাড়াতাম। একটা মাছও ওদের ধরতে দিতাম না। শৈশবে মাছেরা ছিল প্রানের সখা। ভাত ছিটিয়ে দিলেই মুখ উঁচু করে টুপ করে খেয়ে যেত। আর কেন যেন মাঝে মাঝেই মাথাটা জল থেকে বের করত। মা বলত তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি কিন্তু তখন সেকথা বিশ্বাসও করতাম। পুকুর পাড়ে আজ আর গিয়ে বসা হয় না। সবসময়ই যেন ব্যস্ততা। ফিরে চলে এলে তখন একরাশ মনখারাপ ঘিরে ধরে। মনেহয় এবার বাড়ি গেলে কত কিছু করব ভেবেছিলাম; কিচ্ছু করা হল না। পরেরবারের জন্য আবার অপেক্ষায় বুক বাঁধি, ইচ্ছেগুলো গুছিয়ে রাখি অন্তরে.....
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴