বাবাইয়ের জন্য/শিঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়
বাবাইয়ের জন্য
শিঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়
পূজনীয় বাবাই,
কত বছর পরে তোমাকে চিঠি লিখছি, তাই না? তুমি যখন অসমে পোস্টেড ছিলে, তখন প্রত্যেক সপ্তাহে তোমাকে চিঠি লিখতাম। শুধু লিখতাম তাই নয়, তোমার চিঠির অপেক্ষাতে ও থাকতাম। মেসেজ, ভিডিও কলিং এগুলো তখন কল্পনাতেও ছিল না। অথচ তোমার লেখা প্রতিটা শব্দে যেন আমি তোমার গলার আওয়াজ, তোমার মুখভঙ্গি সব দেখতে পেতাম। আমার বানান ভুল নিয়ে যখন তুমি লিখতে, আমি যেন শুনতে পেতাম তোমার আওয়াজটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল, তোমার মুখের পেশি একটু বেশি টানটান হয়ে গেল। না, কড়া কথা তুমি কখনও কাউকে বলনি। আমাকে তো নয়ই। কিন্তু কী সুন্দর করে ঠিক, ভুল, উচিত, অনুচিত বুঝিয়ে দিতে। আমার পুতুলের সংসারের বর্ণনা দিয়ে যে আমি তোমাকে চিঠি লিখতাম, সেটা মনোযোগ সহকারে পড়তে এবং ভুল শুধরে দিতে। তোমার ছুটিতে এসে চলে যাবার আগে আমার মন ভীষণ খারাপ হত। তুমি বলতে ঠিক চারটে চিঠি লেখা হবে, তারপরেই আবার তুমি চলে আসবে।
এরপর তুমি চলে এলে, আমি তখন পড়াশুনার জন্য বাইরে। তখন তোমার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হল টেলিফোন। একবার যদি কোনো অসুবিধার কথা জানতে পারতে, হাজার ক্লান্তি, হাজার ব্যস্ততা ফেলে তুমি ঠিক আমার কাছে হাজির।
মনে পড়ে বাবাই, আমাদের রেল কোয়ার্টার? আমাদের পড়ার ঘরেই তোমার একটা ছোট টেবিল। সেখানেই চলত সাহিত্য চর্চা। সবার অসুবিধার সমাধান তুমি করবে, কিন্তু নিজের অসুবিধার কথা কাউকে জানতে দেবে না। তোমার একটা বড় বাক্স ভর্তি ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড আর পেন। ওটা আমার কাছে ভীষণ লোভনীয় ছিল।
এরপরে এল মোবাইল। আমি তখন অন্য বাড়িতে চলে এসেছি। প্রতিদিন সকালে 'বাবাই কলিং' মোবাইলের পর্দায় দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। একদিনের জন্যও এর অন্যথা হয়নি। এখনও কনট্যাক্ট লিস্ট স্ক্রোল করে খানিকক্ষণ 'বাবাই' লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। না, ওই নাম্বার থেকে ভরাট গলায় 'মামণি' ডাকটা আর শুনতে পাই না।
এপ্রিল মাসটা আমার কাছে খুব আনন্দের ছিল। তোমার জন্মদিন এই মাসেই। আরো নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে ভরপুর এই মাস। না কোনোদিন আড়ম্বর করে তোমার জন্মদিন পালন হয়নি। ছোটবেলায় জানতামও না তোমার জন্মদিন কবে। শুধু একবার, আমাদের যখন সম্পূর্ণ পরিবার একসাথে হলাম, সেবার তোমার জন্মদিন পালন হল। অনভ্যস্ত হাতে তুমি কেক কাটলে। কত টুকরো টুকরো স্মৃতি মনের গ্যালারিতে জমা হয়ে আছে।
এরপরে এল সেই দিন। এপ্রিল মাসেই তোমার জন্মদিনের ঠিক তিন দিন পরে সেই অভিশপ্ত দিন, যেদিন মাথার ওপর থেকে স্নেহ, ভরসার ছাতাটা সরিয়ে তুমি চলে গেলে। পাঁচ বছর তোমায় দেখি না, কথা বলি না। না, হয়ত ভুল বললাম, মনে মনে বলি তোমার সাথে কথা। তবে তুমি শুনতে পাও কি না জানি না।
খুব সচেতন হয়ে গেছি জানো? কারণ জানি তো, বাবাই বলে ফোন করলেই তুমি আর আসবে না।
সারাবছর সব কাজে, ব্যাস্ততার মাঝে তোমার কথা মনে পড়লেও এপ্রিল মাস জুড়ে যেন আমি ফিরে যাই শৈশবে, কৈশোরে। আমাদের সেই রেল কোয়ার্টারে, যেখানে দুপুর বেলা তোমার বুকে আমি অনেক গল্প শুনে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি।
প্রণাম নিও বাবাই, যেখানে আছো, ভালো থেকো, আমাদের আগলে রেখো।
ইতি -
তোমার মামণি
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴