বাগানে শ্মশানের স্তব্ধতা/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাগানে শ্মশানের স্তব্ধতা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাগরাকোট চা বাগানের ওপরের আকাশটায় একটা বিরাট সাদা মেঘের ধনুক। দিগন্তের দুই ধারে তার ব্যাপ্তি। নীল ক্যানভাসে সাদা তুলির টান। কোথাও তামাটে বর্ণের মধ্যে এক মহাপ্রলয়ের চালচিত্র। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে আমার পাশে বসা মানুষটি সুদূর আমেদাবাদ থেকে আগত একজন প্রবীণ গান্ধীবাদী মানুষ। মানুষকে নিয়েই তাঁর যত গবেষণা। মানুষের জন্য তিনি প্রতি দিনই পথ হাঁটেন। দুয়ারে দুয়ারে তিনি পৌঁছে দেন সহায়তা। দুই হাতে মানুষের সেবা করেন। মাঝে মাঝেই বলেন, " ইনসান বিনা ইয়ে দুনিয়া কিসি কাম কা নেহি।" দু'হাজার তিন সাল থেকে তিনি ডাইরির পাতায় লিখে রেখেছেন "দলগাঁও" এই শব্দটা। কি কারণে তার এই ডুয়ার্সে আসা তার অর্ধেক কারণই আমার অজানা।
আমরা তোতাপাড়ায় এসে পৌঁছলাম তখন দুপুর দুটো। খাওয়া দাওয়া বলতে রুটি আর নিরামিষ ডাল। সংকোচের সাথে একটা গোটা কাঁচা পেঁয়াজ খেয়ে ফেললাম। উনি মশলা চা, দুধ চা পছন্দ করেন এটাই আমার কাছে একটা বড়ো সুখবর। গতকাল কুর্তি নদীর পাড়ে কুর্তি গেষ্ট হাউসে রাত কাটিয়েছিলাম। সারা রাত নদীর জলের শব্দ শুনলাম। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে পড়ছে বলতে পারব না। কিন্তু আটষট্টির বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসের সব ছবি স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে থাকলো।
কুর্তি গেষ্ট হাউসের রুম এটেন্ডেন্ট রফিক জানিয়েছিল সম্প্রতি তোতাপাড়ায় একই পরিবারের দুই ভাই হাতির হানায় প্রাণ হারায়। সেই সংবাদের জেরে ব্যাথিত হৃদয়ে এখন আমরা তোতাপাড়ায়।
ফ্রাইপ্যানে গরম তেলের মধ্যে ফাটানো ডিম ঢালতে ঢালতে এক হাত ঘোমটা টানা মহিলাটি বলল, "হাতির কি দুস, অদের অত রাইতে বাইকে আসার কি দরকার ছিল। " এটাই বোধহয় সমাজের নিয়ম, গোটা তোতাপাড়া, সারা জেলার মানুষ যখন শোক স্তব্ধ, তখন কেউ একজন উল্টো পথে হেঁটে আত্মসমীক্ষার মধ্যে দিয়ে ঘটনার ময়নাতদন্ত করছেন।
আমরা বানারহাট, বিন্নাগুড়ি ছাড়িয়ে দলগাঁও চা বাগানের উদ্দেশ্যে চলেছি। পথের দুই ধারে স্বর্গছেঁড়া চা এর বাগান। এই এলাকায় আসলে কবি সনৎ চট্টোপাধ্যায়ের কথা খুব মনে পড়ে। আউড়ে নিই তার দু একটা কবিতার লাইন। শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এই প্রিয় কবি। শেষ জীবনে তিনি কবিতার লাইন মুখে বলতেন আর বৌদি তা ডাইরির পাতায় লিখে রাখতেন। আজকের মূল্যবোধহীনতার দিনে কে পড়বে তার লেখা সেই সব কবিতা। রাস্তায় মাঝে মাঝে কিছু মানুষের ঐশ্বর্যের নিশানা সরূপ বড়ো বড়ো অট্টালিকা। বাড়ি আছে, একছাদের নিচে স্ত্রী, পুত্র, পরিবার আছে। কিন্তু সবটাই যেন নিস্প্রাণ শ্মশানপুরী। ট্রাফিক সার্জেন থেকে বাবা, মা, মন্ত্রী, আমলা কেরানি থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, সবাই মোবাইলের সাথে কথা বলে চলেছেন।
দলগাঁও চা বাগানের ঢেউ খেলানো একটা উঁচু টিলার পাশে এক দীর্ঘ দেহী যুবক দাঁড়িয়ে আছে। জানলাম তার নাম শুভজিৎ লোহার। শুভজিৎ আমাদের বাগান ঘুরিয়ে দেখাল। জানাল এক চা শ্রমিক নেতার লোভ দূর্নীতির করুন কাহিনি আর তার পরিণতি।
একদিন এইখানেই ১৯ জন চা শ্রমিক এবং বাগান কর্মী নিহত হয়েছিল এই শতকের গোড়ার দিকে। আজও সেই স্তব্ধতার আঁচ পেলাম। একদিন এক শ্রমিক নেতার কোয়ার্টার থেকে গুলি চলেছিল। বীরপাড়ার অদূরেই এই দলগাঁও চা বাগানে। শ্রমিক নেতা শ্রমিক কে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনা চায়ের ইতিহাসে বিরল। শ্রমিক নেতার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কুকুরের মুখে মানুষের মৃতদেহের পায়ের ছবি আজও দগদগে ঘাঁয়ের মতো মানুষের মনে রয়ে গিয়েছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴