বাকলহীন/অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
বাকলহীন
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
..........................
যে আলপথ ধরে উদাস গতিতে রেলসেতু পার হয়ে নেওড়া জঙ্গলের ভেতর একটা ট্রেনের প্রত্যহ ভোকাট্টা হওয়ার নিয়তি, ঠিক সেই রেলপথ ধরে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরাও এসে পড়েছি বিশাল এক জঙ্গলের অঢেল সবুজআনায়। অগুনতি গাছগাছালি এখানে দু-হাত বাড়িয়ে কোল পেতে থাকে, প্রাণের পরশ বুকে ধরবে বলে। সময় সেখানে ফিসফিসিয়ে কথা বলে, তাও আবার একেবারেই নিজের মর্জিমাফিক। আমাদের দলে রয়েছি আমরা পুরনো বন্ধুরা; জঙ্গলে ঢুকেই নিজেদের মতো যারা ছড়িয়ে পড়েছি ইতস্তত এদিক-ওদিক। বিরাটাকার সব গাছের মাঝে আমাদের তখন নিতান্তই বীরুৎ-অবস্হান।
একটু এগোতেই চোখে পড়ল ঘন জঙ্গলের ভেতর বিরাট এক অশ্বত্থ গাছ, ডালপালা ছড়িয়ে তার বিশালতা নিশ্চিত জানান দেয়, এ তল্লাটে অধীশ্বর তিনিই। কাষ্ঠল সুঠাম কান্ডে বয়সের প্রজ্ঞা আর সহস্র সবুজ পাতায় বাতাসের আনাগোনা দেখে নতজানু হতে চায় মন। নিজেকে মনেহয় ঠিক যেন বিশাল জটাধারী এক ঋষির সামনে ছাপোষা গৃহস্থ কোন। তার শাখায় শাখায় অজস্র পাখি সমবেত কিচিরমিচিরে পরস্পরকে কুশল জানায় না-মানুষি উপচে পড়া রীতিতে। মনোযোগী দর্শক সে আখ্যানে নিজেকে মিলিয়ে দেয় বৃক্ষরাজের আকাশ ছোঁয়া ব্যাপ্তিতে। এ গাছের শিরায় হাত রাখলে নিজের ক্ষুদ্রতাগুলো বিসর্জনের দিশা খোঁজে। ব্যক্তিগত দুঃখ, কষ্টগুলো অর্বাচীনতায় মুখ লুকিয়ে নির্ভার হতে চায় নিঃসঙ্কোচে। সবাইকে আগলে রাখার শিক্ষা, সবার আশ্রয় হওয়ার আনন্দ নিমেষে সংক্রামিত হয় সেই অনুসঙ্গে। আমি স্বার্থপর দ্বিপদী সেসবের পুরোটা ধারন করতে পারব এমন কথা ছিল আর কই! কিছু পাওয়ার যোগ্য হতে হলে উপযুক্ত আধারও হতে হয় যে! বুঝতে পারছিলাম, অহং-সর্বস্ব আমার জটিল মন কোন এক জাদুবলে নত মাথায় একাত্ম হতে চাইছে শতাব্দী প্রাচীন এক মহীরূহের নিরুচ্চার মিথোজীবিতায়। আমার শ্বাসবায়ুর আলতো পরশ ছুঁয়ে যায় মাটিতে ছড়ানো তার সর্পিল মূলসমূহে। সেই মূলরাজির কোটর এড়িয়ে আমি সাবধানে মাটিতে পা রাখার চেষ্টা করি। এই অশ্বত্থেরই সীমাহীন আশ্রয়ে হয়ত সেখানে বড় নিশ্চিতে শীতঘুমে আছে অন্য এক প্রাচীন প্রাণ। খোলস ছাড়ার প্রয়োজনীয়তা শিখিয়ে যায় সেও তার জীবনবৃত্তান্তে।
স্পন্দনের মাত্রা গভীরতা ছুঁলে শব্দের অনুচ্চার বিস্তার ঘটে কথার গা বেয়ে। জঙ্গলের পারিপার্শ্বিকতা যে পটভূমি তৈরি করে তার দৃশ্যান্তরে শব্দেরা জন্ম নেয় অজান্তেই। তখন কথোপকথনের ভাষ্য হাওয়ার দোসর হতে চায় এভাবেও,
-কী চাও এখানে?
-নিভৃতি।
-কীসের বিনিময়ে?
-ক্ষুদ্রতা।
-মুক্তি চাইছ?
-না, ত্যাগ।
-হেতু?
-জীবনকে আঁকড়ে ধরতে নেই।
-সংসার?
-অভ্যেস।
-জীবন?
-ফানুস।
-পালাচ্ছ?
-পাল্টাচ্ছি।
-প্রস্তুত?
-আগল চাইছি।
হঠাৎ কার ডাকে হুঁশ ফিরে আসে, শুনলাম দূর থেকে জোর গলায় বন্ধুরা হেঁকে যাচ্ছে। 'কী করছিস ওখানে? একা একা কার সঙ্গে কথা বলছিস? সন্ধে হয়ে এল, ফিরে আয়।' সম্বিত ফিরতে দেখি সাঁঝের আকাশে দলাপাকা মেঘ কুন্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠছে সমানে।কিছুক্ষণের মধ্যেই তা যেন এক অশ্বত্থ গাছের আকার নিয়ে জঙ্গলের মাথা ছুঁয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল। আমি শ্লথ গতিতে পা বাড়াই রিসর্টের আয়েশি নিরাপত্তায়। রূপোলি আলোর বিচ্ছুরণে সে অন্য আরেক পলকা জীবন। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সীমানা এড়িয়ে যাকে অহরহ বলা যায়- 'আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে?'
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴