সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
18-February,2024 - Sunday ✍️ By- কবিতা বণিক 464

বাংলার মিষ্টি কথা ও শিল্প গাঁথা কাহিনী/কবিতা বণিক

বাংলার  মিষ্টি কথা  ও শিল্প গাঁথা কাহিনী
কবিতা বণিক


গঙ্গা নদীর  তীর ধরে  বাংলার  কিছু বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে। সেসব শহরে শিল্প সংস্কৃতির পাশাপাশি  ব্যবসা বাণিজ্যও খুব উন্নতি করেছে। পাহাড়ি অঞ্চলের সিল্ক রুটেও  ব্যবসা করত  বাঙালিরা। কালের গতির পরিবর্তনে  অনেক শহর , বন্দরের  পরিবর্তন হয়েছে। অনেক নদী গতিপথ পরিবর্তন করেছে, কিছু নদী লুপ্তপ্রায় হয়েছে। পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে বাংলারও নানান  দিকে পরিবর্তন এসেছে।  তাহলেও  বাংলার  শিল্প কলা  প্রতি হৃদয়ে, প্রতি পদক্ষেপে।বাংলার মেয়ে বউদের  সারা উঠোন জুড়ে আলপনা বড় চিত্তাকর্ষক। খাদ্য রসিক বাঙালির গয়না বড়ি গুণে, মানে, সৌন্দর্যে  ও শিল্পকলায়  অভিনবত্বের দাবী করে। বাংলার মিষ্টি  তৈরির কলা কৌশলও যুগে যুগে প্রায় সকলেরই মন কেড়েছে। বাংলার নানান কুটির শিল্পও  আজও দেশে বিদেশে সমাদৃত। রসনা দিয়ে শুরু করলে কথায় আছে রসে বসে বাঙালি। প্রাচীন যুগ থেকে ভোজ বাড়িতে বাঙালির মধ্যমণি  আজও সুগন্ধি ভাত,  ঘি , পোলাও এর  রকমফের হলেও সেটাই রয়ে গেছে। নানান মাছের পদ, মাংসের রকমারি পদ আজও নানান ভাবে পরিবেশিত হয়।  নানান ধরণের অম্বল হত । মিষ্টির মধ্যে পায়েস, নানান পিঠে, দই, রসসিক্ত নানান বড়া, সন্দেশ, বোঁদে এগুলিই  প্রধান ছিল।  কর্পুর মেশানো জল থাকত অবশ্যই। আজকাল মিনারেল ওয়াটার থাকে। কস্তুরী ও কর্পুর দেওয়া পান থাকত।  এখনও পানের নানান বাহার থাকে। ভোজবাড়িতে  তখন অবস্থাপন্ন মানুষেরা যেখানকার যে মিষ্টি বা দই ভাল তা  সেখানকার কারিগরদের আনিয়ে ভিয়েন বসাতেন যা এখনও চলে আসছে।  সপ্তদশ শতক থেকে হুগলির সাদা বোঁদে  সুপ্রসিদ্ধ।  কয়েকটি জায়গার সন্দেশ  আজও খুব প্রসিদ্ধ যেমন বেলিয়াতোড়ের  মেচা সন্দেশ ৩০০ বছরের সুপ্রসিদ্ধ  সন্দেশ।  গুপ্তিপাড়ার  গুপো সন্দেশ, কালনার মাখা সন্দেশ , চন্দননগরের  সূর্য মোদকের হাতে তৈরি জলভার সন্দেশ ইত্যাদি। জনাই এর ২০০ বছরের  প্রাচীন মিষ্টি মনোহরা আজও তেমনি সকলের মনোহরনকারি মিষ্টি। বর্ধমানের মিহিদানা, সীতাভোগ খুবই প্রসিদ্ধ। বহরমপুরের লালবাগের নিমাই মণ্ডলের ছানাবড়া  সুপ্রসিদ্ধ  মিষ্টি। মালদহের রসকদম্ব, কদম ফুলের মত দেখতে,ভেতরে রসালো।  পশ্চিম মেদিনীপুর  এর ক্ষীরপাইএর  ‘বাবরসা ‘  - ময়দা , ঘি , দুধ দিয়ে তৈরি তাতে মধু দেওয়া। পুরুলিয়ার রাজার আদেশে তৈরি হয়েছিল  কাস্তার লাড্ডু, বিষ্ণুপুরের মতিচূড়ের লাড্ডু, নবদ্বীপের  ও বগুড়ার ক্ষীরদই গুণে মানে সেরা।  ঢাকার বাকরখানি, মুক্তাগাছার ছানার মণ্ডা,  রাজশাহীর বালুসাই মিষ্টি আজও সমান প্রসিদ্ধ। কাটোয়ার  অগ্রদ্বীপের  ছানার জিলিপি, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া, সিউড়ির মোরব্বা, উত্তরবঙ্গের - ফুলবাড়ির পান্তুয়া, বেলাকোপার চমচম, শিলিগুড়ির  ক্ষীরের সিঙারা  খুব জনপ্রিয়। বর্ধমানের  শক্তিগড়ের ল্যাংচা জনপ্রিয়  মজাদার মিষ্টি। ময়রা লেংচে হাঁটত বলে মিষ্টির  এমন নামকরণ। এমনি আরেক মিষ্টি হল ভীমনাগের লেডিকেনি। গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং এর স্ত্রীর জন্য  ভীমনাগ এই মিষ্টি বানিয়েছিলেন , তাই মিষ্টির এমন নামকরণ।  দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরের মোয়ার খুব খ্যাতি। মুখে দিলে গলে যায়। কনকচূড় ধানের সুগন্ধি খই, খেজুরগুড়, ঘি , ক্ষীর দিয়ে  তৈরি  এই মোয়া। শ্রী চৈতন্যদেব এই মিষ্টির খুব প্রসংশা করেছিলেন। হুগলির রাবড়ি গ্রামে  একশোটি পরিবার রাবড়ি তৈরির সাথে যুক্ত। তাই গ্রামের নাম রাবড়ি গ্রাম।  এখান থেকে রাবড়ি, কলকাতা  সহ  অন্যান্য অনেক জায়গায় সরবরাহ করা হয়।  বাংলায় রসগোল্লা, পান্তুয়া তৈরির আগে থেকেই  মানকরের শুকনো মিষ্টি  কদমা, বাতাসার খুব প্রচলন ছিল।বাড়িতে অতিথি এলে  জল বাতাসা  অতি অবশ্যই দিতে হত। এছাড়া  মুড়ি বাতাসা  সহজ উপায়ে চটজলদি  একটা খাওয়ার  চল আছে এখনও।  বাঙালিরা উৎসব প্রিয় । বারো মাসে তেরো পার্বণ ছাড়াও তাদের উৎসব লেগেই থাকে।
                   হাতে ভাজা মুড়ি বাংলার এক শিল্প। এই মুড়িকে  ঘিরে বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়া গ্রামের  দারকেশ্বর নদীর তীরে মাঘ মাসের  ১  তারিখ থেকে ৪ তারিখ  পর্যন্ত  মুড়ির মেলা বসে।  নানান ভাবে মুখোরোচক মুড়ি মাখা  খাওয়া হয়। মুড়ি কিনে নিয়ে যায় মানুষেরা। মুড়ির মোয়া খুব জনপ্রিয়। 
                    বাংলায় শীতের আর  এক মজাদার রসালো খাবার খেজুরের রস এবং তা থেকে খেজুরের গুড়।  শীতকালে গাছিরা খেজুর গাছে আগের দিন বিকেলে  গাছে  হাঁড়ি বেঁধে  রাখে। পরদিন সকালে হাঁড়ি রসে ভরে যায় । সেই হাঁড়ি  নামিয়ে শীতের সকালে পানীয় হিসেবে বিক্রি করে। পরে সেই রস জ্বাল দিয়ে  সুমিষ্ট  খেজুড়ের গুড় তৈরি হয়। এই গুড় থেকে  নানান পায়েস, পিঠে তৈরি  হয় বাংলার ঘরে ঘরে। পৌষ পার্বণ উৎসবে চলে নানান মজাদার লোভনীয় পিঠে খাওয়া।
                      মাছে ভাতে বাঙালি। এটা প্রবাদ বাক্য। বাঙালির পাতে মাছ থাকবেই। সেই কারণেই হয়ত  হুগলির আদি সপ্তগ্রামে  ১লা  মাঘ  মাছের মেলা বসে।  ২৫০ বছরের এই মেলায় নানান রকম মাছের আমদানি হয়। মাছ যেমন কিনে নিয়ে যায় মানুষ তেমন পিকনিক ও করে। 
                     শিল্প  ও  সংস্কৃতির পীঠস্থান  বাংলার লোকসংগীত বাউল গান। এই বাউল সম্প্রদায়ের শিল্পীদের  নিয়ে বীরভূমের কেন্দুলি শহরে অজয় নদীর  তীরে  বসে জয়দেব কেন্দুলি মেলা।  গীত গোবিন্দ রচয়িতা কবি জয়দেবের জন্মস্থান  এই কেন্দুলি গ্রামেই। মকর সংক্রান্তির দিনে এই অজয় নদীতেই স্বয়ং মা গঙ্গা  আবির্ভূতা  হয়ে জয়দেবের ইচ্ছাকে রূপ দিতে বলেছিলেন  মা গঙ্গা প্রতি বছর মকর সংক্রান্তিতে  এই অজয় নদীতেই আবিভূতা হবেন। সেই থেকেই মেলার সুত্রপাত। আধ্যাত্মিকতা, সংগীত ও আনন্দ এই  মেলার বিশেষত্ব। ২০১৯ সালে ইউনেস্কো  এই  জয়দেব কেন্দুলি মেলাকে হেরিটেজ ঘোষণা  করে। 
                    ৫০০ শত বছরের পুরোন ভক্তিমূলক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হয় গৌরের  ৬ দিন ব্যাপী রামকেলির মেলা।শ্রী চৈতন্যের আগমনে হয় এই মেলার  সুত্রপাত।
                     কোচবিহার রাজাদের  প্রধান উৎসব , মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গনে রাস উৎসব। ১মাস ব্যাপী চলে এই উৎসব। দেশ বিদেশের অনেক  প্রখ্যাত আঞ্চলিক গানের শিল্পীরা এখানে অনু্ষ্ঠান করেন। নানান জায়গার  নানান হস্তশিল্পের  জিনিস কেনার সুযোগ পাওয়া যায়। 
                      বাংলার তথা ভারতবর্ষের গৌরব  বিশ্বের কবি নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  নানান হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, লোক সংগীতের ওপর জোর দিয়ে   শুরু করেন পৌষ মেলা। আজও সমান আকর্ষনীয় এই মেলা।
                      গঙ্গাসাগর মেলা  বসে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে  গঙ্গানদীর সাগর সঙ্গমে। ভারতবর্ষের নানান জায়গা থেকে গৃহী ও সন্ন্যাসীরা এই মেলায় আসে।  লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয় এই মেলায়। পুরাণের গল্প অনুসারে গঙ্গানদীর মহত্ব স্মরণ করে  আধ্যাত্মিকতায় পুষ্ট এই মেলা বসে। প্রবাদ বাক্য আছে  সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার। তাই প্রতি বছর লোকের ভিড় বাড়ে। 
                      বাংলার আরও এক গর্ব হল এশিয়ার বৃহত্তম  আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা।  কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, গীতিকার, পাঠক, পাঠিকা মিলে ২০ লক্ষ লোকের উপস্হিতি হয় এই মেলায়। 
                      বাংলার এক  অভিনব  কুটির শিল্প কাঁথা শিল্প। বাংলার ঘরে ঘরে সম্পূর্ণ হাতে  তৈরি করা হয় বাংলার ছেলে মেয়েদের শাড়ি, কুর্তি, পাঞ্জাবি,  উত্তরীয়, গায়ের চাদরে , বিছানার চাদরে ইত্যাদিতে। এর  পীঠস্থান হল ঢাকা, যশোর, রাজশাহী, পাবনা,বীরভূম,নদীয়া, মুর্শিদাবাদ  ইত্যাদি। আমরা বাংলার কবি জসীমউদ্দিনের  কবিতা  নকশীকাঁথার  মাঠ পড়েছি। মা, ঠাকুরমা, দিদিমারা কাঁথা সেলাই করত শীতে গায় ঢাকা নেবার জন্য।  কাঁথা, পুরোন নরম কাপড়ের কয়েকটি পরত কে জোডা দিয়ে সূচ সুতোর  সাহায্যে  সেলাই করে গ্রাম বাংলার  প্রকৃতি ও প্রতিদিনের জীবনচর্চা ছবির মত ফুটিয়ে তুলত।  অপূর্ব কাজের নিদর্শনের জন্য কোন গ্রামের নাম আছে সুই গ্রাম, নকশীকাঁথা গ্রাম ইত্যাদি। সে রকম আজকাল খুব কমই দেখা যায়। দঃ চব্বিশ পরগণার  সোনারপুর  নিবাসি  প্রীতিকণা গোস্বামী  ২৬ শে জানুয়ারি ২০২৩ শে তার অপূর্ব সূচসুতোর  এমনই সব কাজের জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন। বাংলার এই কাঁথা শিল্পের কদর পৃথিবী জুড়েই। বিদেশে প্রচুর রপ্তানি হয় কাঁথা কাজের  ব্যবহারের নানান সম্ভার। 
                          বাংলার  আর এক কুটির শিল্প তাঁত শিল্পকে বিশ্বের বাজারে উচ্চমানে  পৌঁছে দেওয়ার জন্য  ফুলিয়ার তাঁত শিল্পী  বীরেন কুমার বসাক  ২০২১ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান । এর আগে রাস্ট্রপতি সম্মান ও লাভ করেছিলেন তিনি।  বাংলা রামায়ণ রচয়িতা কবি কৃত্তিবাস ওঝার  জন্ম এই ফুলিয়া গ্রামে ভাগীরথীর তীরে। বাংলার তাঁত শিল্পের পীঠস্হান ফুলিয়া। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের  এলাকায় প্রায় সব ঘরেই তাঁত শিল্পী। এই তাঁত শিল্পীরা  বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন  বালুচরী ও স্বর্ণচরী শাড়ি শিল্পের  মাধ্যমে। এই শাড়ি বয়ন শৈলীতে  জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত বাংলার প্রসিদ্ধ শাড়ি। নানান  পৌরাণিক কাহিনী র গল্প গাঁথা  ফুটিয়ে তোলা  হয় রেশম সুতো দিয়ে বালুচরী শাড়িতে।  বাংলার টাঙ্গাইলের  তাঁতের শাড়িও  খুব প্রসিদ্ধ।  চন্দন নগরের ফরাস ডাঙার মিহি সুতোর ধুতি খুব প্রসিদ্ধ। 
                  মসলিন তৈরির জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল ঢাকা, সোনার গাঁ, বাজিতপুর, ধামরাই প্রভৃতি।  পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোকেরা আসত  বাংলার মসলিন কিনতে। এই মসলিন তৈরী করতে  উপযুক্ত আবহাওয়া ছিল  ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী, শীতলক্ষ্যার নদী পাড়ের আর্দ্র আবহাওয়া।  এই আবহাওয়া জামদানি শাড়ির জন্যও খুব উপযোগী। জামদানি এক ঐতিহ্য  নকশা পদ্ধতি।জামদানি নকশায়  কয়েকজন পারদর্শী কারিগরের প্রয়োজন হয়। এক এক জন এক এক ধরনের  কাজে দক্ষ। কেউ নকশায়, কেউ বুটি তোলায়  এমন অনেক ধরণের কারিগরেরা মিলে একটা জামদানি শাড়ি তৈরি করেন। বাংলার মেয়েদের খুব প্রিয় এই জামদানি শাড়ি বিশ্বের বাজারেও  খুবই সমাদৃত। 
               বাংলার শাঁখা শিল্প , পোড়ামাটির টেরাকোটার শিল্প, শীতলপাটি, মাটির প্রতিমা তৈরি বিশ্ববন্দিত  এই সব শিল্পকলা।  এই সবের মধ্যে যে কোন একটা  শিল্পকলার একটা অংশ পৃথিবীর যে কোন জায়গায় থাকলেও  তা বাংলাকেই স্মরণ করিয়ে দেবে। এখানেই বাঙালিয়ানা।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri