বদলে গেছে বাঙালির রঙের উৎসব/শঙ্খনাদ আচার্য
বদলে গেছে বাঙালির রঙের উৎসব
শঙ্খনাদ আচার্য
-------------------------------------------
পাতা ঝরা রুক্ষ দুপুরে বয়ে আসা সদ্য ফোঁটা আম্র মঞ্জুরীর সুতীব্র ঘ্রাণ, ঘোলাটে রোদের সাথে কুহুতানের অনুরাগ, বাতাসে ধূলিকণার প্রাণোচ্ছলতা, সকাল-সাঁঝে শিমূল-পলাশ-কাঞ্চনের সাথে দিগন্তের আকাশের রং মিলান্তি, জানান দিচ্ছে আমাদের ঋতুচক্রের অবসান আগতপ্রায়। সর্বশেষ ঋতু বসন্তের আগমন মানেই আসমুদ্র হিমাচলের মেতে ওঠা রঙের উৎসবে, যা কিনা আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসবও বটে! এই উৎসব আমাদের কাছে হোলি বা দোল উৎসব কিংবা বসন্ত উৎসব নামেও পরিচিত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রঙের বাহারে পরস্পর পরস্পরকে রাঙিয়ে তোলার উৎসব এই হোলি বা দোল।
ভারতের অন্যতম প্রাচীন উৎসব হলো দোল বা হোলি। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েকশো বছর পূর্বে থেকে এই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্ট জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে পাথরে খোদাই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় পবিত্র গ্রন্থ বেদে। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও জৈমিনি মীমাংসা-তেও রঙের এই উৎসবের বিবরণ রয়েছে। স্কন্দপুরাণের একটি অধ্যায়ে দোলযাত্রার কথা বলা হয়েছে। পুষ্যভূতি বংশীয় শাসক হর্ষবর্ধনের লেখা একটি সংস্কৃত নাটক 'রত্নাবলী'-তেও হোলিকাৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বাংলায় দোল উৎসবের জন্য আমরা অনেকটাই ঋণী মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের কাছে। প্রায় পাঁচশো বছর আগে এই দেশে তিনি অসংখ্য সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো দোল। শ্রীচৈতন্য বৃন্দাবনে গিয়ে হোলিখেলা দেখে এসেছিলেন। তাই দেখে তিনি বাংলাতেও দোলযাত্রার সূচনা করেছিলেন।
কালের পরিবর্তনে ও 'আধুনিকতা' নামক এক সর্বগ্ৰাসী দানবের কবলে পড়ে আজ অনেকটাই বদল এসেছে বাঙালির উৎসবের আনন্দে এবং আঙ্গিকে। দোল বা হোলি যাই বলি না কেন উৎসবটির ধরনও বেশ অনেকটাই পাল্টে গেছে। তার মুখ্য কারণ মানুষ আজ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক। আগের দিনের মতো এখন আর চেনা কিংবা অচেনা মানুষগুলোকে স্বাচ্ছন্দ্যে রং দেওয়া যায় না। কপালে শুধু একখানা আবিরের টিপ, তাতেই নাকি পূর্ণতা পায় রঙের উৎসব। বদল এসেছে হোলির পোশাকেও। আগের মত আজ আর ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা পুরনো হয়ে যাওয়া জামা-কাপড় আলমারির তাক থেকে হোলির দিন বের হয় না। বরং ঝাঁ চকচকে জামা কাপড় পড়ে তার সাথে মানানসই রং গালে কপালে মাখাই নাকি হালের ফ্যাশন! আর এসবের কৃতিত্ব কিন্তু নিঃসন্দেহে সোস্যাল মিডিয়ার। কারণ এখন দোলের মূল আকর্ষণই হলো নানা রঙে সুসজ্জিত হয়ে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা। এটাই হলো এখনকার ট্রেন্ড। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পান ও ভূরিভোজন। এদিন দেশি-বিদেশি নানান স্বাদের বাহারি আহারে মজে বাঙালির মন। বসন্ত উৎসবের বর্ণিল আভাও এখন শান্তিনিকেতনের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার দূরদূরান্তে। একেবারে হালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের দ্বারা হোলির দিন আয়োজিত উদ্দাম 'রেন পার্টি' বা 'পুল পার্টি', সঙ্গে দোসর ডিজে ও হৈ-হুল্লোড়।
"খেলবো হোলি রং দেব না তাই কখনো হয়!" - এই গানের কথা ধরেই এবার আসা যাক এই উৎসবের কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ রঙের কথায়। ভেষজ আবিরই বর্তমানে হোলির মূল উপাদান। কেমিক্যালযুক্ত রং এখন প্রায় ব্রাত্য। আগেকার দিনের গোলাপি আবির আজ বড্ড ফিকে হয়ে গেছে। তার বদলে বাজারের দখল নিয়েছে লাল,,হলুদ সবুজ, কিংবা গেরুয়া আবির। এর কারণটা অবশ্য সহজেই অনুমেয়। কোথাও আবার রং-এর চাইতে রং-বাজিটাই বেশি চোখে পড়ে। যাইহোক রঙের উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে বাঙালি যদি একটা দিন নির্ভেজাল আনন্দে কাটাতে পারে তাতে মন্দ কি!
তথ্য ঋণ - দোল উৎসবের ইতিবৃত্ত, পুরানো কলকাতার দোল বিলাস এবং নবদ্বীপের দোল উৎসব - রানা চক্রবর্তী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴