সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
28-January,2024 - Sunday ✍️ By- সুকান্ত নাহা 348

বড় চাপ হে/সুকান্ত নাহা

।। বড় চাপ হে ।। 
     সুকান্ত নাহা
****************

এই যুগের প্রিয়তম শব্দ বোধহয় ' চাপ ' । শব্দটি প্রায় অ্যান্টিসেপটিকের মতো। কাটা, ছেঁড়া, ফাটা, পোড়া সব ঘায়ে যেমন অ্যান্টিসেপটিক তেমনি যে কোনও ব্যাপারে সামান্য বেকায়দায় পড়লেই মানুষ এখন " চাপ" এ পড়ে যায়। সদা ব্যস্ত চাকুরে, ব্যবসায়ী, হকার, বেকার, ছাত্র, মালদার পার্টি টু ফেকলু পার্টি, রাজনৈতিক নেতা টু অভিনেতা, ভিখারি, কাজের মাসি, ডাক্তার, মোক্তার,শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, পুলিশ চতুর্দিকে সবাই সর্বদা ভীষণ "চাপ" এ আছে। চাপ কথাটা এখন সবার মুখে মুখে। সেদিন ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি। আছি তো আছিই। থাকতে থাকতে তলিয়ে গেছিলাম নির্ঘাত কোনও চিন্তায়।আজকের ভাষায় সেটা "চাপ" হলেও হতে পারে। তা কখন যে লাল থেকে সবুজ হয়ে গেছে টের পাইনি। পেছন থেকে অটো ওয়ালার তীব্র হর্ণ সহ তির্যক মন্তব্য, " দাদা, ভাবনা চিন্তা বাড়ি গিয়া কৈরেন...বেশি চাপ নিয়া ফ্যালসেন মনে হয়।" তড়িঘড়ি অ্যাক্সিলারেটরে চাপ বাড়াই আর মনে মনে ভাবি," লোকটা ড্রাইভার না থট রিডার। ব্যাটা অন্তর্যামী। "


কিছু করার নেই। "চাপ" শব্দটাই এখন পরিব্যাপ্ত। ট্রেন্ডিং লব্জ। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় কোনও বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের ওপর লম্বভাবে প্রযুক্ত বলকেই চাপ বলা হয়। সেই চাপ আর এই "চাপ" এর মধ্যে তাত্বিক সাযুজ্য থাকলেও  চাপের সংজ্ঞা  এক্ষেত্রে ঠিকঠাক প্রযুক্ত কিনা সে বিষয়ে তর্কে গেলে ব্যাপারটা চাপের হতে পারে। কেননা মানুষ যদি বস্তু হয় তার মস্তিষ্কের প্রতি স্কোয়ার ইঞ্চিতে শুধু লম্ব কেন উলম্ব, আনুভূমিক, পার্শ্ব, উত্তল,অবতল ও স্পর্শক বরাবর পারিবারিক, অফিসিয়াল, ফিনান্সিয়াল, কনফিডেনশিয়াল, ম্যারিটাল, এক্সট্রা ম্যারিটাল কত যে বল নিরন্তর প্রযুক্ত হতে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। আর এতসব বল মিলেমিশে মস্তিষ্কের মিক্সারে ঘেঁটে সলিড মণ্ড হয়ে যখন ব্রহ্মতালু ফুঁড়ে বেরোতে চায় তখনই  মানুষ ইদানীং সেই মোক্ষম শব্দটি ছুঁড়ে দিয়ে নিজের বিপন্নতা ব্যক্ত করে, " চাপ বস চাপ...ব্যপক চাপ...হ্যাভক চাপের ব্যাপার... জাস্ট নিতে পারছি না। " সামান্য বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেই মানুষ এখন হাওয়া পাংচার বেলুন হয়ে গিয়ে দার্শনিক সক্রেটিসের মতো বিড়বিড় করতে থাকে "চাপ..চাপ...টেরিফিক চাপ" । যেন চাপ শব্দটি কস্মিনকালেও  ছিল না। করোনা ভাইরাসের মতো সাডেন ব্রেক আউট হয়েছে। ছাত্রের কাছে হোমটাস্ক আর এক্সাম হলো "চরম-চাপ", নির্বাচন এলেই প্রার্থী, ফুল নেতা, হাফ নেতা, চামচা, সরকারী আধিকারিক, ইডি প্রাপ্ত কর্মচারীদের "নাভিশ্বাস -চাপ", পুজো এলে উদ্যোক্তাদের "কাছাখোলা-চাপ", লেখকদের শারদ সংখ্যায় লেখা পাঠানোর "শিরে সংক্রান্তি-চাপ", ডি. এ বাড়ছে না --সরকারি কর্মচারী দের "কোষ্ঠবদ্ধতার সমতুল চাপ", সেলস এক্সিকিউটিভ দের টার্গেট মিট করার "যমচাপ" এমনকি অফিস আওয়ারে চটজলদি চান সেরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়ে অন্তর্বাস অন্তর্হিত, ব্যাস "মাথায় আগুন চাপ"। দোকানে জিনিস কিনে অনলাইন ট্রান্সফার করে দাম মেটাতে গিয়ে মোবাইল মারাত্মক হ্যাঙ করছে, "প্রেস্টিজে চাপ"। এ যুগে চাপ অন্তহীন। 

অথচ আজ থেকে বেশি দূর নয় মাত্র বছর পনেরো কুড়ি আগেও  আমাদের পূর্বজরা "চাপ" বলতে বুঝতেন স্রেফ নিম্নচাপ। তা সে বঙ্গোপ কিংবা আরব সাগরের হোক কিংবা প্রাতঃকৃত্যের। বড়জোর পাওনাদারের বা ভাড়ার টাকার জন্য বাড়ি ওয়ালার চাপ থাকতেই পারে। তবে সেসব চাপ নিয়ে তারা বিশেষ একটা চাপে থাকতেন না। ভাবটা এমন ছিল যে, চাপ দিয়েছেন যিনি চাপ কাটাবেন তিনি। বরং চায়ের দোকানে দুটোকে চারটে করে খেয়ে কিংবা পাড়ার রকে সিগারেটের "কাউন্টার" ব্যাটন চালাচালি করতে করতে তারা ভুলে যেতেন চাপের কথা। সেসময় বন্ধুমহলের যূথবদ্ধতার আবহে 'চাপ' উবে যেত কর্পূরের মতো। সমস্যা এলে মানুষ ভাগ করে 'সালটে' দিতো। তাও কি সমস্যা পুরোপুরি নিরসন হতো? হতো না। জীবন থাকলে সমস্যা থাকবেই। Life is not a bed of roses কথাটা পিতৃদেব প্রায়ই বলতেন। বাংলা মিডিয়ম স্কুলের লড়ঝড়ে বেঞ্চে বসে ছাত্ররা গালে হাত দিয়ে ধুতি পড়া বাংলা শিক্ষকের সারমন শুনতে শুনতে বড় হতো " কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে? " এসব দর্শন এখন তামাদি মেরে গেছে।  আধুনিক নেটপোষ্য প্রতিটি মানুষ এখন সবজান্তা পাঁচুদা। তারা দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য,জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে জ্যোতিষ চর্চা,কবিতা, রান্নাবান্না, বাগান চর্চা কী না জানে। কেবলমাত্র তারা দুঃখু মোটেই সইতে পারেন না । সুখকে তাই যতই তারা আষ্টেপৃষ্ঠে যতই বেঁধে রাখতে চায় ততই তা বারবার ল্যাটা মাছের মত পিছলে যায়। মানুষ যত ভুলে যাচ্ছে" চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ" মর্ম ততই চাপে পড়ে যাচ্ছে। ত্বরার ত্রাসে মানুষ এখন ত্বরান্বিত। মানুষের জীবনের মুলমন্ত্র এখন ত্বরণ। Speed, Speed more Speed । কে কার আগে কত দ্রুত ঈপ্সিত বস্তুটি করায়ত্ত করতে পারবে তার তুমুল প্রতিযোগিতা। যার নিট ফল সেই " চাপ "। 

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে খুব ছোটখাটো বিষয় যেমন ধরা যাক  কলে জল নেই, চাপ। নেট প্যাক শেষ রিচার্জ করতে বড়জোর দু মিনিট লাগবে, তাও চাপ। এটিএম এ লাইন, চাপ। বাজার করতে যাওয়া, চাপ। এমনকি বহুদিন বাদে প্রবাসী বন্ধু বাড়িতে আসবে দেখা করতে। চাপ। তাকে যদি ডিনারে ইনভাইট করতে হয় সে তো আরো চাপ। বাড়িতে না খাইয়ে রেস্তোরাঁয় ট্রিট দিলেই চাপ কেটে যায়। মানুষ এখন মানুষের বাড়ি যাবে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিলে, চাপ। হুট করে চলে আসার তো প্রশ্নই নেই। এলে তাকে 'জাস্ট নেয়া যায় না।' কতক্ষণে " মাল" টা "হাল্কা" হবে বুকের ভেতর লাবডুব চলতে থাকে।  তার ওপর অনাহুত আগন্তুকের চালচলনে যদি হাত পাতার সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র আভাস মেলে সে তো নিম্নচাপের চেয়েও মারাত্মক। 

এসব দেখেশুনে কয়েক যুগ আগের হারিয়ে যাওয়া একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। সাতসকালে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে বাড়ির গেটে সপরিবারে ল্যান্ড করলেন মায়ের দূরসম্পর্কের হারু মেসো। মেসো, মাসি, ছেলে মেয়ে, ছেলের বৌ, নাতি, নাতনি। সঙ্গে হরেক আকৃতির মালপত্তর। সে যুগে মোবাইল ছিল কল্পবিজ্ঞানের বস্তু, ল্যান্ডফোন ছিল শহরের হাতে গোনা বড়লোকের স্ট্যাটাস সিম্বল, আর চিঠি ছিল মৃতবৎসা।  অর্থাৎ বিয়ে পেরিয়ে গেলে কিংবা মরে ভুত হয়ে নবজন্ম প্রাপ্ত হলে শ্রাদ্ধের চিঠি লেটার বক্সে প্রসব করত। তো মেসোমশায় উঠোনে বোঁচকা বাঁচকি নামিয়ে হাঁক পড়লেন, " আরে বাড়ির লোক সব ঘুমায় দেহি অখনো। আমরা আইয়া পড়সি। কৈ গো, দিদি, দাদা বাবু.... " গলা শুনে বাড়ি শুদ্ধ লোক ধড়মড় করে উঠে দেখে দুয়ারে অতিথি। দেখে সকলে অবাক। 

" কী কান্ড...মণি, হারাধন  তুমরা ।  "
-" আরে ছোট মাসি যে। কদ্দিন পর এলে তোমরা। কি যে ভাল লাগছে তোমাদের দেখে। "

ব্যাস,সবাই লেগে পড়লো অতিথি আপ্যায়নে। জানা গেল চিঠি ছাড়া হয়েছিল মাস খানেক আগে। সে চিঠি যাদের আগমন সংবাদ বয়ে আনছে তারা পৌঁছে গেছে। কিন্তু সে তখনও এসে পৌঁছয়নি। তাতেও কোনও "চাপ" নেই। দাদু স্বর্গত। মামারা ছুটলেন বাজারে। মাছ, তরি তরকারি, মিষ্টি সব এলো। দিদিমা রকমারি রান্না করে খাওয়ালেন। চারদিন ধরে বাড়িতে খাওয়া দাওয়া গান বাজনা আনন্দ উল্লাস করে অতিথিরা চলে গেলেন দার্জিলিং বেড়াতে। ফেরার পথে আরেক চক্কর মামাবাড়িতে ঢুঁ দিয়ে তারা ফিরে গেলেন। এই যে যৌথ আনন্দের ছবি এর পেছনেও কি চাপ ছিল না? ছিল। রাতে শুয়ে দিদিমার কন্ঠস্বর শুনেছিলাম। ছোট মামাকে বলছেন, " জগার মুদির দুকানে এই মাসে অনেক বাকি পডছে, না রে? "
-" তা তে কী হলো। জগা কোনোদিন তাগাদা করে না মা। তুমি ঘুমাও। সব হয়ে যাবে। "

এ যুগে কেউ কারো বাড়িতে ঢুকে না বলে কয়ে সোজা হেঁসেলে এন্ট্রি নিয়ে নেবে এতো স্বপ্নেও ভাবা যায় না। তার ওপর সে যদি অনাত্মীয় প্রতিবেশী হয় তা হলে তো কেসটা ভীষণ চাপের। কিচেনে ট্রেসপাসিংয়ের চার্জে সমাজ আজকের দিনে তাকে নির্ঘাত ব্ল্যাক লিস্টে ফেলে দেবে। অথচ একসময় পারস্পরিক হৃদ্যতা এমন ছিল যে ব্যাপারটা মোটেই চাপের ছিল না। মানুষে মানুষে এই মধূর সম্পর্কের জন্য বোধহয় "চাপ" শব্দটা এত প্রবল ভাবে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেনি। ঘটনাটা না বললে ব্যাপারটা ঠিক খোলসা হবে না। আর এটা জেনে মনে হতেই পারে জীবন আদতে ততটা চাপের নয় মোটেই যতটা চাপ আমরা নিয়ে ফেলেছি। তবে এ ঘটনার পেছনে যে " চাপ" টা কাজ করেছিল সেটি না চাপলে এই মিষ্টি মধুর ঘটনাটি ঘটতোই না হয়তো।  ঘটনাটি এরকম। 

আমাদের বাগানতুতো এক জ্যেঠামশায় ছিলেন চা-বাগানের হাসপাতালে কম্পাউন্ডার। সেকালে পাশাপাশি চা-বাগানের বাবুদের পারস্পরিক হৃদ্যতা ছিল অপার। জ্যাঠামশায় হাট ফেরতা পাশের চা-বাগানের বাসা লাইন দিয়ে সাইকেলে ফিরছেন। এমন সময় তার নিম্নচাপ প্রবল থেকে প্রবলতর হলো। বেগতিক দেখে সেই বাগানের ডাক্তার বাবুর কোয়ার্টার্সের সামনে সাইকেল রেখে তিনি "বৌদি, বৌদি হাঁক পেড়ে সটান ঢুকে পড়লেন ভেতরে।দরজা খোলা। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেগের চোটে বেগবান জ্যাঠামশায়ের তখন কোনোদিকে দৃকপাত করার সময় নেই। উঠোনের কলঘরে থেকে কোনমতে জলের বালতি নিয়ে ছুটেছেন তার গন্তব্যে। হালকা হয়ে হাসিমুখে ফিরে এসেও ফের ডাক দিলেন, " বৌদি, বৌদি..ও বৌদি। কোনো সাড়া নেই। বৌদি তখনো পাশের বাড়ির 'মাঈজীর" সাথে গল্পে ব্যস্ত। ডাক্তার বাবুও হাসপাতালে।  এদিকে পেট খালি হতেই ক্ষিদে চাগাড় দিয়েছে। রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন সেখানেও কেউ নেই। শুধু মিটসেফে খাবার সাজানো। দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায় জ্যেঠামশায়ের মাথায়। থালায় পরিপাটি ভাত আর ডিমের ঝোল বেড়ে চেটেপুটে সাবড়ে দিয়ে একটা চিঠি লিখে এলেন, 

" শ্রদ্ধেয়া বৌদি, 

ডিমের ঝোলটা অপূর্ব হয়েছিল। লোভ সামলাতে না পেরে একটু বেশিই খেয়ে ফেললাম। আপনার রান্নার হাত চমৎকার। একদিন নেমন্তন্ন করবেন। ভালো মন্দ খেয়ে যাবো। 
ইতি -
আপনার রন্ধনমুগ্ধ ঠাকুরপো, 
 নীরেণ। "

আজকের সিসিটিভি-র যুগে এই ঘটনা নিতান্তই অর্থহীন। বদলে যাওয়া চাপ সর্বস্ব সমাজে হয়তো অসভ্যতাও বটে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri