বক্সাদুয়ার বনভূমিতে/চিত্রা পাল
বক্সাদুয়ার বনভূমিতে
চিত্রা পাল
উত্তরবঙ্গে আমাদের বসবাস অর্থে অরণ্যভূমিতে বসবাস।যদিও একথা এখন পুরোনো, তবু এখনও এখানে আছে কিছুটা ঘন সবুজ বনভূমি। বক্সাদুয়ার যাবার পথে তা আমি বুঝতে পারলাম আরও বেশি করে। প্রথমে আমরা এক রাত ছিলাম রাজাভাতখাওয়া গেষ্ট হাঊসে।এ গেষ্ট হাঊসে ঘরগুলোর বেশ সুন্দর পাখির নামে নাম দেওয়া ময়না টিয়া বুলবুলি এ ধরণের।পরেরদিন সকালে রওনা দিলাম বক্সাদুয়ার। রাজাভাতখাওয়ার কাছেই সান্তালাবাড়ি। এই সান্তালাবাড়ি থেকেই পায়ে হেঁটে যাওয়া বক্সাদুয়ার।সেই পাহাড়ের মাথায় যেতে হবে। প্রথমে ভাবলাম,যেতে পারবো কি না, তাও উৎসাহ ভরে চলতে শুরু করলাম, আর এই বনভূমি তার সবুজ আঁচল দিয়ে আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল।
এই পথ বড় সুন্দর। একেবারে সবুজে সবুজ বনভূমি।পাহাড়ি ঝোরা বয়ে চলেছে কুল কুল করে। নানা রকমের ফার্ণ গাছ, সঙ্গে বাঁশ গাছের ঝোপঝাড়। কত নাম না জানা গাছ, সে গাছে বিচিত্রবর্ণের ফুল ফুটে আছে। পাখির কূজনে পরিব্যাপ্ত চারদিক। শুধু পাখির কাকলিতেই আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় তৃপ্ত। এত পাখী আছে যে বলে শেষ করা যায় না। ঝাঁক বেঁধে কোয়েল ধনেশ তো আছেই, তার সঙ্গে আছে সবুজ বুনো পায়রা। অনেক বিপন্ন প্রজাতির পাখির বাস এখানে। এমন অনেক পাখি দেখলাম যাদের আগে কখনো দেখা পাইনি। যেতে যেতে পৌঁছলাম একটা ছোট্ট গ্রামে। সেখানে গাছের গায়ে ঝোলানো রয়েছে একটা লাল টুকটুকে ডাকবাক্স। আমাদের সেই আগের দিনের ফেলে আসা পত্রপাঠের চিহ্নরূপে। ওখানেই একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। সেখানে চারদিকে বনবনানীর মধ্যে বসে চা খাওয়া হল এক অন্য অনুভূতি। চায়ের দোকানি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম ও এখানেই বড় হয়েছে, বিয়ে হয়েছে, স্বামী সন্তান নিয়ে এখানেই থাকে। ও এই দোকান চালায়। ওর স্বামী বাইরে সান্তালাবাড়িতে কাজে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখানেই থাকবে? একগাল হেসে মাথা হেলিয়ে উত্তর দেয়, হ্যাঁ। আসলে আমার জিজ্ঞেস করাটাই ভুল। ওর এই পরিবেশে বড় হওয়া, এই তো আপন। এই আপনাকে ছেড়ে কেউ যায় নাকি? ক্ষণিক বিশ্রামের পরে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
ধীরে ধীরে হেঁটে পৌঁছলাম বক্সা ফোর্ট। এই সেই বক্সাফোর্ট যেখানে স্বাধীনতা আন্দোলনকারী বন্দীদের রাখা হয়েছিল নির্মমভাবে। এই দুর্গম অঞ্চলে কত কষ্ট পেতে হয়েছে তাঁদের ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। শুনেছি এখানে নেতাজী সুভাসচন্দ্রও বেশ কিছু সময় কাটিয়ে ছিলেন।
সব কিছু দেখে শ্রদ্ধা জানিয়ে আবার রওনা দিলাম। আবার সেই বনভূমি অতিক্রম করে ফিরে আসা। ফেরার সময়ে সূর্য পশ্চিমে গড়িয়ে গেছে। অস্তমিত সূর্যের আলো বনভূমির মাথায়। আর কুলায় ফিরে আসা পাখিদের কাকলিতে মুখর অঞ্চল। ধীরে ধীরে ফিরে এলাম সমতলে। কিন্তু ওই সুখী মেয়েটির মুখ বহুদিন মনে রয়ে গেল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴