বক্সা বাঘবন আর পোখরির গল্প/দেবপ্রিয়া সরকার
বক্সা বাঘবন আর পোখরির গল্প
দেবপ্রিয়া সরকার
---------------------------------------
প্রত্যেক অরণ্যেরই নিজস্ব শব্দ, গন্ধ, রঙ এবং রূপ আছে। যদিও হিমালয় লাগোয়া তরাই-ডুয়ার্সের সব জঙ্গলেরই শোভা প্রায় একরকম, তবুও বাকি সব অরণ্যকে পেছনে ফেলে আজও জনপ্রিয়তার শিখরে স্বমহিমায় বিরাজমান বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প। বক্সায় বাঘ আছে কী নেই তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও, অপার সৌন্দর্য আর রহস্য নিয়ে সে আজও ডুয়ার্স ট্যুরিজমের হটস্পট। এই প্রাচীন বনভূমির অমোঘ টানে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় জমায় পর্যটকের দল। বক্সা টাইগার রিজার্ভের আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে নাজানি কত কত বিস্ময়! তাদেরই একটা হল পোখরি। গভীর জঙ্গলের ভেতর এক বদ্ধ জলাশয় আর তাকে ঘিরে প্রকৃতির এক অসাধারণ লীলাখেলা!
করোনা কালকে পেছনে ফেলে এক ঝলমলে শরতের সকালে ডুয়ার্সের চা-পাতার সুবাস বুকে ভরে সপরিবারে রওনা দিয়েছিলাম বক্সা টাইগার রিজার্ভের উদ্দেশে। জয়ন্তী রিভার বেডের ধারে একটা ছিমছাম রিসোর্টে আস্তানা গেড়েছিলাম আমরা। নদীর জলে পা ডুবিয়ে ফটোশ্যুট, জিপসিতে জঙ্গলের কোর এরিয়ায় সাফারি ছাড়াও ওই ট্রিপে যেটা সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় ছিল, সেটা হল পোখরি ভ্রমণ।
রোদ তপ্ত সকালে গরম গরম পুড়ি-তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে হাতিদের মুক্তাঞ্চল বলে পরিচিত জঙ্গল ঘেরা এক পাহাড়িপথ ধরল আমাদের গাড়ি। জয়ন্তী থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বে পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়েছে এক প্রাকৃতিক জলাশয়। অর্ধেকটা রাস্তা গাড়িতে আসার পর বাকি পথ হাঁটতে হবে শুনেই একটু কেঁপে গিয়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। অন্য উপায় না থাকায় দু'কিলোমিটার চড়াই পথ বিপদের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ট্রেক করতে কষ্ট হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পোখরির কাছে পৌঁছাতেই উধাও হয়ে গেল সব ক্লান্তি আর ভয়ের অনুভূতি।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষদের ভাষায় পোখরি অর্থাৎ পুকুর। শিলাস্তরের ভেতর বহমান জলধারা সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে জলাশয়টি। সারাবছর এর জলস্তর নাকি একই রকম থাকে। স্হানীয় লোকেদের ধারণা এই জলাশয় অত্যন্ত পবিত্র। তাই কেউ এর জলে পা ছোঁয়ায় না। এখানে রয়েছে অজস্র বিশালাকৃতি মাগুর মাছ আর কচ্ছপ। স্হানীয় রীতি অনুযায়ী এদের জন্যে পর্যটকের দল সঙ্গে করে মুড়ি নিয়ে যান। মুড়ির লোভে জলাশয়ের ধারে ভিড় জমায় মাছেরা। এরা কত বছর ধরে এই জলাশয়ে রয়েছে তার সঠিক হিসেব আমাদের গাইডদাদা দিতে পারলেন না।
লেকের পাশেই বানানো হয়েছে বেশ কয়েকটি কংক্রিটের বেদী। একটা দেবী পোখরির থান। বৌদ্ধরা বছরভর পূজার্চনার জন্যে আসেন এখানে। এছাড়াও ভগবান গণেশ এবং দেবী কালরাত্রি পূজিতা হন এই নির্জন পাহাড়ি জঙ্গলে। দেবী কালরাত্রি, মা দুর্গার সপ্তম রূপ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধের সময় দেবী এই ভয়াল রূপে আবির্ভূতা হন। এখানে দেবী গাধার পিঠে সওয়ার। দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা এবং অপর দুই হাতে শোভা পায় খড়্গ এবং কন্টক। দেবী কালরাত্রি যেকোনও বিপদ থেকে মানুষকে পরিত্রাণ প্রদান করেন, এই বিশ্বাস থেকেই বক্সা টাইগার প্রোজেক্টের জয়ন্তী রেঞ্জে পোখরি লেকের ধারে কোচ রাজপরিবারের লোকেরা এই দেবীর আরাধনা শুরু করেছিলেন। এখনও দেবীর থানে চলে নিত্য পুজাপাঠ। মূর্তিটি যদিও সিমেন্টের তৈরি তবুও গজরাজদের কল্যাণে আজ এর ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা।
গভীর জঙ্গলের ভেতর পবিত্র পোখরির ধারে বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিলাম সকলে। নিরিবিলি অরণ্যের বুনো গন্ধ, ঘণ্টা পোকার একটানা শব্দ, থেকে থেকে অজানা শ্বাপদের চাপা গর্জন মিলেমিশে মনের ভেতর জন্ম দিয়েছিল এক অনন্য অনুভূতির। এই বিপদসংকুল জঙ্গলে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয় বলে বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন গাইড দাদা। তাই অনিচ্ছা সত্বেও উঠতে হল আমাদের। যে পথ ধরে গিয়েছিলাম সেই পথই আবার ধরলাম ফেরার জন্যে। যাবার সময় হাঁটার গতি যতটা বেশি ছিল, ফেরার কালে ছিল ততটাই শ্লথ। গাড়ির কাছে পৌঁছতে অজান্তেই বেরিয়ে এল স্বস্তির নিঃশ্বাস। সোজা ফিরে এলাম রিসোর্টে। বাকি দিনটা একটা অদ্ভুত ঘোরের ভেতর দিয়ে কেটে গেল। যে অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলাম তা সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে, একথা হলফ করে বলা যায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴