ফোর ডাউন আসাম মেল/সুব্রত ভট্টাচার্য
ফোর ডাউন আসাম মেল
সুব্রত ভট্টাচার্য
অভিজিৎদার বড় প্রিয় ট্রেন ছিলো ফোর ডাউন আসাম মেল। অভিজিৎদা আমাদের সহকর্মী, বছর দুয়েকের বড়। উত্তর বাংলার ছেলে, কলেজের পাট শেষ করে চাকরি পেলেন রেল দপ্তরে। তারপর সরকারী আদেশ হাতে নিয়ে সোজা লামডিং। আমাদের পোস্টিং হয়েছে কিছুটা কাছে বঙ্গাইগাও, গুয়াহাটি।
মন বেশি খারাপ অভিজিৎদার। বাড়ি থেকে এতটা দূরে, তাতে আবার ছুটি পাওয়া মুস্কিল। ছুটি চাইলেই হাজারটা প্রশ্ন। নতুন জায়গা, পরিচিত লোক তেমন নেই। অফিসের কাজ আর সন্ধ্যায় সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটছে কোনও রকমে। অফিসের কাজটা তাকে বড্ড ভোগাচ্ছে। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার ব্যাপারটা তিনি বিশ্বাসই করতেন না। মাঝে মাঝে লাগামহীন ফাঁকি দিয়ে ফেলতেন। ওপরমহলে একটা অবিশ্বাসের ভাবমূর্তিও তৈরি হয়ে গিয়েছিলো।
ছুটি পেলেই ফোর ডাউন আসাম মেল ধরে সোজা বাড়িতে। আবার নিজের শহরে কয়েকদিন কাটিয়ে থ্রি আপ আসাম মেল ধরে চাকুরিস্থলে ফিরে যাওয়া। এমনি অভ্যেস চালু করে ফেলেছিলেন। রিজার্ভেশন বা বিনা রিজার্ভেশন, কম বয়সে সেসবের কিছুই পরোয়া ছিলনা। ট্রেনটা সোজা চলে যেতো একেবারে গন্তব্য পর্যন্ত। মাঝ রাস্তায় ট্রেন বদলের কোনও ঝক্কি ছিলনা। এভাবেই ফোর ডাউন আর থ্রি আপ আসাম মেলের সাথে একটা সখ্যতা আর বিশ্বাস গড়ে উঠেছিলো অভিজিৎদার। আমাদেরও বেশ প্রিয় ছিলো ফোর ডাউন আর থ্রি আপ আসাম মেল।
তখন মিটার গেজ ট্রেনেরই দাপট। ব্রড গেজের কাজ চলছে দ্রত গতিতে। অসমের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হলে ট্রেন বদল করতে হত নিউ বঙ্গাইগাও বা গুয়াহাটিতে। আসাম মেল চলতো দিল্লী থেকে ডিব্রুগড় পর্যন্ত। সেজন্য ছিল বেশ জনপ্রিয়। বেশ কবার গুয়াহাটি থেকে শিলিগুড়ির যাত্রাপথে অভিজিৎদার সাথে দেখাও হয়ে গেছে আমাদের।
*** *** ***
সেবারে হঠাতই একটা জরুরি কাজ এলো অভিজিৎদার হাতে। লামডিং থেকে কাটিহার যেতে হবে কিছু জরুরি কাজে। ঊর্ধ্বতন অফিসারের এমন আদেশে ভীষণ খুশী অভিজিৎদা। এতো মেঘ না চাইতেই জল। কাজকম্ম সব কিছু বুঝে নিলেন। একখানা অলিখিত চুক্তি হলো, ফেরার সময় একদিন বাড়িতে থেকে আসতে পারবেন। ওপরওয়ালা নীরব সম্মতি দিলেন, অফিসে ফিরে বাড়তি কাজ করে সে ঋণ শোধ করতে হবে।
ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে পরদিনই অভিজিৎদা ধরে ফেললেন তার প্রিয় ফোর ডাউন আসাম মেল। সরকারী কাজ, তাই এবার রিজার্ভেশন পেতে অসুবিধা হয়নি। গর্বের সাথে নিজের আসনে বসে পড়লেন। নদী, নালা, মাঠ পেরিয়ে ট্রেন ছুটছে। হেঁকে বেড়াচ্ছে ঝাল মুড়ি, বাদাম ভাজা, চা আরও কত কিছু। প্রায় ২৪ ঘন্টার যাত্রা শেষ করে এক সময় কাটিহারে এসে পৌছুলেন অভিজিৎদা। নিজের শহরের স্টেশন শিলিগুড়ি পার করে আসতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এ ব্যাপারে সংযমের পরিচয় দিলেন। নিজেকে বোঝালেন ফেরার সময় তো সুযোগ থাকছেই।
কাটিহারে দু দিন কাজে ব্যাস্ত থাকতে হলো। ফাঁকে ফাঁকে দেখাও হল কিছু বন্ধু বান্ধবের সাথে। কাজ শেষ হলো দুদিনে। তারপর এবার ফেরার পালা। তৃতীয় দিন আবার ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে কাটিহার স্টেশনে।
স্টেশনে পৌছেই অভিজিৎদার নজরে এলো ব্যাস্ত প্লাটফর্ম, দাঁড়িয়ে একখানা মেল ট্রেন। যাত্রী ,দোকানদার ও রেলকর্মীদের ব্যস্ততার মাঝেই ট্রেনের খবর নিয়ে জানতে পারলেন এটাই তার বহু পরিচিত ফোর ডাউন আসাম মেল।
এ ট্রেন তার আপাদমস্তক চেনা। পরিচিতির সূত্র ধরেই চটপট ট্রেনে উঠে পড়লেন এবং একখানা ফাঁকা সীট দেখে বসে পড়লেন । এখান থেকে বেশী দূর নয়, ঘন্টা ছয়েক বাদে পৌঁছে যাবেন তার নিজের শহর শিলিগুড়ি। তারপর একটা দিন একেবারে নিজের।
*** *** ***
মাঠ, নদী, ধানক্ষেত পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। আধ ঘন্টা চলার পরে টিকিট পরীক্ষক হাজির। অভিজিৎদা ব্যাগ খুলে তার পাশ দেখালেন এবং সবিনয়ে জানতে চাইলেন এ গাড়ী শিলিগুড়ি কটা নাগাদ পৌঁছুবে। রিজার্ভেশনের লিস্ট থেকে চোখ সরিয়ে টিকিট পরীক্ষক আশ্চর্য ভাবে তাকালেন। -- শিল্লিগোড়ি, এ গাড়ি তো শিল্লিগোড়ি সেই আ রহা হ্যায়। অভি বারাউনি জায়েগা। আপকো কাহা যানা হ্যায়। শিল্লিগোড়ি কা গাড়িতো উধার সে আয়েগা। আপ গলত ট্রেন মে বয়ঠ গয়া।
অভিজিৎদার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তিনি ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন। কাটিহার থেকে শিলিগুড়ি যাবার জন্য তার উল্টো দিকের ট্রেন অর্থাৎ থ্রি আপ আসাম মেলে ওঠার কথা ছিল। কর্মস্থল থেকে তাকে বরাবর শিলিগুড়ি নিয়ে এসেছে ফোর ডাউন আসাম মেল। আনন্দ আর আত্মবিশ্বাসে তিনি ভুল ট্রেনে উঠে পরেছেন। এখন কি করনীয় সেটা ভাবতে ভাবতেই খানিকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলো।
টিকিট পরীক্ষক তাকে বলে দিলেন, মিনিট পনরো পরে যে স্টেশন আসছে সেখানে নেমে তিনি যেন উল্টো দিকের ট্রেন ধরে নেন। কিছুই আর করার উপায় নেই ভেবে অভিজিৎদার অপেক্ষা শুরু হলো। তারপর সেই নতুন স্টেশনে নেমে অপেক্ষা করে, ফিরতি ট্রেন ধরে, একবার বদল করে প্রায় ষোল ঘন্টা পরে ক্লান্ত শরীরে পৌঁছেছিলেন শিলিগুড়িতে। বাড়ির লোক তাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন।
একদিন শিলিগুড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরে যাবার পর ঊর্ধ্বতন অফিসার তাকে কি বলেছিলেন, সে গল্প তিনি আমাদের বলেননি।
*** *** ***
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴