ফিরে কেন এলে না/আদৃতা দে রায়
ফিরে কেন এলে না
আদৃতা দে রায়
মননে, চিন্তনে ও যাপনে সতত রাখি তাকে। হোক না নিদ্রাহীন রাত অথবা প্রেম কিংবা সুতীব্র বিরহ,
নিত্য-নৈমিত্তিক যাপনের প্রায় সিংহভাগ জুড়েই তিনি বিরাজমান।
আখতারি বাঈ, ওরফে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদী ওরফে বেগম আখতার, যিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঠুমরী, দাদরা ইত্যাদি আঙ্গিকের অঘোষিত সম্রাজ্ঞী…তিনি আমার জীবনের এক প্রণম্য নারী, যাকে ঘিরে আমার শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধিতে বেড়ে ওঠা, যাকে আবর্তন করে আমার পথচলা…
আমার বয়স তখন পাঁচ অথবা ছয়…তখনও এখনকার মতো ইউটিউব কিংবা স্পটিফাইয়ের চল হয়নি। ফোন বলতে যা বুঝতাম তা ছিল বোতাম টেপা নোকিয়ার ছোট্ট আয়তাকার ফোন, যাকে স্মার্ট অন্তত বলা চলে না কোনোমতেই…
সঙ্গীতানুরাগী আমার মা তখন কিনে আনতেন নানাবিধ ক্যাসেট।
Lullaby এর পরিবর্তে হরিহরণ, মেহেদি হাসান, আমজাদ আলি খাঁ প্রমুখ শিল্পীর গান অথবা যন্ত্রানুসঙ্গে রাতে চোখের পাতায় নেমে আসত ঘুম। কোনো প্রিয় গান আবার শুনতে চাইলে ক্যাসেটের ফুঁটোয় পেনসিল ঢুকিয়ে রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হ'ত। সে এক আলাদা গল্প।
এমনই একরাতের কথা বেশ মনে পড়ে আমার। সেদিন মায়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম বিছানার এক কোনে।
জানালার পাশে অনবরত ঝিঁঝি পোকার মন কেমন করা শব্দ, জানালার ওপাশের প্রকান্ড মাঠ,ঝোপঝাড়, চাঁদের আলোর রূপোলী ঝালরে সুসজ্জিতা। এমতাবস্থায় রেকর্ড প্লেয়ার ঝংকার তোলে সহসা,
“জোছনা করেছে আড়ি /আসে না আমার বাড়ি,
গলি দিয়ে চলে যায়/ লুটিয়ে রূপোলী শাড়ি…”
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি সেই মাদকতায় ভরা কন্ঠকে…
-“মা?”
-“বলো সোনা”
-“যিনি গাইছেন, তিনি কে?”
-“আমার আর তোমার বাবার প্রিয় আখতারি বাঈ,বেগম আখতার জী”
-“আজ থেকে আমারও প্রিয় হ'লেন?”
-“নিশ্চয়ই।”
অপূর্ব মোহিনী কন্ঠের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন হয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরে সুরের সাগরে ডুব দিই আমি। বুকের মধ্যে অনুরণন তোলে বেগমজানের স্বর…
"চেয়ে চেয়ে পথ তারই/হিয়া মোর হয় ভারী,
রূপের মধুর মোহ/বলো না কী করে ছাড়ি..."
এরপর শৈশব পেরিয়ে কৈশোর এলো।
আখতারি বাঈ আমার আরও আপন হয়ে উঠলেন।
প্রথম একতরফা প্রেম হ’ল ; গানে গানে আস্থা জোগালেন বেগম জী…
“ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে/ কুঞ্জে এখনও কুহু কূজনে মাতে…”
সে কি আমায় ফিরিয়ে দেবে শূন্য হাতে? তাকে না পেলেও যা পেয়েছি তা কি নিছকই কিছু নয়?
বুকের মধ্যে তীব্র ওলট-পালট।
গভীর রাতে, মাথায় শীতল স্পর্শ বোলান আখতারি বাঈ…
“ফিরে কেন এলে না/ মধু এ লগন বয়ে যে গেল/মধুর পরশ দিয়ে গেলে না।”
চোখের কোন বেয়ে ঝরে পড়ে নোনা জলের ধারা…
এ নিছক জলবিন্দু নয়। যেন কর্ণকুহর থেকে মুক্তবিন্দুর দু-চোখে স্থানান্তর….
আখতারি বাঈয়ের সঙ্গলাভে বিরহ ধীরে ধীরে প্রিয় হয়ে ওঠে।
“অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া..” শোক তো প্রেমেরই চূড়ান্ত পাঠ…তাই ক্রন্দন সুন্দর, বিরহও…
কৈশোর অতিবাহিত হয়, এবার যৌবনে সন্তর্পণে পা রাখি। মনে প্রশ্ন জাগে, অমোঘ ধ্বনি উচ্চারিত হয়, "যার কন্ঠস্বরে এতো মায়া,এত প্রেম, তার নিজের জীবন কেমন ছিল?"
কৌতূহলী হয়ে পড়তে শুরু করি বেগমজানের জীবনের কথা, সেই সাথে প্রতি পদে পদে চমকিত হই…
তথাকথিত musically enriched পরিবারে জন্মগ্রহন না করা সত্ত্বেও মাত্র পনের বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে অনুষ্ঠান করেন, এবং শত সহস্র সঙ্গীতানুরাগীর বুকে ঝড় তুলে দেন আখতার জী।
স্বয়ং সরোজিনী নাইডু একটি অনুষ্ঠানে তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে আখতারি বাঈয়ের গানের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
“মল্লিকা -এ -গজল” ওরফে আখতারি বাঈ ‘’জলসাঘর”, “দানাপানি”,” এহসান” এর মতো কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং পরবর্তীতে সব কিছু থেকে সরে গিয়ে শুধু গানের জগতেই নিজেকে নিমগ্ন করে রাখেন…
সুর সম্রাজ্ঞীর জীবনে প্রেম কখনওই পূর্ণভাবে ধরা দেয়নি। বেগমজানের জীবন বিষয়ক নানান গুজব এবং বিতর্ক তাই অস্তিত্ব রাখে এখনও….
আহমেদাবাদে আখতারি বাঈয়ের শেষ কনসার্টের গল্প ব'লে এ লেখা শেষ করি।
নিজের গায়কী সেদিন ঠিক মনঃ পূত না হওয়ায় গলার ‘পিচ’ চড়া করেছিলেন আখতারি বাঈ। অতিরিক্ত জোরে স্বরক্ষেপণ এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে কনসার্ট শেষ করেই তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
৩০শে অক্টোবর, ১৯৭৪ সনে, সকল গজলপ্রমীর অন্তরে প্রকান্ড শূণ্যতা সৃষ্টি করে, আখতারি বাঈজী ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মৃত্যুর ঠিক ৮ দিন আগে তিনি পদ্মভূষণ পুরষ্কারে ভূষিত হন।
বেগমজানের গানে গানে তাকে সতত স্মরণ করি,
“সুনা করো মেরি জান,
উনসে উনকে আফসানে,
সব অজনবি হ্যায় ইয়াহা,
কউন কিসকো পেহচানে…”
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴