প্রিয় চিঠি/ডালিয়া চৌধুরী
প্রিয় চিঠি
ডালিয়া চৌধুরী
প্রিয় চিঠি,
আজ আনমনে বসে ছিলাম বারান্দায়। চৈত্রশেষের মাতাল হাওয়ায় মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়! অনেক পুরোনো একটা গান মনের ভিতর গুনগুনিয়ে উঠল। "আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম..!" কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে গেলাম! চিঠি….তুমি যেন আজ এক দূরাগত শব্দ। একটা সময় ছিল, যখন তুমি আমাদের দৈনন্দিন অম্লমধুরতায়, আমাদের ভালোলাগায় খারাপলাগায় জড়িয়ে থাকতে! তোমার জন্য কত অপেক্ষা! কবে আসবে, কবে পাব? তোমাকে ঘিরে কত শর্ত! কত প্রতিজ্ঞা! কত কথা দেওয়া! "সপ্তাহে একটা করে বা মাসে দুটো অন্তত চিঠি চাইই চাই," "নিদেনপক্ষে পৌঁছসংবাদটা যেন পাই" এরকমই সব চিঠির অন্দরমহলের কথা। আজ সেসব অনেকটাই গল্প কথা।
তবে কি জানো তো, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের কাজ এগিয়ে যাওয়া, এগিয়ে দেওয়া । আসলে আমরা বড় বেশি তাদের দাসত্ব করতে শিখেছি। তাই তোমাকে দিয়েছি দূরে ঠেলে! বর্তমান প্রজন্ম তো সিলেবাসের গুটিকয়েক পত্ররচনা ছাড়া তোমাকে চিনলও না, বুঝলও না। তবে কেজো চিঠিচাপাটি এখনও গায়ে ডাকটিকিটের গয়না পরে এদিক ওদিক যায় আসে। অন্যান্য শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আমরা কত চর্চা করি। কিন্তু, সাহিত্যের সংসারে তুমি যেন দুয়োরানী। যেন একেবারে একঘরে করে রাখা হয়েছে। সত্যিই কী তুমি বাতিলের খাতায় চলে যাবার মতো, বল?
তোমার শরীর জুড়ে শুধু অক্ষরের আলপনা নয়, আরো অনেক কিছু থাকত চিঠি ভরা খামে। ঠাকুরের আশীর্বাদী ফুল। ছেলে পরীক্ষায় বসবে, তাই মা পাঠিয়েছে। কখনো তোমার সঙ্গে থাকত পুজোয় মায়ের নতুন কাপড় কেনার জন্য ছেলের পাঠানো টাকা। সেবার পুজোয় সে বাড়ি আসতে পারবে না যে ! কখনো, খাম খুললেই সুগন্ধের সাথে তোমার মাখামাখি! এক প্রবাসী স্বামী তার স্ত্রীকে পাঠিয়েছে! আবার কোনোটিতে দুই সখির প্রাণভোমরা গুনগুন করে উঠত, "জানিস তো, সেদিন না…" অস্ফুট লজ্জা আর তাদের অশ্রুত খিলখিল হাসি যেন কানে বাজে। চিঠি তুমি এ সবই বয়ে নিয়ে যেতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
আর কত সুন্দর সুন্দর সম্ভাষণ! কোনটা যে লিখি? কোনটা যে মনের মতো হবে? ভেবেই আর কুল পাওয়া যায় না। আর শেষে ইতি টানা হল কত বিনয়ে, আহ্লাদে, প্রেমে একেবারে গদগদ!
নিজের মনেই হেসে মরছি, যখন মনে পড়ছে, তোমাকে ঘিরে দুষ্টুমি বা নষ্টামিও বড় কম ছিল না। পাড়ার সবথেকে বদরাগী কিপ্টে লোকটাকে জব্দ করার জন্য, পাড়ার ছেলেছোকরারা তার মেয়ের নামে প্রেমপত্র লিখে ফেলে দিল সে বাড়ির লেটার বক্সে। আবার কোনো পরশ্রীকাতর প্রতিবেশী বিয়েতে ভাঙচি দেবার জন্য বরপক্ষ বা কনেপক্ষকে উড়ো চিঠি পাঠাল। আর, তোমাকে ঘিরে ছিল কিশোর প্রেমের উত্তেজনা! স্কুল যাবার পথে ক্লাস নাইনের মেয়েকে, সাইকেল চালাতে চালাতে কোনো প্রেমিক একটুকরো প্রেমের আবেদন ছুঁড়ে দিল। এমনই সব বিচিত্র কাণ্ডের সাক্ষী ছিলে তুমি চিঠি !
তুমি ছিলে আমাদের অনেক না বলা কথা, অনেক রাগ, দুঃখ, অভিমান, অভিযোগ, আনন্দ, আহ্লাদ,অনেক না পাওয়ার, অনেক যন্ত্রণার জীবন্ত দলিল! আজ বড় তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। তুমি আবার ফিরে এস চিঠি। আমাদের তৃষ্ণাহরণ হয়ে এস। ফিরে এস সম্পর্কের টানাপোড়েন হয়ে! আবার খুলে দিই চিঠির ঝাঁপি! চৈত্র অবসানে নতুন প্রাণের জোয়ার হয়ে এস আমার প্রিয় চিঠি !
ইতি -
তোমার মরমিয়া
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴